‘শ্রেণিকক্ষ হোক মনন বিকাশ কেন্দ্র’

‘শ্রেণিকক্ষ হোক মনন বিকাশ কেন্দ্র’

  • অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, অধ্যক্ষ, রাজশাহী কলেজ, গত ২৮ আগস্ট, ২০২০ ক্যাম্পাস টিভি কর্তৃক আয়োজিত শিক্ষা বিষয়ক সাক্ষাৎকারভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠান ‘আধুনিক শিক্ষায় সক্রিয় প্রিন্সিপাল’ এ অংশগ্রহণ করেন। ক্যাম্পাস টিভির পক্ষে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টস’ অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমান। সাক্ষাৎকারটি অনুলিখন ও সম্পাদনা করেছেন সাজেদুল ইসলাম

সৈয়দ মিজানুর রহমান: আসসালামু আলাইকুম, আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি ক্যাম্পাস টিভির বিশেষ আয়োজন আধুনিক শিক্ষায় সক্রিয় প্রিন্সিপাল অনুষ্ঠানে। আমাদের সঙ্গে আজ  রয়েছেন একজন স্বনামধন্য অধ্যক্ষ, বহু অধ্যক্ষের আদর্শ ও পথপ্রদর্শক। রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান। আমাদের দেশে এমন কিছু কলেজ রয়েছে যে কলেজগুলো তাদের কার্যক্রম ও স্বকীয়তার দিক থেকে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কেও ছাড়িয়ে যায়। রাজশাহী কলেজ সেসকল কলেজের তালিকার অন্যতম শীর্ষে রয়েছে। রাজশাহী কলেজ আমাদের বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম নামি প্রতিষ্ঠান। আমাদের গর্ব। রাজশাহী কলেজ ভালো কাজের জন্য পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে অনেকবার। শিক্ষা মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে, আর শিক্ষায় যদি ইনোভেশন থাকে এবং অধ্যাপক মোঃ হাবিবুর রহমানের মত অধ্যক্ষ থাকেন, তখন সেই প্রতিষ্ঠান মানুষের নজর কাড়বেই। আজকে আমরা আনন্দিত ক্যাম্পাস টিভিতে অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে অতিথি হিসেবে পেয়ে। ক্যাম্পাস টিভিতে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

সৈয়দ মিজানুর রহমান: রাজশাহী কলেজ নিয়ে আপনার স্বপ্ন রয়েছে, অনেক কিছু করছেন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য, সামনে অনেক কিছু করবেন বলেও সকলের আশা রয়েছে। আপনি যদি আমাদের একটু অনুপ্রাণিত করেন যে, একজন অধ্যক্ষ চাইলে একটি কলেজকে কতদূর নিয়ে যেতে পারেন? আরো বড় পরিসরে বললে, একটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব সম্পর্কে আপনার কাছে জানতে চাই।

অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান: শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, যেকোনো সংগঠন প্রধানের দায়িত্বে যিনি থাকবেন তাঁর ইচ্ছাশক্তি ভালো কাজের নেপথ্যে মুখ্য ভূমিকা রাখে। নানা স্তরে সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সীমাবদ্ধতাকে জয় করে কোনো কিছু করা আনন্দের বিষয়। কাজের ক্ষেত্রে আমাকে স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য আলী রেজা মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ স্যারকে ধন্যবাদ দিতে চাই। ২০১৪ সালের আগস্ট মাস থেকে রাজশাহী কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে আমি দায়িত্ব পালন শুরু করি। আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে চার দেয়ালের মাঝে সীমাবদ্ধ না থেকে ছড়িয়ে পড়া শিখতে হবে। প্রকৃতি, পরিবেশ, দেশ ও বিশ্বটাকে পাঠশালা বানাতে হবে। সুনাগরিক হতে হলে সৃজনশীল, মননশীল ও ন্যয়নিষ্ঠ হওয়ার বিকল্প নেই। আমি আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য এমন একটি একটি পরিবেশ, এমন একটি শ্রেণিকক্ষ তৈরি করতে চেয়েছি, যেখানে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক আচরণের বিকাশ হবে, বিকাশ ঘটবে মননেরও। ২০২২ সালে রাজশাহী কলেজের ১৫০ বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। রাজশাহী কলেজে অবিভক্ত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা থেকে শিক্ষার্থীরা আসতো। প্রেসিডেন্সি কলেজের সমসাময়িক আমাদের এই প্রতিষ্ঠান। এই কলেজে শুরু থেকেই অনার্স ও মাস্টার্স চালু ছিল।

সৈয়দ মিজানুর রহমান: আপনার শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রীরা গতানুগতিক ধারায় একজনের পেছনে আরেকজন না বসে তারা দলগতভাবে বসে শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে। এই পরিবর্তন কীভাবে এলো?

অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান: এভাবে শ্রেণিকক্ষে কার্যক্রম চললে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে দলগত কাজে খুব সহজে অংশ নিতে পারে। শিক্ষকের সঙ্গেও তারা ভালোভাবে ভাবের আদান-প্রদান করতে পারে। এসব সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে আমরা একটি গোলাকার টেবিলে পাঁচ বা ছয়জনের আসনের ব্যবস্থা করেছি। আমরা চেষ্টা করছি প্রতি টেবিলে একটি করে ল্যাপটপের বন্দোবস্ত করতে, যাতে তারা শ্রেণিকক্ষে প্রযুক্তিগত সুবিধা পেতে পারে।

সৈয়দ মিজানুর রহমান: করোনাকালীন সময়ে আপনি কীভাবে কলেজের কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছেন?

অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান: ২০১১ সালে, যখন অনেক প্রতিষ্ঠান মান্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের কথা চিন্তাও করেনি আমরা তখন কলেজের প্রতিটি ক্লাসরুমকে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে রূপান্তর করি। শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। আমরা আগে থেকেই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসে অভ্যস্ত বলে করোনাকালে তেমন অসুবিধা পোহাতে হয়নি। প্রথমে অনার্সের ক্লাস অনলাইনে নেয়া শুরু করি, কিছুদিন পরে আমরা উচ্চমাধ্যমিকের ক্লাসও অনলাইনে নিয়ে আসি। এক্ষেত্রে নেপথ্য নায়ক ছিল আমাদের আমাদের ইচ্ছাশক্তি। যেসকল শিক্ষক বাসায় থেকে অনলাইনে ক্লাস নিয়েছেন তাদের আমরা নানাভাবে সহযোগিতা দিয়েছি। এছাড়াও কলেজ থেকে অনলাইন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দুটি মানসম্মত স্টুডিও তৈরি করেছি। আমাদের শিক্ষকবৃন্দ সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টার মধ্যে যেকোনো সময়ে ক্লাস রেকর্ড করার স্পেস পেয়েছেন।

সৈয়দ মিজানুর রহমান: করোনার শুরু থেকে যখন আমরা অনলাইন কার্যক্রম শুরু করি তখন অনেকেই অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান: Education in anywhere, anytime’-এটি আধুনিক শিক্ষার একটি থিম। আগে থেকেই অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। হয়তো দশ-বারো বছর পরে হতো। কিন্তু করোনাকাল সেই সময়টিকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে। শিক্ষাকে যদি আমরা প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করতে না পারি তবে শিক্ষা এগিয়ে যাবে না। ডিজিটাল বাংলাদেশে আমরা প্রযুক্তির ব্যবহার করবো এটিই স্বাভাবিক। আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা হয়তো আছে, থাকবে। যদি আজ আমাদের এই কার্যক্রম চালু না হতো তবে আমরা জানতে পারতাম না, কোথায় আমাদের ঘাটতি রয়েছে। আমাদের শিক্ষার্থীর ডিজিটাল ডিভাইস নেই বা কোন শিক্ষার্থীর ইন্টারনেট কানেকশনে জটিলতা রয়েছে এসব আমরা জানতে পেরেছি। আমার মনে হয়, আমরা একটি সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করতে পেরেছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরিতে আমাদের কোথায় কোথায় সম্ভাবনা রয়েছে, কোথায় কোথায় আমাদের অবস্থার উন্নতি করা প্রয়োজন সেই নির্দেশনা আমরা এই করোনাকালে পেয়েছি।

সৈয়দ মিজানুর রহমান: করোনাকালীন এই সময়ে আমরা আমাদের কিছু সীমাবন্ধতা সম্পর্কে জেনেছি। সমাধান সম্পর্কে বলুন।

অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান: শিক্ষা আমাদের বাহন, আমাদের চালিকাশক্তি। এই মুহূর্তে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে আমাদের কিছু ব্যয় করতে হবে। এক সমীক্ষায় দেখছি, আমাদের ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন কার্যক্রম থেকে বিছিন্ন। তাদেরকে অনলাইন কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসা আমাদেরই দায়িত্ব। এখন যেহেতু সশরীরে শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ, আমাদের অর্থ খরচ কমে গেছে। সেই অর্থ আমাদের যেসকল শিক্ষার্থী আর্থিক টানাপোড়েনে আছে তাদের জন্য ব্যয় করতে পারি আমরা। সরকারি বরাদ্দের দিকে চেয়ে না থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতার স্কোপ রয়েছে।

সৈয়দ মিজানুর রহমান: অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের হতাশা এবং সম্ভাবনাকে কীভাবে ব্যাল্যান্স করছেন?

অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান: আমরা মোটেই হতাশার মধ্যে নেই। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় তিন লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে দিয়েছি আমরা। উচ্চমাধ্যমিক, অনার্স ৩য়, ৪র্থ বর্ষ ও মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের এই অর্থ দিয়ে ডিভাইস ও ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। দীর্ঘসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থীদের মনে বিষন্নতা তৈরি হবে, তারা হতাশায় ভুগবে। আমরা চাইছি, শিক্ষার্থীরা আমাদের  সঙ্গে যুক্ত থাকুক, তাদেরকে আমরা হয়তো পুরোটা দিতে পারছি না, কিন্তু আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।

সৈয়দ মিজানুর রহমান: নয়া স্বাভাবিক পরিস্থিতি এলে আমরা কি প্রযুক্তিকে বাদ দিবো?

অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান: এই যে আমি আপনার সঙ্গে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কথা বলে যাচ্ছি এটি হয়তো আজ থেকে ১০ বছর আগে আমরা ভাবতে পারিনি। এই অনলাইন কার্যক্রম যদি আরও ৫ বছর পরে শুরু হতো তবে আমরা অনেক পিছিয়ে যেতাম। আপনি যখন অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন তখন গোটা পৃথিবী থেকে আপনাকে দেখা যাচ্ছে। পুরো পৃথিবী আপনার সঙ্গে সংযুক্ত। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের দক্ষতাও বাড়ছে।

সৈয়দ মিজানুর রহমান: ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।

অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান: তোমাদের থেকে দূরে থাকলেও আমাদের আত্মার বাঁধন কিন্তু তোমাদের সঙ্গে রয়েছে। আমরা একান্ত অবিভাবক বা আপনজন হিসেবে তোমাদের কথা ভাবছি। হয়তো আমাদের সীমাবদ্ধতার জন্য আমরা পুরোটা পারছি না, তবে চেষ্টা করছি। এই সময়ে বাসায় থাকবে, সুন্দর থাকবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে। পরম করুনাময়ের কৃপায় সুসময় ফিরে এলে তোমাদের পদচারণায় আবারও মুখর হবে ক্যাম্পাস।

সৈয়দ মিজানুর রহমান: আলোচনায় অংশ নেবার জন্য ক্যাম্পাস টিভি ও ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।

অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান: আপনাকে ধন্যবাদ। ক্যাম্পাস টিভি ও ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়কেও ধন্যবাদ।

Sharing is caring!

Leave a Comment