সংগ্রামে সাধনায় অনন্য ভাস্কর

সংগ্রামে সাধনায় অনন্য ভাস্কর

ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন-ইপসা’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন ভাস্কর ভট্টাচার্য। তিনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধি। নানা সংগ্রামের পথ পেরিয়ে আজ তিনি আপন আলোয় ভাস্বর। তাঁর সাফল্যের গল্প শোনাচ্ছেন মারুফ ইসলাম


লন্ডন বুক ফেয়ারে পুরস্কার হাতে ভাস্কর ভট্টাচার্য।
লন্ডন বুক ফেয়ারে পুরস্কার হাতে ভাস্কর ভট্টাচার্য।

ভাস্কর ভট্টাচার্যের বয়স যখন দুই তখন তার বাবা মা টের পেলেন, ছেলে চোখে দেখতে পায় না! তার আগ পর্যন্ত তারা বুঝতেই পারেননি ভাস্কর একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তখন মুষড়ে পড়েছিলেন বাবা মা। ভেবেছিলেন, ছেলে হবে তাদের শেষকালের অবলম্বন কিন্তু সেই ছেলেই কিনা অন্ধ হয়ে জন্ম নিলো! এখন এই ছেলের অবলম্বন কে হবে তাই নিয়ে দিনরাত ভাবতে থাকেন তারা।

কিন্তু প্রকৃতির হিসাব বোঝা মুশকিল। বড় হয়ে এই অন্ধ ছেলেই আলো ছড়াবে দেশজুড়ে সেকথা কি আর বুঝতে পেরেছিলেন ভাস্করের বাবা মা!

যথারীতি পরিবারের দুশ্চিন্তা হিসেবেই বড় হতে থাকে ছোট্ট ভাস্কর। চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নের বাগদণ্ডী গ্রামে তার জন্ম। সেখানেই বয়স বাড়তে থাকে তার। এক সময় স্কুলে যাওয়ার বয়স হয় ভাস্করের। তাকে ভর্তি করা হয় বাগদণ্ডী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু প্রতিবন্ধী শিশুদের পড়ালেখা করানোর কোনো সুবিধা সে স্কুলে ছিল না। এরপর মুরাদপুরে সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয় তাকে। সেখানেও সমস্যা ছিল। ব্রেইলে লেখা বই ছিল না। অঙ্ক করার জন্য ছিল না যথাযথ কোনো প্রযুক্তির ব্যবহার।

তবু জীবন বয়ে চলে। নাসিরাবাদ বয়েজ স্কুল থেকে ১৯৯৫ সালে মাধ্যমিক পাস করেন ভাস্কর। এরপর ভর্তি হন সরকারি সিটি কলেজে। সেখান থেকে এইচএসসি পাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করেন। কিন্তু চোখে দেখতে পান না বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভাস্করসহ আরও কয়েকজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর আবেদন নাকচ করে দেয়। এরপর তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দাবিতে অনশন শুরু করেন। তাদের দাবির মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। ভাস্কর ভর্তি হতে চাইলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। কিন্তু শিক্ষকরা বললেন, তুমি তো ফিল্ডওয়ার্ক করতে পারবে না। তখন ভর্তি হলেন ইতিহাস বিভাগে। না, সেখানেও কোনো ব্রেইলে লেখা বই ছিল না। শুনে শুনেই বইয়ের বিষয়বস্তু জেনে নিতেন।পরীক্ষায় কোনো অতিরিক্ত সময় দেওয়া হতো না ভাস্করকে।

স্নাতক পাস করার পর ২০০২ সালে জাপানে ডাসকিন লিডারশিপ ট্রেনিং নেওয়ার জন্য যান ভাস্কর। প্রশিক্ষণটা ছিল এক বছরের। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে তারা ১০ জনকে নির্বাচিত করে। তাদের মধ্যে ভাস্কর একজন।

‘এই ট্রেনিং প্রোগ্রামেই কম্পিউটারে আমার প্রথম হাতেখড়ি হয়। সেখানে আমি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের ওপর প্রশিক্ষণ পাই। আমার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। আমি অনেক কিছু শিখতে পারি, যা দেশে ফিরে আমার দারুণ কাজে লাগে। এর আগ পর্যন্ত আমার স্বপ্ন ছিল যেকোনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষক হব।’ বলছিলেন ভাস্কর ভট্টাচার্য।

স্ত্রী, সন্তানদের সাথে ভাস্কর ভট্টাচার্য।
স্ত্রী, সন্তানদের সাথে ভাস্কর ভট্টাচার্য।

২০০৩ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ফিরে এসে চাকরির চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রথম এক বছর কোনো চাকরি পাননি। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছে- এমন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানেও গিয়েছিলেন সেসময়। কিন্তু কোনোখানেই তার চাকরি হয়নি।

তবু থেমে থাকেননি ভাস্কর। চট্টগ্রামে প্রথম কম্পিউটারাইজড ব্রেইল প্রোডাকশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। তাকে সহযোগিতা করে ‘জাপান ব্রেইল লাইব্রেরি’ এবং ‘মালয়েশিয়ান কাউন্সিল ফর দ্য ব্লাইন্ড’। এছাড়া চট্টগ্রামের স্থানীয় সংগঠন ‘উৎস’ সে সময় তার পাশে ছিল।

তার এই সংগ্রাম চোখে পড়ে ‘ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন’ (ইপসা) নামে চট্টগ্রামের একটি উন্নয়ন সংস্থার। তারা ভাস্করকে সুযোগ দেয় তাদের প্রতিষ্ঠানে কাজ করার। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ভাস্করকে।

মাঝখানে ২০০৪ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে ডাসকিন ফলোআপ ট্রেনিং প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। ২০০৬ সালে ফের ব্যাংককে ডিজিটাল অ্যাকসেসেবল ইনফরমেশন সিস্টেম (ডেইজি) ইন্টারন্যাশনাল ট্রেনার্স ট্রেনিং কোর্সে অংশ নেন। এই কোর্স শেষ করার পর তিনি ডিজিটাল অ্যাকসেসেবল ইনফরমেশন সিস্টেমের আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষকে পরিণত হন। একই বছরের সেপ্টেম্বরে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ওপর তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নেন।

বর্তমানে ভাস্কর কাজ করছেন ইপসার প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে। পাশাপাশি কাজ করছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন’ প্রোগ্রামে। সেখানে তিনি ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট ওয়েব অ্যাকসেসেবিলিটি হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এ ছাড়া ভাস্কর ‘বাংলাদেশে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স অন অ্যাকসেসেবল টেকনোলজিস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টস’ (গ্যাটস)–এর আবাসিক প্রতিনিধি এবং ‘ন্যাশনাল ফোরাম অব অর্গানাইজেশনস ওয়ার্কিং উইথ ডিজঅ্যাবলড’ (এনএফওডব্লিউডি)–এর ন্যাশনাল আইসিটি থিম্যাটিক গ্রুপের আহ্বায়ক।

এ পর্যন্ত আড়াই’শ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েকে কম্পিউটারের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ভাস্কর। ৬০০-রও বেশি ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া বই তৈরি করেছেন। ৮০০ তৃণমূল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে নিয়ে ৪০টি সংগঠন গড়ে তুলেছেন, যাতে নিজেদের অধিকার নিয়ে তারা কথা বলতে পারে।

ভাস্কর ভট্টাচার্য এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করছেন। তারা প্রতিবন্ধী মানুষের ব্যবহারের জন্য ২৫ হাজার ওয়েবসাইট গড়ে তোলার কাজে নেমেছেন। সরকার সবার জন্য সেগুলো উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তৈরি করেছেন বাংলা স্ক্রিন রিডিং সফটওয়্যার। এটি যেকোনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষ বিনা মূল্যে ব্যবহার করতে পারে। তারা প্রথম থেকে দশম শ্রেণির সব বই ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া বইয়ে রূপান্তরিত করছেন। এসব বই তৈরি করা হয়েছে পুরো টেক্সট ও পুরো অডিওসহ, অর্থাৎ পাঠক এ বইগুলো হয়তো দেখে নয়তো শুনে পড়তে পারবে, সহজে ব্রেইলও করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন’ প্রোগ্রামের সার্ভিস ইনোভেশন গ্রাউন্ডের আওতায় ইপসা এ কাজটি করেছে।

vaskarকাজটির জন্য ভাস্কররা আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃতও হয়েছেন। পুরস্কারের মধ্যে আছে ইন্টারন্যাশনাল এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ড ফর অ্যাকসেসেবল পাবলিশিং। এ ছাড়া পেয়েছেন ডব্লিউএসআইএফ এশিয়া পুরস্কার। পেয়েছেন ন্যাশনাল ই-কনটেন্ট অ্যান্ড আইসিটিফরডি চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড, মন্থন পুরস্কার, আইএসআইএফ এশিয়া পুরস্কার ইত্যাদি।

ভাস্কর বলেন, ‘কাজ করতে গিয়ে আমার ২০ টিরও বেশি দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। সুযোগ হয়েছে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে আইসিটিফরডি নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার। জাতিসংঘের সদর দপ্তরে কয়েকবার প্যানেল আলোচক হিসেবে অংশ নিয়েছি। সৌদি সরকারের রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে দুবার সেখানে গিয়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রযুক্তির ধারণা তুলে ধরেছি।’

ভাস্করের ইচ্ছা, ২০১৬ সালের মধ্যে সব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রী বিনা মূল্যে ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া ও ডিজিটাল ব্রেইল বই পাবে। এ জন্য ইপসা, ‘অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন’ প্রোগ্রাম ও সমাজসেবা মন্ত্রণালয় কাজ করছে। সঙ্গে রয়েছে এনসিটিবি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ভাস্করের পরবর্তী লক্ষ্য, সব বাংলা বই যাতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষেরা পড়তে পারে তার ব্যবস্থা করা। এ জন্য তারা ন্যাশনাল অনলাইন অ্যাকসেসেবল লাইব্রেরি গড়ে তোলার জন্য কাজ করছেন।

সবশেষে ভাস্কর বলেন, ‘শৈশবে আমি আমার মায়ের অবিরাম কান্না শুনেছি। এখন যে তিনি আমাকে নিয়ে গর্ব করেন, অন্যদের সাহস জোগান, তার চেয়ে আনন্দ আমার আর কী হতে পারে?’

তথ্যঋণ : জাতীয় ই-তথ্যকোষ, বাংলা ট্রিবিউন ও প্রথম আলো

Sharing is caring!

Leave a Comment