সাগর ডাকে আয় আয়…

সাগর ডাকে আয় আয়…

রবিউল কমল : যে মানুষ কোনোদিন সাগর দেখেনি, সে উপলব্ধি করতে পারবে না কি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর কেউ একবার সাগরের কাছে গেলেই সাগর তাকে চিরদিনের জন্য বন্দি করে ফেলবে। সে যেখানেই থাকুক সাগরের মায়াবী ডাক শুনতে পাবেই। কক্সবাজার এমন একটি স্থান, বাংলার পর্যটন রাজধানী। এটি গড়ে উঠেছে সুদীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, দিগন্ত বিস্তৃত নীল সমুদ্র, আকাশ ছোঁয়া পাহাড়, বৌদ্ধ মন্দিও আর প্যাগোডা নিয়ে। সুনীল সাগরের দেখা মিলবে টেকনাফ এবং সেন্টমার্টিনেও। দি প্রমিনেন্ট পাঠকদের জন্য এই তিনটি স্থানের নানা আকর্ষণীয় বিষয় সম্পর্কে এখানে উল্লেখ করা হল।


12571331_869253053173358_2008239103_nকক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

কক্সবাজারের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে সমুদ্র। এখানকার ১২০ কি.মি. জুড়ে বিস্তৃত সৈকতটি বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকত। ঝিনুকফোটা এই সাগরবেলায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখার আনন্দানুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সাধ্যাতীত। বিশাল বিশাল ফেনিল ঢেউ এসে যখন আপনাকে ভিজিয়ে দেবে , সেই জলস্পর্শে আপনার মনটাও ভিজে উঠবে এক অপার্থিব আনন্দে। বেলাভূমিতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের সঙ্গে উঠে আসা শামুক, ঝিনুক আর নুড়িপাথরে সৃষ্টি হয় এক অন্যরকম সৌন্দর্য। মেতে উঠতে পারেন অজ¯্র লাল কাঁকড়ার সঙ্গে ছুটোছুটিতে। চাইলে সমুদ্রতীরে সাজিয়ে রাখা খাটিয়ার মতো আসনগুলোতে বসে খুব আয়েশ ভঙ্গিতে উপভোগ করতে পারেন সমুদ্রের অপার সৌন্দর্য। রূপালি সৈকতের পেছনে সমান্তরালভাবে বিস্তৃত হয়ে থাকা সবুজ পাহাড়ের সারি সৃষ্টি করেছে অপূর্ব এক ছবি। সৈকতে ছড়ানো বালুরাশি গড়ে তুলেছে চমৎকার এক প্রাকৃতিক আবহ।

বার্মিজ মার্কেট

সমুদ্র সৈকতের খুব কাছেই নানারকম সৌখিন পসরা নিয়ে গড়ে উঠেছে বার্মিজ মার্কেট। এখান থেকে লুঙ্গি, শাল, ব্যাগ, জুতা, আচারসহ নানা বার্মিজ পণ্য, শামুক ঝিনুকের নানারকম সৌখিন জিনিসপত্র, শো-পিসসহ কুটির শিল্পজাত বিভিন্ন দ্রব্য বেশ সস্তায় কিনতে পারবেন।

হিমছড়ি

কক্সবাজার থেকে মাত্র ১৬ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থিত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কেন্দ্রভূমি হিমছড়ি। কোনো এক সময় এখানকার পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে পানির ধারা প্রবাহিত হতো বলে পুরো এলাকারই নাম হয়ে গেছে হিমছড়ি। সৈকত লাগোয়া আকাশ ছোঁয়া পাহাড়, হিম শীতল দুরন্ত ঝর্ণা, আর সম্মুখের নীল দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া বিশাল সমুদ্র সব মিলিয়ে এ যেন এক রূপকথার রাজ্য।

ইনানী সৈকত

কক্সবাজারের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ইনানী সমুদ্র সৈকত। হিমছড়ি থেকে প্রায় আট কি.মি. পূর্বে উখিয়া থানায় এর অবস্থান। সারা সৈকত জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সমুদ্র থেকে ভেসে আসা অসংখ্য প্রবাল পাথর। এইসব পাথর সহজেই আকৃষ্ট করে সবাইকে। এখানকার স্বচ্ছ পানিতে পা ডুবিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বুঁদ হয়ে যাবেন এক স্বপ্নীল আবেশে।

12625832_869253009840029_170645957_nমহেশখালী দ্বীপ

কক্সবাজার থেকে ১২ কি.মি. দূরে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর দ্বীপ মহেশখালী। এটি বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ। এখানকার প্রধান আকর্ষণ কয়েক’শ বছরের পুরনো আদিনাথ মন্দির। মৈনাক পাহাড়ের ওপর অবস্থিত পৌরাণিক ইতিহাস সমৃদ্ধ এ মন্দিরটি পর্যটক ও গবেষকদের কাছে অতি দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত। আদিনাথ মন্দিরের পাশে অবস্থিত প্যাগোডাটিও নজর কাড়বে আপনার। কক্সবাজার ট্রলার ঘাট থেকে মহেশখালী যেতে স্পিডবোট এবং ইঞ্জিনবোটে যেতে হয়। সময় লাগবে যথাক্রমে ১৫মিনিট এবং এক ঘণ্টা।

সোনাদিয়া দ্বীপ

কক্সবাজারের খুব কাছের দ্বীপ সোনাদিয়া। জলপথে যেতে হয় বলে সাগরের গতিপ্রকৃতির ওপর খেয়াল রাখা জরুরি। শীতকালে সাগর শান্ত থাকায় এ সময় সোনাদিয়া যাওয়ার উপযুক্ত সময়। প্রায় ৪.৬৩ বর্গমাইল আয়তনের এ দ্বীপটির সাগরের অতলান্ত সৌন্দর্যই শুধু নয়, সবুজ বনাঞ্চলও আপনার হৃদয় কাড়বে। মনোমুগ্ধকর এ দ্বীপটি ভোজনরসিকদের কাছেও আকর্ষণীয়। এখানকার খাবারের কোনো তুলনা হয় না। নারকেল, সুপারি আর সবজিও বেশ বিখ্যাত। শীতে প্রচুর অতিথি পাখির দেখা মেলে এখানে। কক্সবাজার থেকে ইঞ্জিনবোটে করে যেতে হয় এখানে।

বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক

কক্সবাজারের অন্যতম আকর্ষণ বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক। দুলাহাজরার ৯ হেক্টর এলাকাজুড়ে গঠিত এ পার্কটির অবস্থান চকরিয়া থানায়। এখানে মিলবে মুক্তাবস্থায় অবাধে বিচরণরত সিংহ, বাঘ, ভাল্লুক, কুমিরের মতো হিং¯্র প্রাণীর সাক্ষাৎ। সেক্ষেত্রে আপনাকেই থাকতে হবে বদ্ধাবস্থায়। চলন্ত গাড়িতে করে ঘুরতে হবে এখানে। শুধু হিংস্র প্রাণীই নয়, এখানে আরো আছে চিত্রল হরিণ আর বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। আছে কৃত্রিম হ্রদ আর ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম। রাত্রিযাপনের জন্য বিশ্রামকেন্দ্র ও ডরমিটরি আছে। কক্সবাজার থেকে চকরিয়াগামী যে কোনো বাসে করে যেতে পারেন দুলাহাজরা।

রামুর বৌদ্ধবিহার

কক্সবাজার শহর থেকে ১৫ কি.মি. দূরে বাঁশখালী নদীর তীরে অবস্থিত রামুও দর্শণার্থীদের আকৃষ্ট করবে। ২৫টিরও অধিক বৌদ্ধমন্দির রয়েছে এখানে। মন্দিরগুলোতে রাখা পুরাকীর্তি ও প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো শুধু বৌদ্ধ সম্প্রদায়েরই নয়, দেশের জন্যও এক অমূল্য সম্পদ, প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন। তবে বছর দুয়েক আগের সহিংসতায় এসব নিদর্শনের অনেক কিছুই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। কলাতলী থেকে জিপে কিংবা মাইক্রোবাসে করে যেতে পারেন রামুতে।

12631147_869253056506691_1197664244_oকুতুবদিয়া দ্বীপ

কক্সবাজার জেলার আরেকটি দর্শণীয় স্থান কুতুবদিয়া দ্বীপ। কুতুবুদয়া নামটি শুনলে প্রথমেই মনে আসে কুতুবদিয়া বাতিঘরের কথা। ১৮২৮ সালে নির্মিত এই বাতিঘরটি সমুদ্রবক্ষে চলাচলকারী সবধরনের নৌযানকে দিকনির্দেশনা দিত। ১৯৭৮ সালে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাতিঘরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও এখন পর্যন্ত স্থানটি বিখ্যাত হয়ে আছে প্রাচীন এ বাতিঘরটির জন্য। এছাড়াও কুতুব আউলিয়ার মাজার, মালেক শাহ হুজুরের দরগা, থানা ভবনের সামনের সুবিশাল দিঘি, কালারমা মসজিদও পর্যটকদের নজর কাড়বে। এখানকার সাগরের পানি বন্দি করে লবণ তৈরির পদ্ধতিটিও বেশ উপভোগ্য। কক্সবাজারের কস্তুরী ঘাট থেকে ইঞ্জিনবোটে ২ ঘণ্টা এবং স্পিডবোটে কুতুবদিয়া পৌঁছাতে সময় লাগবে ৪৫ মিনিট।

দরিয়ানগর

বনবিভাগ কর্তৃক পরিচালিত অতি আকর্ষণীয় এ ট্যুরিস্ট জোনটির অবস্থান কক্সবাজারের দক্ষিণে। এখানকার মরকাড়া নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য রয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পাঁচ’শ ফুট উঁচু পাহাড়চূড়ায় নির্মিত অবজার্ভেশন টুইন টাওয়ার। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাওয়ার সুবিধার্থে আছে কাঠ ও বাঁশের তৈরি ঝুলন্ত সেতু। রয়েছে মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক ঝর্ণা, আদিমগুহা, একটি শুটিংস্পটসহ দেখার মতো আরো অনেক কিছুই।

টেকনাফ

কক্সবাজারের আর একটি আকর্ষণীয় স্থান টেকনাফ। বাংলাদেশ এবং মায়ানমার সীমান্ত ছুঁয়ে এর অবস্থান। কক্সবাজার থেকে ৮৫ কি.মি. দূরে অবস্থিত এ স্থানের প্রধান আকর্ষণ নাফ নদী। এ নদীটিই দু’দেশকে আলাদা করেছে। এখানকার বিস্তৃত সৈকত, সুউচ্চ পাহাড়ের টিলা, সবুজ বনরাজি, নানা বন্যপ্রাণীও আপনার হৃদয় কাড়বে। টেকনাফের নাইট্যাং পাহাড়ের ৫০০ ফুট উচ্চ চূড়ায় নির্মিত বৃহৎ আয়তনের বুদ্ধমূর্তি আর সুদৃশ্য মন্দিরটিও নজর কাড়বে আপনার। এছাড়াও অভিনেতা, লেখক ও পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্রাচার্যের সঙ্গে মগ জমিদার কন্যা মাথিনের প্রেমগাথার হৃদয় বিদারক পরিণতির সাক্ষী হিসেবে তোলা মাথিনের কূপটিও এখানকার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। কূপের পাশেই লিপিবদ্ধ করা আছে মাথিন-ধীরাজের অমর প্রেম কাহিনী।

সেন্টমার্টিন

সেন্টমার্টিন না গেলে কক্সবাজার ভ্রমণটি যেন অসম্পূর্ণই রয়ে যায়। এখানকার দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি, স্বচ্ছ জলে বর্ণিল মাছ আর প্রবাল পাথর, এক হাজারেরও বেশি প্রজাতির পশুপাখি, সামুদ্রিক কচ্ছপের ঝাঁক, ভাটার সময় সৈকতে জমা হওয়া শামুক-ঝিনুক, চুনাপাথর আর নুড়িপাথর সব মিলে এক অপরূপ দৃশ্য। পুরো দ্বীপজুড়ে রয়েছে অসংখ্য নারকেল গাছ। নারিকেল গাছের এ আধ্যিকের কারণেই হয়তো এর আরেকটি নাম নারিকেল জিঞ্জিরা। এছাড়াও এখানে চোখে পড়বে প্রচুর কেয়া গাছ। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের অবকাশ যাপনের জন্য নির্মিত বাড়ি সমুদ্র বিলাসে সম্প্রতি গড়ে ওঠা রিসোর্ট সমুদ্র বিলাস আনন্দ আশ্রম এখানকার অন্যতম আকর্ষণ। এছাড়া মিউজিক ইকো রিসোর্ট এবং নারিকেল জিঞ্জিরা রেস্টুরেন্টও কম আকর্ষণীয় নয়। এখানে আরো আছে বেশকিছু চিত্তাকর্ষক প্রাচীন স্থাপত্যকীর্তি।

12576246_869252836506713_1268274415_nযেভাবে যাবেন

ঢাকার গাবতলী, কমলাপুর, ফকিরাপুল থেকে সোহাগ, গ্রীণল্যান্ড, সৌদিয়া এবং এস আলম বাস ছেড়ে যায় কক্সবাজারের উদ্দেশে। ট্রেনে করেও যেতে পারেন কক্সবাজার। সেক্ষেত্রে চট্রগ্রাম পর্যন্ত ট্রেনে গিয়ে বাকি পথটুকু যেতে হবে বাসে করে। এছাড়া আকাশপথেও যেতে পারেন কক্সবাজার। সেক্ষেত্রে মাত্র এক ঘণ্টাতেই আপনি পৌঁছে যাবেন কক্সবাজারে।

কক্সবাজার থেকে বাস ও মাইক্রোবাসে যেতে পারেন টেকনাফ। আর টেকনাফের দমদমিয়া থেকে এলসিডি কুতুবদিয়া, কেয়ারি সিন্দাবাদ, কেয়ারি ক্রুজ, এমডি কাজল, ঈগল প্রভৃতি জাহাজে করে যেতে পারবেন সেন্টমার্টিন।

কোথায় থাকবেন

কক্সবাজারে থাকার জন্য বেশকিছু ভালমানের হোটেল আছে। পাঁচতারকা মানের হোটেলও আছে।

Sharing is caring!

Leave a Comment