ফোর্বসে বাংলাদেশি তরুণ

ফোর্বসে বাংলাদেশি তরুণ

  • লিডারশিপ ডেস্ক

মিজানুর রহমান কিরণ। বিশ্বাস করেন মানবতাই মুক্তির পথ। লড়াই করেন সমাজের সব নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে, প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার আদায়ে। দীর্ঘ বছর ধরে লড়াইয়ে রয়েছেন তিনি। প্রভাবশালী সাময়িকী ফোর্বসের তালিকায় এশিয়ার সেরা ৩০ জন সামাজিক উদ্যোক্তার দুই বাংলাদেশির একজন তিনি।


জন্ম বেড়ে ওঠা

মিজানুর রহমান কিরণের জন্ম বেলচি উপজেলায় ১৯৮৭ সালের ১৬ জুলাই। গ্রামের নাম হরিনাথপুর- বড়বাড়ি। ৬ বছর বয়সে চলে আসেন নওগাঁতে। বেড়ে ওঠা নওগাঁতেই। ভর্তি হন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকেই স্নাতক সম্পন্ন করেন।

স্কুলজীবন থেকেই শুরু

স্কুলজীবন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন মিজানুর রহমান কিরণ। স্কুলের এক সহপাঠী বেতন দিতে না পারায় শিক্ষক তাকে প্রহার করেন। এর ফলে ছেলেটি স্কুলে আসাই বন্ধ করে দেয়। বিষয়টি খুব গভীরভাবে নাড়া দেয় স্কুলপড়ুয়া কিরণকে। তখনই সে স্কুলে অন্য ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে তৈরি করে একটি গরিব ছাত্রদের কল্যাণমূলক সংগঠন ‘ছাত্রছায়া’। এই ছাত্রছায়ায় স্কুলের ছাত্ররা টাকা জমা করত। যখন কোনো গরিব পরিবারের ছাত্র বেতন পরিশোধ করতে পারত না তখন তাকে এই ছাত্রছায়ার ফান্ড থেকে তার বেতন পরিশোধ করা হতো। এভাবে স্কুলজীবন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন মিজানুর রহমান কিরণ।

 আদর্শ যখন ভেলরি টেলর

Bd-pratidin-20-05-17-SF-18মিজানুর রহমান কিরণের আদর্শ বাংলাদেশে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ভেলরি টেলর। তার সঙ্গে প্রথম দেখা হয় জাবির এক সেমিনারে। মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে বসে কথাগুলো বলছিলেন মিজানুর রহমান কিরণ। তিনি বলেন, ইতিহাস বিভাগে বরকত নামে এক শারীরিক প্রতিবন্ধী ছোট ভাই ভর্তি হয়। সে বিকেএসপিতে অ্যাথলেট ছিল। প্র্যাকটিসের সময় মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমি ডিপার্টমেন্টের সিআর ছিলাম। এ কারণে বিভিন্ন সময় বরকত আমার কাছে আসত। এবাবে আমার সঙ্গে ওর একটা সখ্য গড়ে ওঠে। প্রথম ভেলোরি টেলরের নাম আমাকে বলে বরকত। পরবর্তীতে ভেলোরির সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে চাই আমি। সিআরপিতে চলে যাই। ভেলোরি টেলর আমাকে খুবই এপ্রিসিয়েট করেন।  এ নিয়ে নানা অভিজ্ঞতা অর্জন ও শিক্ষা নেওয়ার জন্য ২০১৩ সালে যোগ দেন ব্র্যাকে। ২০১৫ সালে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটসের আমন্ত্রণে এটলাসকোর ফেলো হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে যান। উদ্দেশ্য ছিল— প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ে তাদের প্রক্রিয়াটা আয়ত্ত করা। এ সময় তার সুযোগ হয় হোয়াইট হাউস, বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নামি প্রতিষ্ঠানে দেশের কথা তুলে ধরার।

পিডিএফ

ভেলোরি টেলরের কথায় উৎসাহিত হয়ে প্রথমে তিনি নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন বা পিডিএফ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলেন তিনি। এটি দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও কার্যক্রম শুরু করে। কিরণ বলেন, সংগঠনের ভলান্টিয়াররাই আমাদের সংগঠনের প্রাণ। তাদের আমরা কোনো প্রকার টাকা পয়সা দিচ্ছি না। ওরা নিজেরা খরচ করে এই সংগঠনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এ সংগঠনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৫ হাজারের অধিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিবন্ধীর কল্যাণার্থে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজের সব মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার। এর জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

অনুপ্রেরণা

খুব ছোট থেকেই সামাজিক কাজে সক্রিয় কিরণের অনুপ্রেরণা তার মা। তিনি বলেন, শৈশবের কথা মনে পড়ে এলাকায় খুব বন্যা হতো। আম্মাকে দেখতাম বন্যার সময় অসহায় মানুষের পাশে এগিয়ে যেতে। তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করতে। আম্মার কাছ থেকেই আমার ভিতর এই বিষয়গুলো আসে। মিজানুর রহমান কিরণ একজন দৃষ্টিহীন জীবনসঙ্গী নিয়ে তার পথচলার গল্পও বলেন। সেই গল্পজুড়ে স্ত্রীর প্রশংসা। তিনি ২০১২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী সুরাইয়া আকতার বাবলীকে বিয়ে করেন। নিয়মিত স্ত্রী তাকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি। যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে সবার আগে স্ত্রীর পরামর্শমতোই পদক্ষেপ নেন তিনি। আর সাফল্য তো এখন সবার সামনেই।

পিডিএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মিজানুর রহমান কিরণ বলেন, প্রতিবন্ধী মানুষ বিশ্ব বৈচিত্র্যের একটি ভিন্ন রূপমাত্র। তাদের আলাদা কিংবা অবহেলার চোখে দেখার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। প্রতিবন্ধীবান্ধব ক্যাম্পাসের মতো প্রতিবন্ধীবান্ধব কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করতে হবে। তাই প্রতিবন্ধীদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে কাজ করে যাচ্ছেন মিজানুর রহমান কিরণ ও তার সংগঠন। তিনি বলেন, ডিসঅ্যাবল স্টুডেন্টদের আমরা স্পেশাল স্কিল দেব। কারণ তারা সমাজের উপরের লেভেলের কিংবা চাকরি ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। আমরা সমন্বিত সমাজের কথা চিন্তা করছি। এখানে কাউকে আলাদা করার সুযোগ নেই। অনেক চেষ্টার পর আমরা সফলতা পাই। ভিজুয়াল ইমপ্যাক্টদের ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয় ২০১০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন তারা ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসলে তাদের রিসিভ করে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা।

তিনি আরও বলেন, অনেকেই চান্স পায় তখন দেখা যায় ভর্তি হওয়ার জন্য টাকা নেই। তখন আবার তাদের জন্য স্কলারশিপের ব্যবস্থা করি। তারা যখন এডমিট হয়ে যায়। তখন পড়াগুলো রেকর্ড করতে হয়। প্রতিটা ইউনিভার্সিটিতে হটলাইন নম্বর থাকে। তারা যে কোনো সমস্যায় পড়লে এই নম্বরগুলোতে ফোন দিয়ে সাহায্য চাইতে পারে। তখন আমরা তাদের সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করি। ঢাবি আদিলের সঙ্গে আমাদের তিন চারজন ভলেন্টিয়ার কাজ করে যাচ্ছে।

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিনfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment