মিশুক হয়ে উঠুন, মুহুর্তেই
শামীম রিমু : মানুষকে আপন করে নেয়ার ক্ষমতা কোনো কোনো ভাগ্যবান জন্মগতভাবে লাভ করে- চাপা স্বভাবের মানুষেরা কখনোই মিশুক হয়ে উঠতে পারে না-চারপাশের মানুষগুলোর সাথে কী করে মানিয়ে নিতে হয়, এটা কাউকে কখনো শেখানোও সম্ভব না- এগুলো আমাদের বদ্ধমূল ধারনা। কিন্তু বাস্তবে, মানুষকে আপন করে নেওয়ার এই অপরিহার্য গুণটি সহজেই অর্জন করা সম্ভব এবং এটি আমাদের মানসিক অবস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন। শুধু দরকার একটু মনোনিবেশ এবং ইকিউ (ইমোশোনাল কোশিয়েন্ট) সম্পর্কিত জ্ঞানচর্চা।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষক ম্যাথিউ লিবারম্যানের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, একজন মানুষের জন্য খাদ্য ও বাসস্থান যেমন অপরিহার্য, সামাজিকতা রক্ষা ও সম্পর্কস্থাপন করাটাও তেমনই একটি একটি মৌলিক চাহিদা। লিবারম্যান আবিষ্কার করেন, শারীরিক বেদনা ও নিঃসঙ্গতা আমরা মস্তিষ্কের একই অংশে অনুভব করি। মস্তিষ্কের এই বিশেষ অংশটির কাজ হলো আমাদের অস্তিত্বের সংকট সম্পর্কে অবহিত করা। সামাজিক সংযোগস্থাপন আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আদিমযুগ থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের টিকে থাকার অন্যতম কারণ হলো আমাদের সংঘবদ্ধ বসবাস। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, সামাজিকতা রক্ষা করা আমাদের মৌলিক চাহিদা হলেও, লজ্জা, আত্মকেন্দ্রীকতা, অহংকার, প্রতিযোগিতা, হিংসা, গোয়ার্তুমি প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যসমূহ আমাদের এই চাহিদা পূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
এসব অন্তরায় পেরোতে পারলে যেকোনো মানুষের সাথে সংযোগ স্থাপন কোনো কঠিন বিষয় নয়। এমনকি সবচেয়ে চুপচাপ মানুষটিও মন খুলে কথা বলবে আপনার সাথে, বন্ধুত্বের সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে আপনাদের মাঝে। আপনাদের সুবিধার্থে, মানুষকে আপন করে নেওয়ার কিছু কৌশল ও পরামর্শ নিম্নে বর্ণিত হলো।
সাত সেকেন্ডের ক্যারিশমা
- গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো ব্যক্তি আপনাকে পছন্দ করবে কিনা, এ সিদ্ধান্ত নিতে সে সাত সেকন্ডের বেশী সময় নেয় না। আলাপচারিতার বাকিটা সময় সে ব্যয় করে নিজের সিদ্ধান্তকে যাচাই করে। ভীতিকর শোনালেও, এই দুর্বিষহ সাত সেকেন্ড হতে পারে আপনার মোক্ষম অস্ত্র। নিজেকে ঝালাই করে নিন; অঙ্গভঙ্গি ও কণ্ঠস্বর করে তুলুন আকর্ষনীয়। কথা বলুন চোখে চোখ রেখে। দেখবেন আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গী আমাদের কথা বলার বিষয়ের চেয়ে বেশী গুরুত্ব বহন করছে।
অকৃত্রিম হয়ে উঠুন
- সদ্য পরিচিত দু’জন ব্যক্তির প্রথম আলাপচারিতায় কৃত্রিমতা অস্বাভাবিক নয়। কারণ, আমরা নিজেদের ব্যাক্তিত্ব নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন থাকি, সাদামাটা বিষয় নিয়ে কথা বলি, বিতর্কে জড়াতে চাই না। আমরা আবহাওয়া নিয়ে কথা বলি, আলাপ করি আমাদের কোনো বন্ধুকে নিয়ে। কিন্তু যদি সম্পর্কে গভীরতা আনতে চান, নিজেকে খোলসা করে তুলে ধরুন। একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলাপ করার দরকার নেই, কিন্তু আপনি যদি আপনার ভালো লাগার বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেন, আশা করা যায়, আপনার সঙ্গীও তাই করবে। আপনার প্রশ্নগুলোকে বলিষ্ঠ করে তুলুন। ‘আপনি কি করেন?’ এ প্রশ্নের চেয়ে ‘এ পেশা কেন বেছে নিলেন?’ প্রশ্নের উত্তরে আপনি তুলনামূলক বেশী তথ্যবহুল উত্তর পাবেন। খেয়াল রাখুন, প্রশ্নগুলো যেন বেশী ব্যক্তিগত না হয়ে যায়, আপনার সঙ্গী যেন কোনোভাবেই নিরাপত্তাহীনতায় না ভোগে।
শেখার চেষ্টা করুন
- মানুষটির কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করুন, তাকে গুরুত্ব দিন। এতে আপনার দুর্বলতা প্রকাশ পায় না, বরং আপনার নিরহঙ্কারী চরিত্র ফুটে ওঠে। এতে আপনার সঙ্গী নিরাপদবোধ করে ও সামাজিক খোলস থেকে বেরিয়ে আসে।
গোপনীয়তা রক্ষা করুন
- কোনো মানুষ নিজেকে আপনার সামনে তুলে ধরলে তার গোপনীয়তা রক্ষা করুন। কঠোর সমালোচনা ও ব্যঙ্গ করা থেকে বিরত থাকুন। জীবনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান দেখান। তীর্যক বাক্য না ছুঁড়ে একে অপরের জীবনাদর্শ বিনিময় করুন।
দোষ না খুঁজে গুণ খুঁজুন
- সবকিছুর খুঁত বের করার এক অদ্ভূত চল চলছে এখন। কোনো মানুষই নিখুঁত নয়, এটা আমরা সবাই জানি। তাই সঙ্গীর কাছ থেকে সবচেয়ে ভালোটা আশা করুন, সেও চেষ্টা করবে তার সর্বোচ্চটুকু অর্পন করতে। এক্ষেত্রে নতুন সঙ্গীর ব্যাপারে খুঁতখুঁতে না হওয়াটাই উত্তম, কারণ মানুষ কোনো পণ্য নয়।
হাসুন
- মানুষ অনুকরণপ্রিয়, নিজের অজান্তেই সে তার সঙ্গীর অঙ্গভঙ্গীর অনুকরণ করে। তাই হাসুন, বন্ধুকে হাসান। হাসির আনন্দ ভাগ-বাটোয়ারা করে নিন।
নাম ধরে ডাকুন
- নাম মানুষের ব্যক্তিগত পরিচয়। কারো মুখ থেকে নিজের নাম শুনতে কার না ভালো লাগে? গবেষণায় দেখা গেছে, কারো নাম ধরে ডাকলে সে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শুরু করে, যা এক ভালো লাগার অনুভূতি যোগায়। তাই কিছুক্ষণ পরপর সঙ্গীর নাম ধরে ডাকুন, তাকে বুঝতে দিন আপনার কাছে তার গুরুত্ব কতটুকু।
আপনি যদি ভুলোমনা হয়ে থাকেন, প্রথম পরিচয়ের সময় দ্বিতীয়বার ভদ্রভাবে তার নামটি জেনে নিন, কুণ্ঠাবোধ করবেন না। প্রয়োজনে একই নামের অন্য মানুষের কথা স্মরণ করুন, তাহলে নাম ভুলে যাওয়াটাই আপনার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
স্বস্তি দিন
- কাউকে স্বস্তি দিতে হলে তার সাথে সেরকম আচরণ করা উচিত যেমন আচরণ তারা আশা করে। শুধু মাত্র সদাচরনেই সীমাবদ্ধ থাকবেন না, নিজেকে প্রকাশ করতে দেওয়ার সুযোগ দিন। প্রমাণ করুন আপনি তার প্রতি মনোযোগী।
প্রতিযোগী হয়ে উঠবেন না
- খেয়াল রাখবেন, কখনোই যেন আপনার নতুন সঙ্গীটি আপনাকে প্রতিযোগী না ভেবে বসে। পারস্পরিক জীবনাদর্শ আপনাদের ভাবাতে পারে, অনুপ্রাণিত করতে পারে। কিন্তু অহংকারবোধ ও আত্মনিমগ্নতাকে কোনমতেই প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। কারণ মানবিক সংযোগস্থাপনের ক্ষেত্রে এগুলো বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
ভালো শ্রোতা হতে শিখুন
- কেউ কথা বলার সময় তার দিকে মনোযোগ দিন। নিমগ্নভাবে শুনতে শিখুন। আলাপচারিতায় আপনার পরবর্তী সংলাপ নিয়ে ভাববেন না। আপনার কথা সঙ্গীটির ওপর কী প্রভাব ফেলতে পারে, ভাবুন। কারণ, সব মানুষ সমান নয়। নিজের মত প্রকাশে কুণ্ঠাবোধ করবেন না, তবে আলোচনা অন্যদিকে মোড় নিলে বেপরোয়া হয়ে উঠবেন না। নিজের দ্বৈতসত্ত্বাকে চুপ করিয়ে রাখুন, দেখবেন আপনি সহজেই একজন ভালো বন্ধু হয়ে উঠছেন।
জীনগত বৈশিষ্ট্য বা প্রকৃতির ইচ্ছা, যাই বলুন না কেন, আমরা আসলেই সামাজিক জীব। এই পরামর্শগুলো মাথায় রাখুন। কোনো নতুন মানুষের সাথে সাক্ষাতের সময় এগুলোকে কাজে লাগান, দেখবেন প্রথম কথোপকথনেই কী করে পরস্পরকে আপন করে নিচ্ছেন আপনারা!