ফরিদপুরের তারাপদ স্যার : মানুষ গড়ার কারিগর

ফরিদপুরের তারাপদ স্যার : মানুষ গড়ার কারিগর

  • লিডারশিপ ডেস্ক

স্বার্থপরতা আর আত্মমগ্নতার বেড়াজালে আটকে পড়া যান্ত্রিকতার এই সময়ে লাভ-ক্ষতির হিসাব মেলাতেই ব্যস্ত থাকে নাগরিক। ব্যতিক্রম দু-একজন তো থাকেনই। যারা এই শ্বাসরুদ্ধ সমকালকে ছাপিয়ে নির্মোহ জীবনের নীরব পদচিহ্ন এঁকে চলেন ধীরলয়ে, তাদেরই একজন ফরিদপুরের জগদীশ চন্দ্র ঘোষ। তাকে এই নামের চেয়ে তারাপদ স্যার নামেই চেনেন বেশিরভাগ মানুষ।

গত আগস্টে ৮৮ বছর পেরুলেন তিনি। নিবেদিত শিক্ষক ও সাংবাদিক হিসেবে জীবনের এত দীর্ঘসময় পেরিয়েও ক্লান্ত হননি কখনও। হাসিমুখ ছাড়া তারাপদ স্যারকে দেখা যায় না কোথাও। কারও সাহায্য ছাড়াই একা চলতে পছন্দ করেন তিনি। সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই প্রবীণ সময় কাটান জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে। হাজারো ছাত্রছাত্রীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় আরও অনেকদিন বেঁচে থাকার ইচ্ছা তার। সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন বয়স, শ্রেণি-পেশার ছাত্রছাত্রীরা প্রতিনিয়ত তার খোঁজ নেন, দেখতে যান শহরের ঝিলটুলী এলাকায় স্যারের বাড়িতে। নিচতলায় তার কক্ষে একাই থাকেন তিনি। এই জ্ঞানপিপাসুর ঘরময় ছড়িয়ে থাকে বই, পত্রিকা, ম্যাগাজিন। এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব তার, যেন নবীন-প্রবীণের চলমান সেতুবন্ধন।

সম্প্রতি ফরিদপুর শহরের একটি বাড়িতে স্যারের ছাত্রছাত্রীরা ৮৮তম জন্মতিথিতে তাকে ভালোবাসা জানাতে ভোলেননি। অনাড়ম্বর আয়োজনে আন্তরিকতার পরশ মেশানো ঘরোয়া অনুষ্ঠানের অতিথি হয়ে গিয়ে নিজেই হতবাক হয়ে যান। জন্মদিনের কেক, মোমবাতি, ব্যানার টাঙিয়ে তার জন্য সন্ধ্যায় অপেক্ষায় ছিলেন তার নানা বয়সী ডজনখানেক ছাত্রছাত্রীসহ স্থানীয় বিশিষ্ট নাগরিকদের অনেকেই। আবেগ আর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ৮ আগস্ট ৮৯ বছরে পা রাখেন তারাপদ স্যার। ফরিদপুরের সাবেক পৌর চেয়ারম্যান রকিবউদ্দিন আহমেদের ছেলে রশীদ আহমেদ তিতুর বাসভবনে (শহরের মিশন হাউসে) জন্মদিনের স্মৃতিচারণ, গান, কবিতা, কেক কাটার আনন্দে সামিল হয়েছিলেন ফরিদপুরের সরকারি ইয়াছিন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর আলতাফ হোসেন, সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক লায়লা আহমেদ, লেখক মফিজ ইমাম মিলন, ব্লাস্টের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শিপ্রা গোস্বামী, ডা. সুনীল গোস্বামী, সাংস্কৃতিক কর্মী শামিম আরা বেগম, রেজাউল মৃধা, সচেতন নাগরিক কমিটির সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান, ফিরোজা বেগম, কাজী মামুন, মিসেস খলিলুর রহমানসহ নতুন প্রজন্মের তারাপদ ভক্তরা।

জন্মদিনের সকালে শহরের রামকৃষ্ণ মিশনে স্যারকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর এবিএম সাত্তার, প্রফেসর এমএ সামাদ, প্রফেসর আব্দুল আজিজসহ গুণীজনরা। জগদীশ চন্দ্র ঘোষের জন্ম ফরিদপুর সদর উপজেলার ঈশান গোপালপুরে খ্যাতিমান ঘোষ পরিবারে। তার বাবা শহীদ যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, মাতা প্রফুল্ল বালা ঘোষ। দাপ্তরিক শিক্ষানথিতে তার জন্মতারিখ ১৯৩১ সালের ১ জানুয়ারি হলেও প্রকৃত জন্মতারিখ ১৯২৯ সালের ৬ আগস্ট।

বিএ পাস করার পর থেকে তার শিক্ষকতা জীবন শুরু। বিভিন্ন স্কুলে চাকরি করেছেন। ১৯৫৯ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিন যুগ তিনি ছিলেন ফরিদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই তিনি অবসরে যান। তিনি যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে দায়িত্বশীল ভূমিকা রেখেছেন। গণিত ও ইংরেজিতে দক্ষ এ শিক্ষক আজও মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ে সুনামের সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারে অবদান রেখে চলেছেন। অকৃতদার প্রবীণ এ ব্যক্তিত্বের অফুরান প্রাণশক্তি মুগ্ধ করে নবীনদের। তরুণ শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মীরা তাই ভিড় জমান তার বাড়িতে। তবে এতে তিনি কখনও বিরক্তবোধ করেন না। দেন সুপরামর্শ ও সহযোগিতা।

সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথিকৃত তিনি। ফরিদপুর প্রেস ক্লাব ও ফরিদপুর টাউন থিয়েটারে নিয়মিত যাতায়াত করেন এবং নেতৃত্ব দেন বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। ২০০৫ সালের ১৭ নভেম্বর ফরিদপুরের চিহ্নিত ও প্রভাবশালী সন্ত্রাসীদের হাতে সমকালের ফরিদপুর ব্যুরোপ্রধান সাংবাদিক গৌতম দাস খুন হওয়ার পর সাংবাদিক সমাজের প্রতিবাদী নেতৃত্বের হাল ধরেছিলেন তিনি।

ধীর-স্থির ও প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এ প্রবীণের অকুতোভয় স্বভাব শৈশব থেকেই। ১৯৪২ সালে তিনি যখন ১২ বছরের কিশোর, তখন ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের নেতাদের সহকারী হিসেবে কাজ করার দায়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। স্বদেশি নেতা ডা. সুবোধ সরকারের ভাতিজা আশুতোষ সরকারের নেতৃত্বে তখন এক হয়েছিল ফরিদপুরের ঈশান গোপালপুরের যুবক-তরুণরা। গোপনে তাদের লাঠি খেলা, তীর ছোড়া ও নানা শারীরিক কসরতের প্রশিক্ষণ চলত। কিশোর জগদীশ ভিড়েছিলেন সেই কিশোরদের দলে। তৎকালীন ফরিদপুরের সিআইডি ইন্সপেক্টর সন্তোষ দাসগুপ্ত কোনো এক রাতে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করেন জগদীশ চন্দ্র ঘোষ ও তার চাচা নরেশ চন্দ্র ঘোষকে। ১৫ দিনের হাজতবাসের পর তারা মুক্তি পান। ১৯৭১ সালে ফরিদপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের প্রথম শিকার হয় তারাপদ স্যারের পরিবার। ঘটনাক্রমে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যের বিশাল দল ফরিদপুরে প্রবেশ করে। শহরে ঢোকার মুখে তারা শ্রী জগদ্বন্ধু সুন্দরের আশ্রমে কীর্তনরত ৮ সাধুকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। তাদের এই হামলা ছিল তাৎক্ষণিক কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই। এর আট দিন পরে হানাদার বাহিনী খোঁজ নিয়ে তাদের দোসরদের সহায়তায় ফরিদপুরের ঈশান গোপালপুরে জমিদার বাড়িতে হামলা চালিয়ে নিরপরাধ ২৮ ব্যক্তিকে হত্যা করে। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডে শহীদ হন তারাপদ স্যারের আপন ভাই গৌর গোপাল ঘোষ, কাকাতো ভাই বাবলু ঘোষসহ তাদের বন্ধু পরিবার, জমিদার ঈশান সরকারের পরিবারের সদস্য এবং ফরিদপুর থেকে ওই বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিরা। পাকিস্তানি বাহিনীর মূল টার্গেট ছিল প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত দুই সহোদর জগদীশ চন্দ্র ঘোষ ও তার অনুজ ফরিদপুর মহকুমা ন্যাপের সাংগঠনিক সম্পাদক চিত্তরঞ্জন ঘোষ। ঘটনাক্রমে প্রাণে বেঁচে যান তারা।

তারাপদ স্যার বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি ফরিদপুর জেলা ইউনিটের শহীদ সাংবাদিক সামসুর রহমান স্বর্ণপদক লাভ করেন ২০০৩ সালে। ২০০৫ সালে ভূষিত হন ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড প্রথম আলো গণিত উৎসবে স্মারক সম্মাননায়। সাংবাদিক গৌতম স্মৃতি সংসদ-২০১৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে ফরিদপুরের ৬ গুণীজনকে গৌতম স্মৃতি সম্মাননা ২০১৩ প্রদান করে। সেখানে তিনি সাংবাদিকতায় সেরা সম্মাননায় অভিষিক্ত হন। এ ছাড়া শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতায় অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা, ক্রেস্ট, মেডেল, স্মারক ও মানপত্র।

সূত্র : দৈনিক সমকাল  favicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment