‘সব ব্যবসাই বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে’
- লিডারশিপ ডেস্ক
আজিজা খাইরুন বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন–ভিত্তিক অর্গানিক খাদ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘ফুড শেলফ’-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তার চার ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। খুলনার একটি উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা আজিজা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে অনার্স করছেন। তিনি ‘Volunteer for Bangladesh (VBD)’-এর একজন সক্রিয় সদস্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন সময়ে তার ’ফুড শেলফ’ এর যাত্রা শুরু হয়। এখন ‘ফুড শেলফ’ সারা বাংলাদেশে বিশেষত খাদ্য পণ্য সরবরাহ করে। তার বেশিরভাগ ক্রেতা নারী। প্রথমে ‘ফুড শেলফ’ কেবল ২টি পণ্য সরবরাহ করতো, আর এখন তাদের পণ্য রয়েছে ৩৮টি। আজিজার এ উদ্যোগের বিস্তারিত তার কাছ থেকেই শোনা যাক।
‘ফুড শেলফ’-এর আইডিয়া কীভাবে আপনার মাথায় এল ?
২০০৭ সালে আমি ফেইসবুক ব্যবহার শুরু করি। সে সময় আমি বিভিন্ন গ্রুপের সদস্য ছিলাম যারা নারীদের বিভিন্ন প্রয়োজনের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করছিল। সেখানে আমি অনেক আপুর সঙ্গে পরিচিত হই, তারা আমাকে তাদের নেটওয়ার্কে যুক্ত করে নেন। এভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নারীদের সাথে আমি একটি শক্তিশালি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলাম।একদিন চট্টগ্রামের এক আপু আমাকে বললেন, তাকে কিছু মধু সরবরাহ করতে পারব কি না। কারণ তিনি জানতেন আমি খুলনায় থাকি। সে সময় আমার মামা মধু সরবরাহের ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এখনও তিনি সে কাজ করেন। আমি মামার সাহায্যে চট্টগ্রামে সে আপুর কাছে বেশ ভাল পরিমাণ মধু সরবরাহ করি। এরপর সে আপু আরেকটি অর্ডার দেন। আমি সেটাও সরবরাহ করি। এটাই আমাকে নিজের একটা ব্যবসায় শুরু করতে উৎসাহ যোগায় এবং ‘ফুড শেলফ’ এর শুরু এভাবেই।
আপনি কীভাবে ফুড শেলফ পরিচালনা করেন?
ফুড শেলফ সারা বাংলাদেশে দেশীয় খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করে। আমাদের যৌথ পরিবার এ খাদ্য তৈরির সাথে জড়িত। সুতরাং আমি যেটা করি তা হল আমার ফেইসবুক পেইজের মাধ্যমে আমি কাস্টমারদের কাছ থেকে অর্ডার সংগ্রহ করি এবং অর্ডার অনুযায়ী আমার পারিবারিক যোগাযোগ ব্যবহার করে সবচেয়ে ভাল পণ্যগুলো সংগ্রহ করি এবং কুরিয়ারের মাধ্যমে তা সরবরাহ করি।
আপনি ছাড়া ফুড শেলফ–এর সাথে কি আরও কেউ জড়িত আছেন?
মহিলা সমিতি থেকে দুইজন নারী প্যাকেজিংয়ে আমাকে সহায়তা করার জন্য। আমি অনেক সময় খুলনার অভ্যন্তরে সরবরাহকারী ভাড়াও করে থাকি। যেমনটা আমি আগে বলেছি, আমি পণ্যগুলো আমার নিজের পরিবারের প্রোডাকশন ফার্ম থেকে সংগ্রহ করি। কিন্তু অনলাইনের বিষয়টা আমি নিজেই দেখাশোনা করি।
‘ফুড শেলফ’ শুরু করার পিছনে আপনার প্রেরণা কী ছিল?
যদিও আমি কখনোই আর্থিক অনটনের মুখোমুখি হই নি। আমি আমার বাবা–মার কাছ থেকে হাত–খরচ পেতাম। তারপরও আমি কখনোই চাই নি যে আমার দৈনিক ব্যয়ের বোঝা আমার পরিবারের ওপর করুক। আমি সবসময় চেষ্টা করেছি নিজের খরচের অর্থ নিজেই উপার্জন করতে। আমি কিছু ফ্রীল্যান্সিং এবং কনটেন্ট রাইটিং–এর কাজে জড়িত ছিলাম। ঐ ধরণের কাজে সবসময় একটা চাপ বা ডেডলাইন থাকে। আমি স্বাধীনভাবে কিছু করতে চাইতাম। এমন কিছু যা আমি আমার সুবিধামত নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। তাই আমি এই ব্যবসায়ের সুযোগটা নিলাম। যেহেতু আমার পরিবারের ব্যাকআপ ছিল এবং আমার ইন্টারনেট সুবিধা আছে, তাই ‘ফুড শেলফ’-এর আইডিয়াটা আমার জন্য নিখুঁত ও মানানসই ছিল।
‘ফুড শেলফ’-এর জনপ্রিয় পণ্যগুলো কী কী?
‘ফুড শেলফ’-এ শুধু বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাদ্যদ্রব্যই নয়, বরং সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত দেশীয় উপাদানও অন্তর্ভুক্ত আছে। জনপ্রিয় পণ্যগুলো হল:
মধু
সরিষা
নারিকেল তেল
বাদাম তেল
চন্দন
আতপ চাল
বেসন
হলুদ
ত্রিফলা গুঁড়া
বেসন গুঁড়া
‘ফুড শেলফ’-এর পণ্যগুলোর অনন্য বৈশিষ্ট্য কী?
‘ফুড শেলফ’ একটি স্বাস্থ্যবান এবং সুন্দর আগামীর জন্য কাজ করে। সকল পণ্য প্রাকৃতিক, বিশুদ্ধ এবং ফুড শেলফ–এর নিজস্ব তত্ত্বাবধানে তৈরি। সকল পণ্য গুণে মানে অনন্য একইসঙ্গে ভেজালমুক্ত।
‘ফুড শেলফ’ চালাতে গিয়ে আপনি কি ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন?
ত্রুটিপূর্ণ সরবরাহ ব্যবস্থা ফুড শেলফ চালানোর ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ। কুরিয়ার সার্ভিস পেশাদারি সেবা দেয় না। যখন তারা আপনার পণ্য হারিয়ে ফেলে কিংবা ভুল করে অন্য মানুষের কাছে পৌঁছায় তখন প্রায়ই ক্ষতিপূরণ দেয় না। আমাদের কুরিয়ারের যাচ্ছেতাই ব্যবস্থা। ফুড শেলফ–এর সাথে এমন হয়েছে যে কুরিয়ার সময়মত পণ্য পৌঁছায়নি কিংবা ভুল করে অন্য ব্যক্তির কাছে পৌঁছিয়েছে। এছাড়াও পণ্য হারিয়ে যাওয়া, চুরি হওয়া ইত্যাদি সমস্যায় পড়তে হয়েছে। যেহেতু আমি আমার পণ্য সংরক্ষণে কোন প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করি না, তাই কুরিয়ার সার্ভিসের বিলম্বের কারণে পণ্য পচে যায়। আমাকে এই সব ধরণের ক্ষতির বোঝা বহন করতে হয় যেহেতু কাস্টমাররা আমাকে অগ্রিম পেমেন্ট দেয়, আমি তাদেরকে সরবরাহ করতে বাধ্য।কাস্টমারদের কাছ থেকে প্রতারণার কিছু ঘটনাও ছিল। কিন্তু আমার বেশিরভাগ কাস্টমারই সৎ, আন্তরিক। তাই আমি এটাকে বড় কোন ব্যাপার হিসেবে নেই না।
নারী উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে আপনি কোন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়েছেন?
দুর্ভাগ্যবশত, হ্যাঁ হয়েছি। বাংলাদেশে কিছু অসুস্থ মানসিকতার মানুষ আছে যারা কোনো কারণ ছাড়াই নারীদের পথে বাধা সৃষ্টি করে। মাঝে মাঝে আমি কিছু বিরক্তিকর কল ও অভদ্র ফেইসবুক ম্যাসেজ পাই। যা আমাকে কষ্ট দেয়।
আপনার ব্যবসায়ের জন্য সবচেয়ে বড় কোন ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন?
একবার এক ভদ্র মহিলা অগ্রিম টাকা না দিয়ে বেশ ভাল পরিমাণ পণ্য পাওয়ার জন্য আমার সাহায্য চেয়েছিলেন। পারিবারিক ইস্যুতে তিনি সমস্যায় ছিলেন। তাই তিনি নিজে কিছু করতে চেয়েছিলেন। তার এলাকায় পুণ্য বিক্রয় করার জন্য পণ্য অর্ডার করেছিলেন যেহেতু তার জীবনধারণের জন্য তার কিছু করার প্রয়োজন ছিল। ফুড শেলফ–এর বিশাল কোন মূলধন ছিল না। আমি খুব হালকাভাবে এটা চালাই। তাই এত বিশাল পরিমাণ পণ্য ধার হিসেবে দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ ছিল না। কিন্তু আমি ঝুঁকি নিয়েছিলাম। উনাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমি সফল হই। উনি অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো পেমেন্ট পরিশোধ করে দেন। তিনি খুবই কৃতজ্ঞ হয়েছিলেন। আমি তার জন্য অনেক খুশি হয়েছিলাম।
এখন পর্যন্ত আপনার পাওয়া সবচেয়ে বড় প্রশংসা কী ছিল?
প্রিমিয়াম পণ্যগুলোর জন্য আমি আমার ফেইসবুক পেইজে প্রতিদিনই অনেক প্রশংসা পাই। একবার এক আপু আমাকে “আলাদিনের চেরাগ” উপাধি দিয়েছিলেন কারণ আমি তার চাওয়া সবগুলো পণ্য সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। এটাই ছিল আমার পাওয়া সবচেয়ে বড় প্রশংসা। এছাড়া, এক কাস্টমারের বয়স্ক মা আমাকে কল করে বলেছিলেন যে ফুড শেলফ–এর নারিকেল তেল এতই বিশুদ্ধ যে এর ঘ্রাণ তাকে তার মায়ের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। তিনি ভাবতেন এই ধরণের বিশুদ্ধ পণ্য যুগ যুগ আগেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি যে তিনি এই ধরণের পণ্য আবারও দেখতে পারবেন। এই কথা শুনে আমি সত্যিই গর্ববোধ করছিলাম।
ফুড শেলফ নিয়ে কোন দুঃখ আছে? কিংবা এমন কিছু যা আপনাকে যদি আরেকবার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে ভিন্নভাবে করতেন?
আমার কোন দুঃখ নেই। তবে একটা ঘটনা আছে যা আমার মনে হয় আমি যদি ভিন্নভাবে করতে পারতাম। একবার এক কাস্টমার তার মায়ের জন্য ‘কালিজিরা তেল’ অর্ডার করতে চেয়েছিলেন, যিনি ছিলেন ক্যান্সারে আক্রান্ত। সে সময় ফুড শেলফ ঐ পণ্য বিক্রি করত না। তাই যত দ্রুত সম্ভব আমি ঐ পণ্য সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করলাম এবং কাস্টমারকে তা পৌঁছানর জন্য কল করলাম। কিন্তু তিনি জানালেন যে তার মা ইতোমধ্যেই মারা গিয়েছেন। আমার আসলেই খারাপ লেগেছিল। যদিও তার মৃত্যুর সাথে আমার পণ্যের কোন সম্পর্ক নেই কিন্তু আমার মনে হয়েছিল আমি যদি আরও আগে সংগ্রহ করতে পারতাম।
ফুড শেলফ–এর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
আমি দেশে আমার নিজের ফার্ম প্রতিষ্ঠা করতে চাই। কৃষিকাজে আমার ব্যাপক আগ্রহ আছে। এখন পণ্য পাওয়ার জন্য আমাকে আমার যৌথ পরিবারের খাদ্য উৎপাদনের উপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু ভবিষ্যতে আমি আমার নিজের ফার্ম থেকে পণ্য উৎপাদন করতে চাই এবং নিজস্ব সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। এছাড়া আমি আমার ব্যবসায়কে ফেইসবুক থেকে একটি ই–কমার্স ওয়েবসাইটে বর্ধিত করতে চাই। কিছু আইনি জটিলতার কারণে এই মুহূর্তে আমি তা করতে পারছি না।
নিজের সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন।
আমি কেন খাদ্য ব্যবসায় চালাচ্ছি তার একটা কারণ হলো, আমি খুবই ভোজন রসিক একজন মানুষ। অবসরে আমি রান্না করতে, কবিতা আবৃত্তি করতে, সৃষ্টিশীল লেখালেখি করতে এবং সন্তানদের সাথে সময় কাটাতে ভালবাসি। আমার ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত একটি স্বেচ্ছাসেবী স্কুল ছায়াবৃত্তে আমি শিক্ষক হিসেবে স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়ে থাকি। এটি হল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং তার আশেপাশের এলাকায় বসবাসকারী সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য। যদিও আমার মনে হয় আমি একজন অলস ব্যক্তি! যেকোনো কাজে আমি সবসময় শর্টকাট খুঁজি। তাই ‘আমি কঠিন কাজ করার জন্য একজন অলস ব্যক্তিকে বাছাই করি। কারণ একজন অলস ব্যক্তি সেই কাজটি করার জন্য একটি সহজ পথ খুঁজে বের করে’ – বিল গেটস–এর এই উক্তিটি আমার জন্য খুবই উপযুক্ত!
আপনার পরিবার আপনার ব্যবসায় সম্পর্কে কী মনে করে? আপনি যা করছেন তাতে কি আপনার পরিবারের সমর্থন আছে?
আমার পরিবার খুবই ইতিবাচক। আমার মা–বাবা আমার কাজে গর্বিত। সংকটের সময়ে তারা আমাকে সাহায্য করেছে। আমি এতে উৎসাহিত হয়েছি। আমি আমার যৌথ পরিবার যেমন মামা–চাচাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তাদের সাহায্য ছাড়া ‘ফুড শেলফ’-প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব ছিল।
ভবিষ্যৎ উদ্যোক্তাদের জন্য কোন উপদেশ?
প্রায় সমস্ত ব্যবসায় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকে। ভবিষ্যৎ উদ্যোক্তাদের জন্য আমার উপদেশ– মানুষকে বিশ্বাস করুন এবং নিজে বিশ্বস্ত হোন।