‘ভালোবাসা ও ইচ্ছেগুলো গুছিয়ে রাখ, ক্যাম্পাস খুললে ছড়িয়ে দিও’
- অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, অধ্যক্ষ, টংগী সরকারি কলেজ, গত ২৬ আগস্ট, ২০২০, ক্যাম্পাস টিভি কর্তৃক আয়োজিত শিক্ষা বিষয়ক সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান ‘আধুনিক শিক্ষায় সক্রিয় প্রিন্সিপাল’ এ অংশগ্রহণ করেন। ক্যাম্পাস টিভির পক্ষে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমান। সাক্ষাৎকারটি অনুলিখন ও সম্পাদনা করেছেন সাজেদুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, শিক্ষাজীবনের একটা অন্যতম পর্যায় হলো কলেজ। এই সময়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে আন্তঃসম্পর্ক তৈরি হয়। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কলেজগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কেভিড-১৯ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বিশাল প্রভাব সৃষ্টি করেছে। চলমান এই সঙ্কটকালে কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয়দের বিশেষ ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। মানুষ তৈরির নেপথ্য মানুষদের নিয়েই ক্যাম্পাস টিভির আয়োজন আধুনিক শিক্ষায় সক্রিয় প্রিন্সিপাল। আমাদের আজকের অতিথি টংগী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম।
অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম: কোভিড-১৯ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি বড় প্রভাব ফেলেছে। আমরা চেষ্টা করছি আমাদের শিক্ষার্থীদের সাথে সংযুক্ত থাকতে, যাতে আমরা তাদের হালনাগাদ খবরাখবর পাই। তাদের শারীরিক-মানসিক সকল ধরনের খবরাখবর রাখতে চেষ্টা করছি আমরা, যাতে তারা চলমান পরিস্থিতিতে ভেঙ্গে না পড়ে। সারাদেশে অনলাইন কার্যক্রম জোরেশোরে চালু না হলেও এপ্রিলের ১২/১৩ তারিখের দিকে আমরা অনলাইনে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করেছি। আমাদের ক্লাস নেওয়ার পদ্ধতিও একটু আলাদা। শিক্ষার্থীদের পরিবেশ, তাদের তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক সক্ষমতা ও আর্থিক দিক বিবেচনা করে প্রথম দিকে পাঠসংক্রান্ত ১০ মিনিটের ভিডিও শিক্ষার্থীদের কাছে মুঠোফোনের মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছেন শিক্ষকগণ। এই পদ্ধতিটি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংযুক্তিতে সেতু হিসেবে কাজ করেছে। আমরা দেখেছি, ঘরে থাকতে থাকতে শিক্ষার্থীরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের চোখে হতাশা দেখেছি, অবসাদ দেখেছি, তাদের কোনো নিকট আত্মীয় কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলে তাদের বিপর্যস্ত হতে দেখেছি। ভবিষ্যতের কথা ভেবেও তারা চিন্তিত। তখন আমরা মোটিভেশনের মাধ্যমে চেষ্টা করেছি তাদের মনোবল ধরে রাখতে। উৎসাহিত করেছি সৃজনশীল কাজে।
১০ মিনিট দৈর্ঘ্যরে যেসকল ভিডিও শিক্ষার্থীদের দেওয়া হতো সেসবের কন্টেন্ট কেমন ছিল সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা ভিডিও কন্টেন্টগুলোতে অনুপ্রেরণাদায়ক নানান বিষয় সংযুক্ত করেছি, যাতে তারা এই সময়ে ভালো কাজে উজ্জীবিত হতে পারে। তাদেরকে বলেছি, ঘরবন্দি থেকে বিরক্ত না হয়ে গান করতে, ছবি আঁকাতে, পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বাবা-মায়ের কাজে সহায়তা করতে বা জানালা দিয়ে হলেও আকাশ দেখতে। শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাস, বন্ধুবান্ধব ও প্রিয় শিক্ষকের ক্লাস মিস করে। তাদের বুঝাতে চেষ্টা করেছি, তারা যেন তাদের ভালোবাসা ও ইচ্ছেগুলোকে যত্ন করে রেখে দেয় এবং ক্যাম্পাস খুললে সেসব ভালোবাসা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়। আমরা চেষ্টা করছি, তারা যেন কোনোভাবেই হতাশ না হয়ে পড়ে। তারা যেন সচেতন থাকে সে চেষ্টাও করছি আমরা। আমাদের একটি কাউন্সেলিং কমিটি আছে, নতুন নতুন ভাবনাযোগে কীভাবে শিক্ষার্থীদের আরো সক্রিয় রাখা যায়, কমিটি সেই কাজ করছে। আমরা স্বস্তি পাই যখন দেখি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনলাইন কার্যক্রমে বেশি শিক্ষার্থী যুক্ত আছেন। অনলাইনে কিছু ইনকোর্স পরীক্ষাও নিয়েছি আমরা, সেখানে দেখেছি, ৮০ ভাগেরও বেশি শিক্ষার্থী অনলাইন পরীক্ষায় যুক্ত হয়েছেন।
দুঃখজনক চিত্রও আছে, কিছুদিন আগে উপবৃত্তি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে প্রায় ৮০ জন শিক্ষার্থী আমার কাছে এলে আমি তাদের থেকে একটি ফিডব্যাক নেয়ার চেষ্টা করি। অনেক শিক্ষার্থী রয়েছেন যাদের কোনো স্মার্টফোন বা ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস নেই যা দিয়ে সে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমে অংশ নিতে পারে। অনেক পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের মানুষ টংগী শিল্প এলাকায় কাজ করে এবং তাদের তেমন আর্থিক সচ্ছলতা নেই। এসব কথাও ভাবনায় রাখতে হয়। অন্যদিকে পদার্থ বা রসায়ন শাস্ত্রের ব্যবহারিক ক্লাস অনলাইনে নেওয়া কষ্টসাধ্য বিষয়। একসাথে সবাইকে ক্লাসরুমে না এনে ২০ জন বা কলেজের আশেপাশে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে এসে সেই কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা ভাবছি আমরা। এবিষয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দৃিষ্ট আকর্ষণ করছি। যতই বলি ঘরে থাকো কিন্তু কতক্ষণ ঘরবন্দি থাকা যায়, বেড়িয়ে আসার প্রয়োজন হয়, আলো-বাতাস গ্রহণের প্রয়োজন হয়। আমরা যদি সপ্তাহে অন্তত একদিন তাদের নিয়ে আসতে পারি, তবে তারা যেমন একদিকে শিখবে, অন্যদিকে বিরক্তি কাটবে, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়েও নেবে। সমাজবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এই সময়ে স্কুল-কলেজ যেভাবে বন্ধ থাকছে এভাবে যদি বেশিদিন বন্ধ থাকে তবে শিক্ষাব্যবস্থা এতটা বিপর্যস্ত হবে যে তা প্রায় কোভিড-১৯ এর ক্ষতির সমান।
করোনাভাইরাসের প্রভাব চলে গেলে অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সরকারি কলেজের এই অধ্যক্ষ বলেন, এই শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত নয়। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য শুধু পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখা নয় বরং সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে শেখাই হলো শিক্ষা। মনে করুন আমি একজন কর্মী, আমি কি পারবো কাজ ছেড়ে ঘরে বসে থাকতে? নিশ্চয়ই পারবো না। এর আগেও পৃথিবীতে অনেক বিপর্যয় এসেছে, সেখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আমাদের একেকটা ক্লাসের ছাত্র সংখ্যা দুই শতাধিক। তাদেরকে ডেকে এনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস নিবো সেটি সম্ভব নয়। নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনলাইন ক্লাসই এখন ভালো বিকল্প। রাজশাহী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের একটি উক্তির দিকে আলোকপাত করেন। তিনি বলেছেন, অনলাইন ক্লাসের একটি দিক হলো শিক্ষকদের আইটি জ্ঞান। অনেকে এমন আছেন যারা সামনে বসে ভালোই পড়াতেন কিন্তু অনলাইনে তেমন সুবিধা করতে পারছেন না। অন্যদিকে কেউ কেউ রয়েছেন সামনে বসে ভালোভাবে পড়াতে না পারলেও অনলাইনে ভালো করছেন। আমরা শপিং থেকে শুরু করে বাজার-সদাই, চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াসহ অনেককিছুই অনলাইনে করতে পারলে শিক্ষায় বাধা কোথায়?
সঞ্চালক সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, আমরা শিক্ষকরা পূর্বে শুধুই ছাত্রদের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম কিন্তু অনলাইন ব্যবস্থায় অনেক অভিভাবকও যুক্ত হচ্ছেন আমাদের সঙ্গে। তারা তাদের মতামত দিচ্ছেন, অনুভূতি শেয়ার করছে যা আসলেই অনেক আনন্দের বিষয়। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম বিএলসি, সেখানেই আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন আমাদের শিক্ষার্থীদের কাছে বিএলসি-ই অনলাইন ক্যাম্পাস। যারা এখনো স্কুলের গন্ডিতে আছে তারা টেকনোলজির ছোঁয়ায় নিজেদের আরো স্মার্ট করে তুলছে, তারা স্মার্ট হয়েই আমাদের মাঝে আসবে, হয়তো আমাদের চেয়েও বেশি স্মার্ট হয়ে, সেই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
উত্তরে অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, এটা মেনে নিয়ে আমাদের চলতে হবে কারণ আমরা যারা একটু আগের মানুষ বা যারা পড়াশুনায় প্রযুক্তিবিদ্যা ততটা পাইনি, সেখানে আমরা আমাদের ছাত্রদের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছি। আমাদের নবীন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইটি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান-দক্ষতা রয়েছে। আমাদেরও উচিত আইটি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। আলোচনার শেষে এসে তিনি বলেন, মানুষের হৃদয়ে সৌন্দর্য চর্চার জন্য একটি আলাদা জায়গা থাকে। সৌন্দর্য চর্চার অর্থ এই নয় যে, সৌন্দর্য চর্চাকারী ব্যক্তির চেহারা সুন্দর হতে হবে, এই সৌন্দর্য মানে কোনো কিছুর প্রতি অন্যকে আকৃষ্ট করা। এখানে শিক্ষকদেরকেও এমনভাবে পাঠ্যবিষয়কে উপস্থাপন করতে হবে যাতে করে শিক্ষার্থীরা আকৃষ্ট হয়। অনেক শিক্ষক রয়েছেন যারা শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত রাখতে আন্তরিক চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ভালোবাসা ও বন্ডিং বাড়িয়ে তোলেন। শুধু টেকনোলজির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিলেই চলবে না, শিক্ষার্থীদেরকে ক্লাসের ভেতরে যুক্ত রাখার দক্ষতাও নিজের ভেতরে বাড়িয়ে তুলতে হবে।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: ক্যাম্পাস টিভিতে সংযুক্ত হয়ে আলোচনায় অংশ নেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।