সাবাস বাংলাদেশ : সাবাশ সঞ্জয়

সাবাস বাংলাদেশ : সাবাশ সঞ্জয়

  • লিডারশিপ ডেস্ক

মায়ের একলা কষ্ট হচ্ছিল। তাই অল্প বয়সেই ছেলেটিকে কাজে লেগে যেতে হয়। তবু একদিন আবার এই ছেলেটিই দেশসেরা হন। সঞ্জয় মজুমদারের কথা শুনে নিন। 


বাড়ি থেকে স্কুল বেশি দূরে ছিল না। স্কুল থেকে ফিরেই ছুটতেন মাঠে। মোরগ লড়াই, বিস্কুট দৌড়, দীর্ঘ লাফসহ অনেক রকম খেলায় পুরস্কার পেয়েছেন। দারুণ প্রাণবন্ত ছিলেন সঞ্জয়। কিন্তু একদিন মেজ ভাই প্রণব ইলেকট্রিক শকে মারা গেলেন। ভেঙে পড়লেন বাবা। শয্যাশায়ী হলেন। চার বছর বিছানায় পড়ে থেকে মারা গেলেন। অনেক টাকা চলে গিয়েছিল তাঁর চিকিৎসায়। তিন ছেলে আর দুই মেয়েকে নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়েছিলেন মা খুকুমনি মজুমদার।

  • সঞ্জয় শান্ত হয়ে গিয়েছিলেন 

kalerkantho-2016-10-15-f-8তত দিনে প্রাথমিক বিদ্যালয় পেরিয়েছেন সঞ্জয়। সংসার চলছিল টেনেটুনে। মায়ের কষ্ট দেখে মন খারাপ হয়ে যেত সঞ্জয়ের। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি একটি মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকানে কাজে লেগে যান। দোকানটি তাঁদের বাড়ির কাছের খাসের হাটে। সেটা ২০০৯ সাল। বন্ধুরা যখন স্কুল শেষে খেলতে যেত, সঞ্জয় তখন ছুটতেন খাসের হাট। সন্ধ্যা হওয়ার পরে ছাড়া পেতেন। আর ফিরেই বসে যেতেন পড়ার টেবিলে। খেলার আর ফুরসত মিলত না। তবে খেলাটা তিনি একবারে ছেড়ে দেননি। স্কুল প্রতিযোগিতায় নিয়মিতই পুরস্কার পেতেন। ২০১২ সালে ‘স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা’য় দীর্ঘ লাফে প্রথম, ২০০ মিটার দৌড়ে দ্বিতীয় ও বর্শা নিক্ষেপে তৃতীয় হয়েছিলেন। একই বছর জেলা স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়া সমিতি আয়োজিত ৪১তম শীতকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দীর্ঘ লাফে প্রথম হয়েছেন। নোয়াখালী জেলার সুবর্ণচর উপজেলার চরবাটা খাসের হাট হাই স্কুল থেকে ২০১২ সালে এসএসসি পাস করেছেন। ২০১৪ সালে পাস করেছেন এইচএসসি। এখন বিএসএস প্রথম বর্ষে পড়ছেন।

  • কাজ চালিয়ে গেছেন

কলেজে ওঠার পরও পড়াশোনা, মোবাইলের দোকানে কাজ আর খেলাধুলা চালিয়ে গেছেন সমানতালে। ২০১৩ সালে আঞ্চলিক ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত ‘আন্তকলেজ অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতা’য় জেলা পর্যায়ে পোল ভল্টে দ্বিতীয়, দলগত রিলেতে দ্বিতীয় ও বর্শা নিক্ষেপে তৃতীয় হয়েছিলেন। পরের বছর ‘আন্তকলেজ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ২০১৪’-এ পোল ভল্টে প্রথম ও দীর্ঘ লাফে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। সর্বশেষ এ বছরের মার্চ মাসে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ‘আন্তবিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতা ২০১৬’-এ পোল ভল্টে দেশসেরা হন সঞ্জয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলো নিয়ে ২-৩ মার্চ বুয়েট মাঠে অনুষ্ঠিত হয় এ প্রতিযোগিতা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অংশ নেওয়ার মাসখানেক আগে পর্যন্ত সঞ্জয় জানতেন না এ রকম একটা প্রতিযোগিতা হয়, চাইলে তিনিও নাম লেখাতে পারবেন! তাঁকে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতার খবর দেন পূর্বপরিচিত এক বড় ভাই। ফোনে বলেছিলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেশের সব কলেজ নিয়ে এই আয়োজন। তুই অংশ নিবি?’ দেশের সব কলেজ অংশ নেবে এটা শুনে শুরুতে কিছুটা দ্বিধায় ভুগছিলেন। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে শোনা গেল—‘কিচ্ছু ভাবিস না। তুই পারবি।’ কিন্তু শুধু নাম লেখালেই তো হবে না। এ ধরনের প্রতিযোগিতার নিয়মকানুন তো কিছুই জানা নেই। তা ছাড়া অংশ নিতে হলে তো ঢাকায় যেতে হবে। আর আগে কখনো ঢাকায় যাননি। সেই ভয়ও কাজ করছিল। বিশ্বজিৎ নামের সেই বড় ভাই অভয় দিলেন—‘এসব কোনো সমস্যা না। চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার আগে তোদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। যে কয়দিন সময় আছে, বাড়িতে প্র্যাকটিস করো।’ নাম লেখালেন। কলেজ থেকে সঞ্জয়ের কাগজপত্র পাঠানো হলো। প্রতিদিন ভোরে কলেজ মাঠে চলে যেতেন। ঘণ্টাখানেক নিজে নিজেই চর্চা করতেন। এরই মধ্যে প্রতিযোগিতার সময় চলে এলো। ডাক পড়ল সঞ্জয়ের। তাদের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে এলেন। মূলত সেখানেই হাতে-কলমে পোল ভল্ট জানলেন সঞ্জয়। kalerkantho-2016-10-15-f-9

  • পুরস্কার ছাড়া চলবে না

মার্চের ৩ তারিখে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় সবাইকে পেছনে ফেললেন সঞ্জয়। ‘প্রথমবার ঢাকায় এসেছি। একটা পুরস্কার নিয়েই ফিরব, এমন টার্গেট ছিল। ভালো লাগছে, আমি টার্গেট পূরণ করতে পেরেছি।’ তাঁর কলেজের অধ্যক্ষ মোনায়েম খান বলেন, ‘দারুণ সম্ভাবনাময় সঞ্জয়। ওর মধ্যে চেষ্টা ও আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। সঠিক পরিচর্যা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ ছেলে একদিন অনেক দূর যাবে।’

  • ফুটবল-ক্রিকেটও খেলেন

ফুটবল-ক্রিকেটও দারুণ খেলেন সঞ্জয়। ফুটবলে রক্ষণভাগটা সামলানোর দায়িত্ব পড়ে সঞ্জয়ের ঘাড়ে। তিনিও আস্থার প্রতিদান দিতে ভুল করেন না। নিজ স্কুল ও কলেজের হয়ে বেশ কয়েকটি ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। নোয়াখালী জেলার নামকরা ক্লাব অগ্রদূত ক্রীড়া সংঘের হয়েও অংশ নিয়েছেন বেশ কয়েকটি প্রতিযোগিতায়। ক্রিকেটে মূলত বোলিংটাই করেন। টিভিতে রাশিয়ার ইসিনবায়েভার খেলা দেখেছেন। এখন এই অ্যাথলেটের ভক্ত বনে গেছেন সঞ্জয়। পোল ভল্ট নিয়ে অনেক সাধ থাকলেও সাধ্য নেই সঞ্জয়ের। জানালেন, ‘কোচ ছাড়াও অনুশীলনের জন্য ভালো মানের বাঁশ, ফোমসহ অনেক কিছুরই দরকার হয়। কিন্তু আমার তো এসবের কিছুই নাই। তবু সবার সহযোগিতা পেলে জাতীয় পর্যায় তো বটেই, অলিম্পিকেও অংশ নেওয়ার স্বপ্ন দেখেন এই তরুণ।

সূত্র : কালের কণ্ঠ  favicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment