আবর্জনায় স্বপ্নপূরণ

আবর্জনায় স্বপ্নপূরণ

এই গল্পটা রাহুলের। এই গল্পটা সাফল্যের। তবে গল্পটা গৌতম বুদ্ধের ছেলে রাহুলের নয়। গল্পটা রাহুল খাদালিয়ার। ভারতের বেঙ্গালুর রাজ্যের এক তরুণ রাহুল, যিনি পরিত্যক্ত আবর্জনা থেকে তৈরি করেন বিভিন্ন ধরনের পণ্য। তাঁর আবিষ্কার ইতিমধ্যে হুলুস্খুল ফেলে দিয়েছে ভারতজুড়ে। অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর প্রতিষ্ঠান এবিসিডি আয় করেছে কোটি টাকার ওপর। রাহুল খাদালিয়ার সাফল্যের গল্প শোনোচ্ছেন মারুফ ইসলাম


২০০৭ সালের গোধূলীবেলা; মানে বছর শেষ হয় হয় আরকি। ক্যালেন্ডারে হাতছানি দিচ্ছে নতুন বছর ২০০৮। রাহুল তখন পড়াশোনা করছেন দিল্লির বিখ্যাত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকেনোলজিতে (এনআইএফটি)। একদিন সকাল বেলা আর সব দিনের মতো কলেজের উদ্দেশে বেরিয়েছেন রাহুল। অ্যাভিনিউ রোডের পুরান বাজার এলাকায় এসে তাঁর মনে হলো এক কাপ চা হলে মন্দ হয় না! রাস্তার পাশের এক চায়ের স্টলে বসে দোকানীকে বললেন চা দিতে। তারপর আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সামনে তাকিয়েই হতভম্ব হয়ে গেলেন। রাস্তার অপর পাশের ফুটপাতে একটা দৃশ্যে তার চোখ আটকে গেল। ফুটপাতে ছেঁড়া কাঁথা মোড়ানো একটি শিশু, তার দিকে নোংরা শাড়ি পড়া এলোমেলো চুলের এক মহিলা এগিয়ে আসছে। তার দুই হাতে দুটো প্লাস্টিকের কাপ।

চা খাওয়ার কথা ভুলে গেলেন রাহুল। কী ঘটতে যাচ্ছে দেখার জন্য তাঁর চোখ স্থির হয়ে যায়। রাহুল দেখলেন, মহিলা তার একটি আঙুল কাপ দুটিতে ডোবাচ্ছেন আর শিশুর মুখে দিচ্ছেন। শিশুটি চুকচুক করে আঙুল চুষছে! রাহুল কাছে গিয়ে দেখলেন, এক কাপে দুধ আরেক কাপে জল!

পরিত্যক্ত আবর্জনা থেকে পণ্য তৈরি করছেন রাহুল খাদালিয়া। ছবি : লিংকড ইন।

সকালের এই একটি ঘটনা রাহুলের গোটা জীবনের ভাবনাচিন্তা আর দুনিয়া দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তছনছ করে দিল। তিনি মাথার ভেতর একটি ঝিমধরা অনুভূতি নিয়ে ক্যাম্পাসে গেলেন। ক্লাস করলেন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে। ফেরার পথে ক্যাম্পাসের পাশের একটি কফিশপে ঢুকলেন। মাথার ঝিম ঝিম ভাবটা কাটানো দরকার, এক কাপ কফি হলে মন্দ হয় না! কিন্তু রাহুল জানেন না, এখানেও তাঁর জন্য মঞ্চায়নের অপেক্ষায় রয়েছে সকালের বিপরীত ধর্মী এক নাটক!

কফিশপে ঢুকে রাহুল দেখলেন, একজন মা তাঁর ছোট্ট সন্তানের সঙ্গে স্ন্যাকস খাচ্ছেন। তারা চলে গেলে রাহুল লক্ষ্য করলেন তাঁদের টেবিলে যে পরিমাণ ফেলে যাওয়া খাবার আছে তাতে ওই মা-বাচ্চার দু’দিন ভালোমতো খাওয়া হয়ে যাবে!

প্রায় একই রকমের ঘটনার দুটো রূপ রাহুলকে বিচলিত করল। পুরো এক মগ কফি গিলেও মাথার ঝিমানো ভাবটা গেল না, রবং বাড়ল। বাসায় ফিরেও ভাবতেই থাকলেন… ভাবতেই থাকলেন। সমাজে এত বৈষম্য কেন? একটা কিছু করা দরকার। কিন্তু তিনি তো সমাজবদলকারী বিপ্লবী নন। তিনি সামান্য শিল্পীমাত্র! পড়াশোনা করছেন ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে। তিনি শুধু একটি কাজই মনযোগ দিয়ে করতে পারেন-পড়াশোনা। তাই পড়াশোনাতেই মন ঢেলে দিলেন। তবে এবার তিনি পড়তে শুরু করলেন ‘টেকশই উন্নয়ন’ নিয়ে। দিনের পর দিন তিনি ইন্টারনেট ঘেঁটে পড়তে থাকলেন সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্ট নিয়ে। এক সময় তাঁর মাথায় এলো কিছু চমৎকার আইডিয়া। তিনি তাঁর আইডিয়াগুলোর নাম দিলেন এবিসিডি (A Basic Concept Design)।

এবিসিডিকে দুটো ভাগে ভাগ করে ফেললেন রাহুল। একটির নাম দিলেন ‘ডিজাইনিং’ এবং অপরটির নাম দিলেন ‘প্রোডাক্ট আন্ডার সেকেন্ড লাইফ’। রাহুলের ভাবনা এমন, ডিজাইনিংয়ের মাধ্যমে তিনি অর্থ উপার্জন করবেন আর সেই অর্থ দিয়ে চালাবেন প্রোডাক্ট আন্ডার সেকেন্ড লাইফ।

এবার ভাবনাগুলো বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য রাহুল এমন সব প্রতিষ্ঠান খুঁজতে বের হলেন যারা পরিত্যাক্ত কাঁচামাল নিয়ে কাজ করে। ইংরেজিতে এসব প্রতিষ্ঠানকে বলে ওয়েস্ট ভেন্ডর। তিনি জানেন, অনেক সময় এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে নবায়নযোগ্য (রিসাইক্লিং) বর্জ্য থাকে। যেমন মালয়শিয়া থেকে একরকম ডকুমেন্ট বক্স আসে যা মাত্র একবার ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হয়। তাঁরা ওগুলো চিহ্নিত করে রিসাইক্লিং থেকে বাঁচান। রাহুল ভাবলেন, তাদের কাছ থেকে সেসব সংগ্রহ করা যেতে পারে।

রাহুল খাদালিয়ার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতের অনেকেই এখন নবায়নযোগ্য পণ্যের ব্যবসায় নেমেছেন। যেমন অরোরা ফেব্রিকস, গ্রিন পাওয়ার, লিকুইড গোল্ড, ক্লিনিং ই-ওয়াস্টল্যান্ড ইত্যাদি।

রাহুল অনেক প্রতিষ্ঠানের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেন। কেউ আশার কথা শোনাল না তাঁকে। খানিকটা হতাশ হয়ে পড়লেন। কী করবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না। ঠিক এসময় তাঁর স্বপ্নের পালে হাওয়া জুড়ে দেয় বেঙ্গালুরুর আবর্জনা সংগ্রহকারীরা! হ্যাঁ, এই আবর্জনা সংগ্রহকারীরাই এখন রাহুলকে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহ করে। রাহুল তাঁদের কাছ থেকে কিনে নেন পুরনো ছবির পোস্টার, ছেঁড়া কাগজ, ভাঙা প্লাস্টিক…।

08f3864রাহুলের নতুন আইডিয়া, পরিশ্রম আর একাগ্রতা বৃথা যায়নি। ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে রাহুলের এবিসিডি এখন বৈদেশিক বাজারের দিকে লক্ষ্য রেখে নিত্য নতুন পণ্য বানাচ্ছে। পুরনো আবর্জনা রিসাইকেল করে হাতে তৈরি নানান পণ্য আনছে রাহুলের প্রতিষ্ঠান। হু হু করে বাড়ছে আয়। মাত্র এক বছরে কোটি টাকার ওপর আয় করেছে এবিসিডি। বাড়ছে কর্মসংস্থান। বিনিয়োগ খোঁজা চলছে। জোর কদমে চলছে তহবিল সংগ্রহের কাজ। এবিসিডিকে আরও বড় করতে চান স্বাপ্নিক রাহুল।

রাহুল খাদালিয়ার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতের অনেকেই এখন নবায়নযোগ্য পণ্যের ব্যবসায় নেমেছেন। যেমন অরোরা ফেব্রিকস, গ্রিন পাওয়ার, লিকুইড গোল্ড, ক্লিনিং ই-ওয়াস্টল্যান্ড ইত্যাদি।

তথ্যঋণ : ইয়োর স্টোরি ডটকম, বিং কিউরিয়াস ডটকম ও লিংকড ইন।favicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment