আমার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় একটি পার্কিং লট থেকে: জাস্টিন ট্রুডো

আমার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় একটি পার্কিং লট থেকে: জাস্টিন ট্রুডো

সম্প্রতি কানাডার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন জাস্টিন ট্রুডো। শরীরে ট্যাটুধারী ৪৪ বছর বয়সী এই প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সৈন্য অপসারণের ঘোষণা দিয়েছেন। সাধারণ জনগণের খুব নিকটবর্তী হয়ে, এমন কি এক অনুষ্ঠানে ভারতীয় গানের তালে নেচে ইতিমধ্যে হইচই ফেলে দিয়েছেন! সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোর ছেলে কানাডার নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর জীবনের টুকরো স্মৃতি, তাঁর বিশ্বাস, অনুপ্রেরণা, ভালোবাসা, জীবনের কষ্টকর দিনগুলো আর উঠে আসার গল্প লিখেছেন: সাদিয়া ইসলাম


“১৯৭১ সালে অটোয়া পৌর হাসপাতালে তখনো প্রসবরে ঘরে স্বামীকে স্ত্রীকে সঙ্গ থাকতে দেওয়া হত না। আমার মা ভয়ংকর হয়ে উঠছেলি – যদি তার বাচ্চার জন্ম দেওয়ার সময় স্বামীকে না থাকতে দেওয়া হয় তাহলে সে ২৪ সাসেক্সে নিয়ে যাবে আমাকে। যখন মায়রে এই আন্দোলনের কথা হাসপাতালের পরিচালক সমিতির কাছে গিয়ে পৌঁছায়, তারা এতদিনের পুরোন নিয়ম উঠিয়ে নেয়। যা পরবর্তিতে ছড়িয়ে পড়ে অটোয়ার অন্যান্য হাসপাতাল এবং এমনকি পুরো দেশে। আমার ভাবতে ভালো লাগে যে বাবার সাথে সাথে পুরনো পিতৃতান্ত্রিক নিয়ম ভাঙতে মাকে আমিও সাহায্য করছেলিাম।“ নিজের জন্ম নিয়ে এমনটাই র্গব করে শব্দরে পর শব্দ সাজিয়ে বাক্যগুলো উচ্চারন করছিলেন সুঠাম দেহের, একচিলতে মিষ্টি আর বিনয়ী হাসির অনন্য সাধারন মানুষটি।

জাস্টিন ট্রুডো! কানাডার কনষ্ঠি প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে অন্যতম একজন। জন্ম থেকেই যিনি পাল্টে দিতে শুরু করেছেন পৃথিবীর প্রচন্ড শক্তিশালি অথচ নড়বড়ে ধারণা আর নিয়মগুলোকে। কানাডার দ্বিতীয় শিশু হিসাবে জন্ম নিয়েছিলেন জাস্টিন, যার জন্মের সময় রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সামনে দাড়িয়ে ছিলেন। মা-বাবার ভালোবাসার বন্ধনেই পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন আর সেই সাথে ভেঙে দিয়েছিলেন কানাডার এতদিন ধরে চলে আসা অহেতুক একটি প্রথা।

কিন্তু মাত্র ছয় বছর বয়সেই চোখের সামনে নিজের সাজানো পৃথিবীকে ভাঙতে দেখেন জাস্টিন। ১৯৭৭ সালে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় জাস্টিনের বাবা পিয়েরে ট্রুডো আর মার্গারেট সিনকলেয়ারের। আলাদা হয়ে যাওয়ার পর আবার নিজেদের মত করে দ্বিতীয় বিয়ে করেন জাস্টিনের বাবা আর মা। তবে বাবা – মায়ের ছাড়াছাড়ি নিয়ে কখনোই খুব বেশি কিছু বলতে চাননি জাস্টিন। ছোটবেলায় মায়ের চোখের পানি আর বাবার কঠিন মুখ দেখে কষ্টে বুকের ভেতরটা ভেঙে গলেওে তখনই বুঝতে পেরেছিলেন তিনি ভালোবাসাটাই সব নয়। জীবনসঙ্গী হতে হলে হতে হয় একে অন্যের পরিপূরকও।

“আমি জীবনে সবচেয়ে বেশি যেটো চেয়েছি তা হল বাবা হওয়া। আমি আমার অসাধারন বাবার কাছ থেকে, তাঁর রেখে যাওয়া উদাহরন থেকে অনুপ্রাণীত হয়েছিলাম এ ব্যাপারে”।

খুব ছোটবেলা থেকেই সোফি গ্রগেরীকে দেখে আসছিলেন জাস্টিন। তবে কখনোই খুব বেশি সখ্যতা গড়ে ওঠেনি তাঁর বিদ্যালয়ের এই সহপাঠী আর ছোটভাই মাইকলেরে বান্ধবীর সাথে।

২০০০ সালের কথা, পাহাড়ে স্কিইং করতে গিয়ে হঠাৎ সেখান থেকে পড়ে মারা যায় মাইকেল। ভাইয়ের জন্য আর সব স্কি করতে আসা মানুষগুলোর নিরাপত্তার জন্যে এগিয়ে আসে জাস্টিন। ভাইয়ের মৃত্যুতে বাবা-মার সাথে জাস্টিনও কষ্টে ভেঙে পড়েন। তবে বসে থাকেননি তিনি। এ ব্যাপারে আইন প্রনয়ন করতে তত্পর হয়ে ওঠেন।

অনেকদিন ধরেই টেলিভিশনে কাজ করছিলেন তিনি। সফল মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব হিসাবে বশে পরিচিতিও ছিল তাঁর। এই খ্যাতি আর পারিবারিক মর্যাদা – দুটোই এসময় কাজে লাগান তিনি। ২০০৩ সালের জুনে টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে সোফিকে জাস্টিনের সহ-উপস্থাপক করে দেওয়া হয়। আর এসময়ই সোফির জন্য নিজেকে মাইকেলের ভাইয়ের চেয়ে আরো একটু বেশি কছিু হিসাবে ভাবতে শুরু করেন জাস্টিন। সোফির দিকে থেকেও ইতিবাচক সাড়া পেয়ে ভালোবাসার সর্ম্পকে আবদ্ধ হন দুজন। বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়িতে জমে থাকা কষ্ট কিছুটা হলেও হালকা হয় জাস্টিনের।

সোফিকে নিয়ে বলতে গিয়ে প্রচন্ড উচ্ছসিত কন্ঠে জানান জাস্টনি- “মন্ট্রিলে ফিরে ২০০৩ সালে স্টারলাইট চলিড্রেনস ফাউন্ডেশন গালা’র উপস্থাপনায় আমাকে সাহায্য করতে অনুরোধ করা হয়। সেই সন্ধায় আমার সহ-উপস্থাপক ছিলেন কুইবেক টেলিভিশন আর রেডিওর জাঁকজমকর্পূণ একজন। তার নাম ছিল সোফি গ্রগেরী। আমরা সে রাতে গল্পগুজবে বশে ভালো সময় পার করেছি এবং আমি জানতাম যে সে খুবই বিশেষ একজন নারী।“ ২০০৫ সালে বিয়ে করে নেন জাস্টনি আর সোফি।

১৯৮৪ সালে ক্ষমতা থেকে সরে আসেন পিয়েরে ট্রুডো । মার্গারেটের সাথে বিচ্ছেদের পর ছেলে-মেয়েদের সবার কাছ থেকে একটু দূরে নিয়ে গিয়েই মানুষ করনে তিনি। বিশেষ করে ক্ষমতা ছাড়ার পর সেটা আরো বেশি কিছু হয়ে ওঠে। তবুও বাবাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন জাস্টিন। বাবার সাথে কাটানো সেই সময়গুলোকে খুব করে উপভোগ করতেন তিনি। যখন তাঁর বাবা কোন রাজনতৈকি ব্যাক্তত্বি নয়, শুধুই বাবা হয়ে আসতেন সন্তানের কাছে। কিন্তু জীবনের এ পর্যায়ে এসে আবার জাস্টিনকে ধাক্কা দেয় নিয়তি! বাবা পিয়েরে ট্রুডো-এর ক্যান্সার ধরা পড়ে। পিয়েরে কখনোই চাননি জাস্টিন তার কাজ ছেড়ে বাবার কাছে বসে থাকুক। কিন্তু ক্যান্সারের খবরটা শুনলে সেটাই হবে – এই আশঙ্কায় তিনি ছেলেকে কিছুই জানাননি। আর সবাইকে কড়া নিষেধ করে দিয়েছিলেন যাতে তার বড়ছেলে জাস্টিন ক্যান্সারের ব্যাপারে কিছু না জানে। পিয়েরের কথা মত কেউ কিছূ জানাননি জাস্টিনকে। জাস্টিন এই খবর জেনেছিল একেবারেই শেষ সময়ে।

রাজনৈতিক হিসাবে আমার জীবন শুরু হয় একটি পার্কিং লট থেকে। একটি মুদি দোকানের পার্কিং লট। খুব সুক্ষভাবে বলতে গেলে একটি শর্মা রেস্টুরেন্ট আর নাপিতের দোকানের বিপরীতে অবস্থিত জায়গাটিতে!

“এর মানে কী? আমি টেলিফোনে প্রায় চেঁচিয়েছিলাম। তোমরা কেন আমাকে বলনি? সাশা জানিয়েছিল যে, আমাকে অন্ধকারে রাখাটা বাবারই নির্দেশ ছিল। বাবা জানতো যে তাঁর অবস্থা শোনা মাত্রই ভ্যাংকউভর থেকে সবকিছু ছেড়েছুড়ে আমি মন্ট্রিলে চলে আসব। আমি জানতাম যে বাবা ঠিক কাজটাই করার চেষ্টা করছিলেন। কন্তিু আমি রেগে ছিলাম।” বাবার ক্যান্সার নিয়ে বলতে গিয়ে চাপাকষ্ট ঝড়ে পড়ে জাস্টিনের কন্ঠে। বাবাকে ছোটবেলা থেকে নিজের আদর্শের জায়গায় রেখেছেন জাস্টিন। ২০০৭ সালে বাবা হন জাস্টিন। নিজে বাবা হওয়ার আনন্দকে প্রকাশ করতে গিয়ে পিয়েরে ট্রুডো-কে মনে করেন জাস্টিন।

বাবা পিয়েরে ট্রুডোর সাথে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। ছবি: জন মোহনি, কানাডা।
বাবা পিয়েরে ট্রুডোর সাথে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। ছবি: জন মোহনি, কানাডা।

“আমি জীবনে সবচেয়ে বেশি যেটো চেয়েছি তা হল বাবা হওয়া। আমি আমার অসাধারন বাবার কাছ থেকে, তাঁর রেখে যাওয়া উদাহরন থেকে অনুপ্রাণীত হয়েছিলাম এ ব্যাপারে”।

ছোটবেলা থেকেই লিবারেল পার্টির সমর্থক ছিলেন জাস্টিন। নিজের রাজনতৈকি জীবন শুরুর গল্প বলতে গিয়ে জাস্টিন বলেন –
“রাজনৈতিক হিসাবে আমার জীবন শুরু হয় একটি পার্কিং লট থেকে। একটি মুদি দোকানের পার্কিং লট। খুব সুক্ষভাবে বলতে গেলে একটি শর্মা রেস্টুরেন্ট আর নাপিতের দোকানের বিপরীতে অবস্থিত জায়গাটিতে! সেটা আমিই ছিলাম – একটি ক্লিপবোর্ড নিয়ে সবাইকে বলে বেড়াচ্ছিলাম যে, কেউ ১০ ডলারের বিনিময়ে লিবারেল পার্টির সদস্য হতে রাজী কিনা।”

বাবা মারা যাওয়ার পর তার সেই সমর্থন আর পার্টির সাথে সখ্যতা আরো বেড়ে যায়। ২০০৬ সালে কুইবেক জাতীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এবং সেই সাথে বাবার চিন্তাধারার তুলনা করে সরাসরি রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বদের প্রতি মন্তব্য ছোঁড়েন জাস্টিন। ২০০৭ সালে এসে গুঞ্জন ছড়ায় যে নির্বাচনে যোগ দিচ্ছেন তিনি। ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পার নির্বাচনের আয়োজন করলে তাতে সহজেই প্রতিদ্বন্দী ভিভিয়ান বার্বাটকে হারিয়ে দেন জাস্টিন।

সেসময় তাকে কানাডার হবু প্রধানমন্ত্রীর তালিকায় থাকা উজ্জ্বল তরুন সম্ভাবনা বলে অনুমান করনে অনেকে। ২০১১ সালে কানাডিয়ান ফেডারেল নির্বাচনে আবার নির্বাচিত হন জাস্টিন। এরপর পার হয় অনেক ঘটনাবহুল কিছু সময়। মাঝখানে হতাশ হয়ে নিজের জায়গা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তও নেন জাস্টিন। তবে সবকিছুর শেষে ২০১৫ সালরে ১৯ অক্টোবর লিবারেল পার্টিকে ফেডারেল নির্বাচনে জয় এনে দেন জাস্টিন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হয়ে প্রধানমন্ত্রীত্ব লাভের মাধ্যমে আবার কানাডার ইতিহাসে নিজের নাম লেখেন তিনি।

নিজের নেতৃত্বের আওতায় মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য বেশকিছু পরিবর্তন আনেন জাস্টিন। তার ভেতর অন্যতম সমালোচিত পদক্ষেপটি ছিল নারীদেরকে নিজেদের সন্তান জন্মদানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা পুরোপুরি তাদের হাতে তুলে দেওয়া। এই পদক্ষেপের জন্য বেশ কথা শুনতে হয জাস্টিনকে। তবে সবার সব কথা শোন্র পরও দৃড় বিশ্বাস ছিল তাঁর, বাবা থাকলে তিনি জাস্টিনকেই সর্মথন করতেন। কিন্তু সত্যি কী তাই? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার উপায় না থাকলেও নিজেকে সবসময় বাবার আদলেই গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন জাস্টিন।

“আমার বাবার নেওয়া প্রতিটি সিদ্ধান্তই মিশে ছিল অনকগুলো কন্ঠ, যেগুলো কিনা মাঝে মাঝে সপ্তাহের পর সপ্তাহ কিংবা মাসের পর মাস সময় নিয়েছিল।” বাবার চন্তিাধারা আর কর্মপদ্ধতি নিয়ে বলতে গিয়ে কথাগুলো বলেন জাস্টিন। তিনি নিজেও ঠিক এমনভাবে তাঁর সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার চেষ্টা করেন। আর তাই তার নেওয়া কোন সিদ্ধান্তই বাবা, পিয়েরে ট্রুডিয়াও-এর অমত থাকতে পারনো বলে আত্মবশ্বিাস আছে জাস্টিন ট্রুডিয়ওর। favicon

Sharing is caring!

Leave a Comment