যে নির্বাহী উদ্যোক্তার অধিক
- আবু তাহের খান
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ক্যারিয়ার ডেভলপমেন্ট সেন্টার আয়োজিত একাডেমিক লেকচার সিরিজের প্রথম পর্বে মূলবক্তা হয়ে এসেছিলেন ব্যাংক এশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী। অনুষ্ঠানের শুরুতে মো. আরফান আলীর ওপর এই লিখিত মানপত্রটি পাঠ করেন ক্যারিয়ার ডেভলপমেন্ট সেন্টারের পরিচালক আবু তাহের খান।
বয়সের মাপকাঠিতে প্রাজ্ঞতা মাপার একটি অতি সরলীকৃত মানদণ্ড পৃথিবীর সবদেশেই কমবেশি রয়েছে। চীনের গত এক শতাব্দীর পার্টি প্রধান, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে কেউ ষাট বা ষাটের কাছাকাছি বয়সের আগে ওই পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেননি। এ উপমহাদেশেও এ বয়সভিত্তিক প্রাজ্ঞতার প্রতি বিশেষ আগ্রহ রয়েছে এবং বহুক্ষেত্রে সেটির সবিশেষ গুরুত্বও রয়েছে। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রসরমানতার সুযোগককে কাজে লাগিয়ে নিজেদের যোগ্যতা ও সামর্থ প্রমাণের ক্ষেত্রে এই একুশ শতকে এসে বয়সীদের চেয়ে তরুণ ও কম বয়সীরাই সম্ভবত অধিকতর সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে পারছেন। এর প্রমাণ: মাত্র ৩৮ বছর বয়সী জেসিন্ডা অ্যাডর্ন এখন বিশ্বের জনপ্রিয়তম প্রধানমন্ত্রী, ৪১ বছর বয়স থেকেই সুন্দর পিচাই গুগলের সিইও আর ১৯৬৭তে একই বছরে জন্ম নেওয়া ৫২ বছর বয়সী স্কট মরিসন এখন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী, সুসান ওকসিকি এখন ইউটিউবের সিইও এবং মো. আরফান আলী এখন দ্বিতীয় মেয়াদে ব্যাংক এশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
আরফান আলী গত ২৫ জুলাই ব্যাংক এশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও এমডি পদে পুননির্বাচিত হয়েছেন এবং এই ২৩ আগস্ট তাঁর ৫৩তম জন্মদিন।
ভৈরবের কেবি উচ্চবিদ্যালয়, নটরডেম কলেজ ও ঢাকা কলেজ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ ডিগ্রি নিয়ে ১৯৯১ সালে তিনি ব্যাংক এশিয়ার সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার হানিল ব্যাংকে কাজ করেন যার পরিবর্তিত নাম এখন ওরি ব্যাংক। ২০১৬ সাল থেকে তিনি ব্যাংক এশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একইসঙ্গে গত দশ বছর যাবৎ তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ প্রোগ্রামের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন।
ব্যাংকিং ক্যারিয়ারের প্রায় শুরুতেই হানিল ব্যাংকে কাজ করতে পারাটাকে একটি চমৎকার সুযোগ বলে মনে করেন আরফান আলী। তাঁর নিজের ভাষায়, এটিই বস্তুত তাঁর ব্যাংকিং ক্যারিয়ারের সোপান বা ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল, যার ওপর দাঁড়িয়ে এ পেশাকে তিনি এক নতুন নান্দনিকতার আবহ দিয়ে গড়ে তুলবার চেষ্টা করেছেন। ব্যাংককে অধিকাংশ বিনিয়োগকারী বা সাধারণ মানুষ যখন মূলত মুনাফা বৃদ্ধিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করেন, তখন একজন মেধাবী আরফান আলী এটিকে চেষ্টা করছেন সমাজ থেকে বৈষম্য হ্রাসের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে। হানিল ব্যাংকে থাকাকালে সেখানকার ব্যাংকার, নানা পেশাজীবী, মন্ত্রী ও অন্যান্য পর্যায়ের নীতির্নিধারক এবং সর্বোপরি সেখানকার সাধারণ গ্রাহকদের সাথে কাজ করবার সুবাদে তিনি যে বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, বাংলাদেশে ফিরে এসে বস্তুত সে অভিজ্ঞতাকেই এখন তিনি একের পর এক ব্যাংকিং খাতের নানা সৃজনশীল উদ্যোগে রূপান্তরের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে তিনি প্রচণ্ড আশাবাদী। কিন্তু তারপরও এ খাতের কিছু কিছু মানুষের অসৎ ও বিবেকহীন অন্যায় আচরণের কারণে এ খাতের নানা নেতিবাচক খবর যখন প্রায়ই গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে ওঠে, তখন সেসব তাঁকে ভীষণ কষ্ট দেয় ও মর্মাহত করে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয় যখন দেখেন যে, অযোগ্যরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হচ্ছেন, আর অগণিত যোগ্য মানুষ হাহাকার করেও ঋণ পাচ্ছেন না। সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি হওয়ার পেছনে ব্যাংকিং খাতের এ অন্যায্য আচরণও বহুলাংশে দায়ী বলে মেনে করেন তিনি।
এরপরও দেশ সম্পর্কে তিনি প্রচণ্ড আশাবাদী এবং আরো বেশি আশাবাদী দেশের তরুণদের ব্যাপারে। তাঁর মতে, প্রযুক্তির কল্যাণে তরুণরা এখন অনেক দ্রুত অনেক কিছু শেখার সুযোগ পাচ্ছে। তবে এ শেখার পাশাপাশি তাদের দেশপ্রেম ও সমাজ মনস্কতার বোধ আরো শাণিত হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। নইলে এতকিছু শেখার পরও দেশ ও সমাজের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তাদের অবদানের জায়গাটি অনেকখানিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে বৈকি! তাঁর দৃঢ় অভিমত এই যে, দেশেই দক্ষ তরুণদের জন্য প্রচুর সৃজনশীল কাজের সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত তথা সার্বিক সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রে আইনের শাসনের ঘাটতিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে তিনি মনে করেন। আর এর পাশাপাশি ভৌত-প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ব্যবসায়িক পরিবেশ—এ উভয় ক্ষেত্রেই পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি সাধন ও এর সুরক্ষা দান করা না গেলে দেশ ও রাষ্ট্রের অনেক সম্ভাবনাই অব্যবহৃত থেকে যাবে বলে তাঁর ধারণা।
আরফান আলীর বাবা মো. রওশন আলী ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা আর মা জয়তুননেছা ছিলেন গৃহীনি এবং তাঁদের উভয়ই এখন প্রয়াত। আরফান আলী ও শামীম আরা খানমের তিন কন্যা। বড় মেয়ে সীমান তাবাসসুম আলী বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে বিবিএর ছাত্রী, দ্বিতীয় মেয়ে তাসমিয়া তাবাসসুম আলী স্কলাসটিকা থেকে সম্প্রতি ‘এ’ লেভেল সম্পন্ন করেছে এবং তৃতীয় তানজিনা তাবাসসুম আলী স্কলাসটিকায় দশম শ্রেণির ছাত্রী। এরা বড় হয়ে কে কী হবেন, আমরা জানি না। তবে অনুমান করি, বাবা যেমন ব্যাংকিংয়ের মতো মুনাফা সংশ্লিষ্ট পেশাকে সমাজ থেকে বৈষম্য নিরসনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের মতো ব্যতিক্রমী উদ্যোগের পথে এগুন, তারাও তেমনি নিজেদের সৃজনশীল বিকাশ ও অগ্রগতির পথে অবদান রাখবে বলে আশা রাখি।
কাজী নজরুল ইসলাম এখন থেকে প্রায় ৯০ বছর আগে অত্যন্ত ক্ষোভ ও কষ্টের সঙ্গে অবলোকন করেছিলেন যে, ‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা তখনো বসে/বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজছি ফিকাহ ও হাদিস চষে’। ওই ৯০ বছর পর আমরা যখন অনেক ক্ষেত্রেই অনেক দূর এগিয়েছি, তখনও প্রায় সেই একইরকম কষ্ট ও হতাশা নিয়ে লক্ষ্য করতে হয় যে, প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কল্যাণে নিজেদের চিন্তা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে সৎভাবে মুনাফা অর্জনের অঢেল সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকিং খাতের এক শ্রেণির অসাধু উদ্যোক্তা ও নির্বাহী নিজেদের চিন্তার দৈন্যতার কারণে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অনুকূল্য কিংবা গ্রাহকের লগ্নিকৃত অর্থ আত্মসাতকেই মুনাফা বৃদ্ধির অন্যতম কৌশল বলে গণ্য করেন। অথচ আরফান আলী দেখেন যে, দেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ১৪ কোটি মানুষেরই কোনো ব্যাংক হিসাব নেই এবং যে ৩ কোটি মানুষের ব্যাংক হিসাব রয়েছে, তাদের মধ্যকার একটি বড় অংশেরও লেনদেন খুবই অপর্যাপ্ত। ব্যাংক হিসাববিহীন এই ১৩ কোটি মানুষকে ব্যাংক হিসাবের আওতায় এনে অর্ধেক সংখ্যক হিসাবধারীকেও যদি পরিমিত ব্যাংকিং লেনদেন ও বিনিয়োগ অংশীদারিত্বমূলক কার্যক্রমের পথে যুক্ত করা যায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট কাউকেই তালাকের ফতোয়া খুঁজতে হবে না, ফন্দি আটতে হবে না গ্রাহকের আমানতের টাকা মেরে দেয়ার জন্য। বস্তুতঃ এই অন্তর্ভূক্তিমূলক ব্যাংকিংই আরফান আলীর স্বপ্নের ব্যাংকিং খাত। তাঁর সে স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত অন্তর্ভূক্তিমূলক অর্থনীতির অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠবে—সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আবু তাহের খান : পরিচালক, সিডিসি