সফলতার সঙ্গী তানিয়া আমীর

সফলতার সঙ্গী তানিয়া আমীর

  • লিডারশিপ ডেস্ক

চ্যালেঞ্জ নিতে দিতে পছন্দ করেন তিনি স্বপ্ন ছিল ক্যারিয়ার গড়বেন স্থপতি হিসেবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাবার পেশাকেই বেছে নিলেন সফলতা চ্যালেঞ্জ নিয়েই এগিয়ে চলছেন ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর দেশের তুখোড় আইনজীবীদের একজন ইতিমধ্যে দেশের শীর্ষ আদালতে আলোচিত মামলা লড়ে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে যুক্তরাজ্য থেকে এলএলবি অনার্স শেষে ব্যারিস্টার হন বহুমাত্রিক এই ব্যক্তিত্ব আইন পেশার পাশাপাশি সক্রিয় মানবাধিকারকর্মী পরিবেশকর্মী হিসেবে কাজ করছেন নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু অধিকার রক্ষা বিভিন্ন এনজিওতে জাতীয় রাজনীতিতে এখনো না জড়ালেও ভবিষ্যতে করবেন কিনা তার জবাবে বললেন, ‘সময় হলেই জানতে পারবেনজনসাধারণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলা লড়ে তিনি দেশে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশংসিত হয়েছেন


ব্যারিস্টার তানিয়া আমীরের বাবা স্বনামখ্যাত ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ব্যারিস্টার আমীর ব্যক্তিগতভাবে ঘনিষ্ঠ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দিন আহমদের। তার কন্যা তানিয়া আমীর বর্তমানে আমীর অ্যান্ড আমীর ল অ্যাসোসিয়েশনের পার্টনার। তিনি এখন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট। তিনি বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের দ্বৈত নাগরিক। সায়েন্স ও আর্টসের প্রতি তার ভালোলাগা থেকেই স্থপতি হওয়ার ইচ্ছার জন্ম নেয়। তানিয়া আমীর বলেন, ‘কী হতে চাই এ নিয়ে পরিবার থেকে চাপ দেওয়া হতো না। বাবার ব্যস্ততার কারণে তাকে ঠিকমতো পেতামও না। একসময় আর্কিটেকচার পড়ারও শখ ছিল। কারণ সেখানে সায়েন্স ও আর্টসের মিশ্রণ ছিল। শেষ পর্যন্ত আইন পেশার বাইরে যেতে পারলাম না। এখানেও দেখলাম যেমন লজিস্টিক আছে তেমন আর্টিস্টিকও আছে। ’

বাবার খ্যাতি ও সফল পেশা তার মনেও প্রভাব ফেলেছে। তানিয়া আমীর বলেন, ‘আইন পেশায় ক্যারিয়ার গড়ার পর কেউ যদি বলে আপনি আপনার বাবাকে অনুসরণ করেছেন তখন খুব গর্ববোধ করি। ’

Bd-pratidin-20-05-17-SF-03ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর ইনস অব কোর্ট স্কুল অব ল (আইসিএসএল) থেকে সাফল্যের সঙ্গে বার ভোকেশনাল কোর্স সম্পন্ন করার পর আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘দেশের বাইরে পড়াশোনা করেছি। যখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের বিষয় আসে তখন ভাবলাম আইনের ওপর পারিবারিকভাবে একটা দখল যখন আছেই, তখন  অন্য দিকে কেন! এই পেশাতেই নিজের ক্যারিয়ার গড়ি। বিলেতে পড়তে যাওয়ার সময় আমার সংশয়ও ছিল। সবাই তো আর সফল হয় না। ’

ইউনিভার্সিটি অব বাকিংহাম থেকে তিনি এলএলবি (অনার্স) ডিগ্রি অর্জন করেন। এর আগে ‘এ’ লেভেল উত্তীর্ণ হন ঢাকার স্কলাস্টিকা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে, গ্রিন হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে ‘ও’ লেভেল সম্পন্ন করেন। তানিয়া আমীরের স্কুল জীবন শুরু হয় ১৯৭৭ সালে ইউনাইটেড নেশানস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, নিউইয়র্ক থেকে। পড়াশোনার জন্য তাকে শৈশব থেকে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে। ছাত্রাবস্থায় এক্সিকিউটিভ কমিটি অব দ্য স্টুডেন্ট ইউনিয়ন অ্যাট বাকিংহামের সদস্য ছিলেন। সদস্য ছিলেন গ্রেস ইন ডিবেটিং অ্যান্ড মোটিং সোসাইটিরও।

আইন পেশার চ্যালেঞ্জ তিনি নৈপুণ্যের সঙ্গেই সামলেছেন। তার সাফল্য নারী আইনজীবীদের প্রেরণা জোগায়। তার পথচলার প্রেরণা তার পরিবার। তিনি বলেন, ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘বিহাইন্ড এভরি সাকসেসফুল ম্যান, দেয়ার ইজ আ সাকসেসফুল ওমেন। বিহাইন্ড এভরি সাকসেসফুল ওমেন দেয়ার ইজ ওনলি হার স্যাডো। ’ অর্থাৎ একজন পুরুষের উন্নতির পেছনে একজন নারীর অবদান থাকে তবে একজন নারীর পেছনে কেবলমাত্র সেই নারীরই অবদান থাকে। আমি বলি কথাটা যদিও সত্য তবু আমি পরিবারের অনেক সাপোর্ট পেয়েছি। যেসব বাধা এসেছিল সেসব চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেছি।

নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিক থেকেই তিনি কাজ করছেন। নারী আইনজীবী হিসেবে তার কেমন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে? তিনি বলেন, যখন কাজ শুরু করেছিলাম তখন এই পেশায় নারী খুব বেশি ছিলেন না। তখন আমার তো কোনো অসুবিধা হয়নি। বাংলাদেশের আগে বিলেতেও আমি কিছুদিন ছিলাম। সেখানেও বেশিরভাগ ব্যারিস্টার শেতাঙ্গ পুরুষ। তাদের কাছে সংখ্যালঘিষ্ঠ গ্রুপ থেকে আসা নারী হিসেবে কাজ করেছি। আসলে আমার মধ্যে শুরু থেকেই যে কোনো প্রতিকূলতাকে অনুকূলে আনার ব্যাপারটি কাজ করত। আমি বিশ্বাস করি, নিজের দৃঢ়তা থাকলে যে কোনো প্রতিকূলতাকে অনুকূলে আনা সম্ভব। যে কোনো নারীর পক্ষেই তা সম্ভব। ’

আইনপেশার পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন নিয়েও কাজ করছেন তানিয়া আমীর। নারীর অগ্রযাত্রায় সামাজিক বাধা থাকলেও তিনি মনে করেন, নারীকে মর্যাদা ও সমান সুযোগ দিলে তারা সামগ্রিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ করবে। তিনি বলেন, ‘সত্য বলতে কি, পুরো বিশ্বে যত অর্জন তার বেশির ভাগই মেয়েদের। যদি গার্মেন্ট বলেন সেখানেও মেয়েদের জন্য অর্জন। শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস তাও সম্ভব হয়েছে মেয়েদের জন্য। সমাজে পুরুষতান্ত্রিক ভাবনায় টানাপড়েন রয়েছে। সবাইকে এটা বুঝতে হবে, প্রতিটি নারী স্বতন্ত্র। প্রতিটি পরিবারের উচিত যে মেয়েটি তাদের পরিবারে যাচ্ছে তাকে সবাই মানিয়ে নেওয়া। তাকে কোনো ছাঁচে ফেলে নিজের মতো করা সম্ভব নয়। বরং পরিমার্জন সম্ভব। সেখানে আপনারও কিছু পরিবর্তন থাকা উচিত। এটি আপনার সম্মানেরও একটি অংশ। ’

তানিয়া আমীর নিজেকে সফল হিসেবে মানতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘সফলতা আনতে চাইলে আপনি যা চান তা আগে কল্পনা করুন। ভাবুন, হৃদয়ের চোখ দিয়ে দেখুন। দেখবেন অর্ধেক পাওয়া হয়ে গেছে। তারপর আপনার সর্বোচ্চ চেষ্টা সেখানে ব্যয় করুন। নিজের হতাশা নিয়ে বা প্রাপ্তি নিয়ে খুব বেশি অস্থির হওয়ার কিছু নেই। আপনি আনন্দ করুন যতটা আপনার সঙ্গে যায়। আমি নিজেকে সাকসেসফুল ভাবতে পারি না। একটি অর্জনের পর আরেকটি অর্জনের প্রচেষ্টা শুরু হয়। আমি যে অবস্থানে আছি সেখান থেকে আমার চতুর্দিকে ব্যাপ্তি ঘটাতে চাই। ’

বর্তমানে তিনি কনস্টিটিউশনাল কোম্পানি কমার্শিয়াল, ক্রস বর্ডার ট্রান্সজেকশান, বিদেশি বিনিয়োগ কীভাবে বাংলাদেশে আসে বা বাংলাদেশ থেকে কীভাবে বিদেশে যায় এগুলো নিয়ে বেশি কাজ করছেন। তিনি বলেন, অনেকেইে আইনজীবী বলতে আদালত বোঝেন কিন্তু আমি যেহেতু ব্যারিস্টার হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছি তাই বৈদেশিক বিনিয়োগের বিষয়ে কাজ করার প্রতি আগ্রহ বেশি। আমার কাজগুলো প্রাইভেট, পাবলিক এবং ফরেন উভয় সেক্টরে হয়ে থাকে।

১৯৯০ সালে তানিয়া আমীর ইংলিশ বার, গ্রেস ইন এর সদস্যপদ লাভ করেন। একই সময়ে বাংলাদেশ বারে দ্য ফ্যাকাল্টি ইন দ্য বার কাউন্সিলস ইনস্টিটিউট ফর লিগ্যাল এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেইনিংয়ের সদস্য হন। এ ছাড়াও তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ারস, বাংলাদেশ এনভাইরোনমেন্টাল ল ইয়ারস অ্যাসোসিয়েশন, ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশন, সার্ক ল, ইউনিয়ন ইন্টারন্যাশনাল ডিইএস অ্যাডভোকেটস অ্যান্ড স্পন্সর অব বাংলাদেশ চ্যাপ্টার এবং ল এশিয়ার সদস্য। ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর ল অ্যান্ড সোসাইটি ট্রাস্টেরও এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর। তিনি বিভিন্ন সময়ে সরকারের সঙ্গে বৈদেশিক দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে মানবাধিকার এবং অন্যান্য বিষয়ে ক্লাসও নিয়েছেন।

আইনজীবী হিসেবে তার বর্ণিল ক্যারিয়ার অনেকেরই প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। তাদের জন্য বলেন, ‘কেউ ব্যারিস্টার হতে চাইলে অবশ্যই দৃঢ় ও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা করেন তবেই সফলতা আসবে। এই পেশা একটি পিরামিডের মতো। শুরু করেন অনেকেই কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেন খুব অল্প কয়জন। ’

ব্যস্ততায় মোড়ানো তানিয়া আমীরের জীবন। অবসর যেন সোনার হরিণ। তিনি বলেন, ‘কোর্ট বন্ধ থাকলে ছুটি পাই কিন্তু সেই দিনেই মনে হয় বেশি কাজ থাকে। নিজের জন্য সময় দেওয়াটা কমই হয়। মাঝে মাঝে সময় পেলে, মেডিটেশন ইয়োগা করে একান্তে সময় কাটাতে পারি। ’

প্রথম সারির আইনজীবী বলেই তার দিকে মনোযোগ থাকে মিডিয়ার। নিজের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানানসই গেটআপেই তাকে দেখা যায়। তিনি বলেন, নিজের ফ্যাশন নিয়ে খুব বেশি ডেসপারেট নই। প্রত্যেক পেশার একটি নিজস্ব স্টাইল আছে। আমি মনে করি ফ্যাশন আসে যায়। তবে স্টাইল স্থায়ী। আমি কখন কি করছি, কোথায় যাচ্ছি এর ওপর নির্ভর করে পোশাক নির্বাচন করি। শাড়ি পরতে খুব পছন্দ করি। কিন্তু কাজের সময় শাড়ি এড়িয়ে চলি, নইলে কাজের সমস্যা হয়। দুনিয়াটা একটি স্টেজ, সেখানে একেক জন একেক ভূমিকায় অভিনয় করে। তাই অভিনয় অনুযায়ী কসটিউম চেঞ্জ করাটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

Bd-pratidin-20-05-17-SF-04পরিবার প্রসঙ্গে তানিয়া আমীর বলেন, ‘আমি সন্তানদের কোয়ালিটি সময় দিতে চেষ্টা করি। মা সন্তানকে বেশি সময় দিলেও সফলতার সময় ঠিকই বলা হয় বাপ কি বেটি, বা বাপ কি বেটা। অথচ মা সময় দেন বেশি। এখানে সন্তানদেরও কিছু দায়িত্ব থাকে। বাবা মায়ের কাছ থেকে সময় নেওয়ার জন্য। তাদের সান্নিধ্য চাওয়ার জন্য। তা ছাড়া একজন সন্তানও কিন্তু সারাজীবন একই ভূমিকায় থাকছে না। সেও এক সময় হয়ে যায় অভিভাবক। তাই এই চর্চাটি ধরে রাখতে হবে। বাবা মা যখন বয়স্ক হয়ে যাচ্ছেন তাদের সময় দেওয়ার মানসিকতা রাখতে হবে। আমরা কারও না কারও সন্তান আজীবন, কারও না কারও অভিভাবক আজীবন।

ডাল-সবজি খেতে পছন্দ করেন তানিয়া আমীর। তিনি বলেন, পছন্দ অনেক কিছুই কিন্তু সুস্থ থাকার জন্য ডাল সবজি বেশি খাই। তেল চর্বি জাতীয় খাবার খেলেই মনে হয় বেশি এনার্জি পাই। এদেশের মেয়েরা অন্য সবার জন্য যতটা করে নিজের জন্য তার অর্ধেকও করে না। বাধ্যতামূলকভাবে মেয়েদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া উচিত। ভীষণ পড়ুয়া মানুষটির ভালোলাগার কথা জানতে চাইলে বলেন, ‘ননফিকশন ফিকশন সবই পড়ি। বইয়ের গন্ধ নিতে ভালো লাগে। আজকাল কেউ চিঠি লেখে না, দাওয়াতও অনলাইনে হয়, তাই চাই আবার এগুলো ফিরে আসুক। এ ছাড়া সব ধরনের গানই শুনি। বাংলাদেশে আনন্দ উৎসব তো লেগেই থাকে। বাংলা কালচারে আড্ডাটা অন্যতম। আমার মনে হয় এসব দিনের আড্ডাটা স্পেশাল। আর গ্রাম আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু বর্তমানে তো গ্রাম নেই’। তিনি আগামীতে স্বনির্ভর বাংলাদেশ দেখতে চান। তিনি বলেন, ‘আমি চাই স্বনির্ভর বাংলাদেশে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কৃষিকাজ। দেশে সব নাগরিক সমান হবে। আমাদের উন্নয়ন যেন একটি বিষয় ঘিরে না হয়। উন্নয়ন হওয়া চাই সব খাতে সমন্বিতভাবে। আমাদের প্রকৃতি সমাজ ও মানুষের সঙ্গে মিলিয়ে যেন উন্নয়ন হয়। আমরা এমন যেন কিছু করব না, যা আমাদের ক্ষতির কারণ হয়। মায়ের বুক চিরে এমন কিছু আবিষ্কার করতে চাইব না যা আমাদের বিপদে ফেলে দেয়। ’

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিনfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment