হোটেল বয় থেকে বিশ্বতারকা

হোটেল বয় থেকে বিশ্বতারকা

  • লিডারশিপ ডেস্ক

হাসির জগতে চার্লি চ্যাপলিন এক অনন্য নাম অভিনয়ের দক্ষতা দিয়ে জয় করেছেন বিশ্বের কৌতুকপ্রেমীদের হূদয় দর্শকদের মন জয়ের মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন বুদ্ধিমত্তা আর পুলক জাগানো অঙ্গভঙ্গি সাদাকালো যুগে মূকাভিনয়ের অসাধারণ দক্ষতা তাকে হোটেল বয় থেকে করেছে বিশ্বতারকা 


জীবনের ট্র্যাজেডি

সবার হাসির জোগানদাতা এ মানুষটি অনেক উঁচু-নীচু পথ পাড়ি দিয়ে সুনামের শীর্ষে উঠেছেন। চার্লি চ্যাপলিনকে ছোটবেলায় সীমাহীন দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। বাবা সিনিয়র চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন জনপ্রিয় একজন সংগীত শিল্পী। অতিরিক্ত মদ খাওয়ার কারণে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে তিনি মারা যান। এরপর পিতৃহারা চ্যাপলিন অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে বড় হন। শৈশব সম্পর্কে চার্লি বলেছিলেন, ‘যদি ভাগ্য সহায় না হতো, তাহলে আমি লন্ডনের পথে পথে চুরি করে বেড়াতাম আর বেওয়ারিশ লাশ হয়ে কবরে যেতে হতো’। ১৮৯১ সালের আদমশুমারি থেকে জানা যায়, চার্লি তার মা হান্নাহ চ্যাপলিন এবং ভাই সিডনির সঙ্গে দক্ষিণ লন্ডনের বার্লো স্ট্রিটে থাকতেন। সেখানে ঠিকমতো বাসা ভাড়া দিতে না পারায় প্রায়ই তাদের রাস্তায় বের করে দেওয়া হতো। এভাবে তাড়া খাওয়ার চেয়ে চ্যাপলিন পার্কের বেঞ্চিতে ঘুমাতেই বেশি পছন্দ করতেন। অভাব-অনটনের সংসারে পুষ্টির অভাবে চ্যাপলিনের মা ১৭ বছর অসুস্থ থেকে মারা যান। তারপর চ্যাপলিনকে একটি এতিম খানায় রাখা হয়। সেখানে নিয়ম না মানার কারণে প্রায়ই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হতো। শৈশবের কষ্টের কারণে তিনি উপলব্ধি করতেন—

index2দেওয়া-পাওয়ার মাঝে কী আনন্দ। চ্যাপলিন প্রায় একটি কথা বলতেন, ‘বৃষ্টির মাঝে হাঁটা খুবই ভালো। কারণ এ সময় কেউ তোমার চোখের অশ্রু দেখতে পাবে না’। বাবা-মা মঞ্চের সঙ্গে জড়িত থাকায় তার অভিনয়ে আসাটা সহজ হয়।

মুদির দোকানে কাজ জোটে

চার্লির কর্মজীবন শুরু মুদির দোকানে কাজ দিয়ে। সেখানে কাজ চলে যাওয়ার পরে একে একে ডাক্তারখানা, লোকের বাড়ির বাসন মাজার কাজ, কাচের কারখানায় কাজ, রঙের দোকান, লোহার দোকান, ছাপাখানা, খেলনা কারখানা, কাঠচেরাই কল, কাগজ বিক্রি ইত্যাদি কাজে তিনি যুক্ত হন। ফুটপাথে রাত কাটানো এমনকি পচা খাবার কুড়িয়েও খেতে হয়েছে চার্লিকে। নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের অন্যতম মৌলিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব চ্যাপলিন নিজের ছবিতে নিজেই অভিনয়, সংলাপ রচনা, পরিচালনা, প্রযোজনা এমন কী সংগীত পরিচালনা পর্যন্ত করেছেন। নিজের সৃষ্ট ভবঘুরে দ্য ট্রাম্পে অভিনয় করেছেন মুখ্য চরিত্রে। শার্লট নামের ওই চরিত্রে তিনি ভবঘুরে হলেও ব্রিটিশ আদব-কায়দায় সুশৃঙ্খল এবং সম্মানবোধে অটুট ছিল। শার্লটের পরনে চাপা কোর্ট, নিজের চেয়ে বড় মাপের প্যান্ট, বড় জুতা, মাথায় বাউলার হ্যাট, হাতে ছড়ি আর ছোট্ট গোঁফ। এই সাজে চ্যাপলিনকে সবাই দারুণভাবে গ্রহণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল এক অভিজ্ঞ রাজনীতিকের মতো। যুদ্ধের বিরুদ্ধে তিনি বই লিখলেন, সিনেমা করলেন, বক্তৃতাও দিলেন। তখন চ্যাপলিন তার বিখ্যাত উক্তিটি দিয়েছিলেন, ‘মানুষকে ভালোবাসার জন্য যদি আমাকে কমিউনিস্ট বলা হয়, তো আমি কমিউনিস্ট।’

চ্যাপলিনের জীবনের মজার একটি ঘটনা

চার্লি চ্যাপলিন তখন পৃথিবী-বিখ্যাত। তার অনুকরণে অভিনয়ের একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। গোপনে চার্লি চ্যাপলিন নাম দেন সেই প্রতিযোগিতায়। মজার বিষয় হলো প্রতিযোগিতা শেষে দেখা গেলো প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছেন অন্য দুই প্রতিযোগী। চার্লি চ্যাপলিন হন তৃতীয়।

স্বশিক্ষায় শিক্ষিত

চার্লি চ্যাপলিন একাধারে অভিনেতা, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও সংগীতকার। কিন্তু এসব কোনো কিছুর জন্যই তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি। একাডেমিক শিক্ষা বলতে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যন্ত। এমনকি চেলো, বেহালা ও পিয়ানো বাজানোতে সিদ্ধহস্ত কোনো গুরুর সহায়তা নেননি। তার অভিনীত প্রতিটি ছবির সংগীত রচনা করেছেন নিজে।

পুরস্কার সম্মাননা

চ্যাপলিনের ছবিগুলোর মধ্যে দ্য গোল্ড রাশ, মডার্ন টাইমস, মসিঁয়ে ভারডক্স, দ্য কিড, দ্য গ্রেট ডিকটেটর, দ্য সারকাস, এ ওম্যান অব প্যারিস, এ কিং ইন নিউইয়র্ক, সিটি লাইফ, দ্য পিলগ্রিম অন্যতম। ছবির জন্য দেশ-বিদেশে নানা সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। জীবনে কৃতিত্বের জন্য রানী এলিজাবেথ কর্তৃক নাইট উপাধি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত চার্লির আত্মজীবনী সর্বকালের বেস্ট সেলার হিসেবে বিক্রি হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার তৈরি মূর্তি রয়েছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানজনক ডিগ্রিসহ ফরাসি সরকারের দেওয়া অর্ডার অব দ্য লিজিওন। তিনি বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে গোল্ডেন গ্লোব ও একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসহ অনেক পুরস্কার জিতেন। এ ছাড়া তার ছয়টি চলচ্চিত্র যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস বিশেষভাবে সংগ্রহ করেছে।

চ্যাপলিনের বিয়ে

বিয়ে নিয়ে চার্লি চ্যাপলিনের জীবনে রয়েছে তিক্ত অভিজ্ঞতা। ১৯১৮ সালে মিলড্রেড হ্যারিসকে প্রথম বিয়ে, ১৯২০ সালে ডিভোর্স। এরপর ১৯২৪ সালে পুনরায় বিয়ে করেন ১৬ বছর বয়সী উঠতি অভিনেত্রী লিটা গ্রেকে। এর তিন বছর পরে ১০ লাখ ডলারের সমঝোতায় তাদের ছাড়াছাড়ি হয়। ১৯৩৬ সালে পোলেট গোদাকে বিয়ে করে সংসার করেন ১৯৪২ সাল পর্যন্ত। এরপর জীবনের বাকিটা সময় উনা ও-নিল এর সঙ্গে কাটিয়েছেন চ্যাপলিন। কিন্তু এর মধ্যে ১৯২৭ সালে দ্বিতীয় স্ত্রী ভরণপোষণের জন্য আদালতে মামলা করেন। মামলার রায়ে ১.৬ কোটি ডলার হারিয়ে প্রায় নিঃস্ব হন।

indexমৃত্যু তার পরের ঘটনা

১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বরে সুইজারল্যান্ডের কার্সিয়ারে চ্যাপলিন মারা     যান। ওই দেশের ডিঙ্গিতে চার্লির শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এর পরের বছর চার্লির মৃতদেহ চুরি হয়ে যায়। ১৬ দিন পরে তা উদ্ধার করে আবার সমাহিত করা হয়।

এক নজরে

আসল নাম স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র। জন্ম ১৬ এপ্রিল, ১৮৮৯; মৃত্যু ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৭৭। হলিউড চলচ্চিত্রের প্রথম থেকে মধ্যকালের বিখ্যাত শিল্পীদের একজন। চ্যাপলিন পৃথিবী বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালকও বটে।

চ্যাপলিন জনপ্রিয় হওয়ার কারণ

এমন কী আছে চ্যাপলিনের ছবিগুলোর মধ্যে? কেন ছবিগুলো মানুষকে এত মোহগ্রস্ত করে তোলে? তখনকার দুঃখী মানুষগুলো যেন আশ্রয় খোঁজা শুরু করল চ্যাপলিনের কাছে। চ্যাপলিন নির্বাক ছবি করতেন। যেখানে কোনো কথা ছিল না, ছিল শুধু কিছু তামাশা। সেই তামাশার অতল গভীরে লুকিয়ে থাকে মানুষের জীবনের হাহাকার, রূঢ় বাস্তবতার বিরুদ্ধে মানুষের অবিরাম যুদ্ধ। অনুরাগীদের মতে এটিই চ্যাপলিনকে এত জনপ্রিয় করে তুলেছিল।

যেভাবে অভিনয়ে আসা

মঞ্চে গায়িকা বা নর্তকীর হেরফের হলে তখনকার দর্শকরা চিৎকার-চেঁচামেচি করত। ঘটনার দিন চ্যাপলিনের মায়ের গলার স্বর ভেঙে যায়। তখন অশান্ত পরিবেশ সামাল দিতে বাধ্য হয়ে পাঁচ বছরের চ্যাপলিন মঞ্চে উঠে গান গায়। এতে দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে স্টেজে কয়েন ছুড়তে থাকে। চাপলিন হঠাৎ ভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে বলে ওঠেন, ‘আমি এখন গান গাইব না; আগে পয়সাগুলো কুড়িয়ে নিই। এতেই দর্শকদের মাঝে হাসির রোল পড়ে। এটাই তার প্রথম অভিনয়।favicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment