সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বেলারুশের সলতিয়েনা আলেক্সিয়েভিচ
মোস্তাফিজুর রহমান : কোন ফিকশন নয়, নয় কোন টেবিলে জন্ম দেওয়া মন গড়া গল্প। তিনি লিখেছেন ঘটে যাওয়া নির্মমতা। গল্প ঘটে যাওয়ার পর কান পেতে শুনেছেন প্রত্যক্ষদর্শীর যুদ্ধের গল্প, ভুক্তভোগীর যন্ত্রনার গল্প। তারপর লিখেছেন সে গল্পগুলোই। সৃষ্টি করেছেন সাহিত্যচর্চার এক নতুন ধারা। এবং তার বহুবছর পর জিতে নিয়েছেন সাহিত্যের সর্ব্চ্চ সম্মান।
হ্যা, বলছি বেলারুশের সলতিয়েনা অ্যালেক্সিয়েভিচির কথা, এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যিনি। বৃহস্পতিবার সুইডিশ একাডেমি ৬৭ বছর বয়সী এই লেখিকাকে ২০১৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার দেওয়ার ঘোষণা দেয়। ঘোষণাকালে একাডেমির সচিব সারা দানিউস বলেন, ‘বইয়ের তাক থেকে আপনি যদি তাঁর (আলেক্সিয়েভিচ) বইগুলো সরিয়ে ফেলেন, তাহলে দেখবেন সেখানে একটি শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় তিনি কতটা মৌলিক।’
১৯৮৭ সালে প্রাবন্ধিক, কবি জোসেফ ব্রোদস্কির নোবেল অর্জনের ২৮ বছর পর কোন রুশভাষী লেখক সোয়েতলানা আলেক্সিয়েভিচ নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হলেন। বেশ কয়েক বছর ধরেই তার নামটি সংক্ষিপ্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে ছিল। এছাড়া আরও একটি কারণে তার নোবেল প্রাপ্তি উল্লেখযোগ্য। আন্তর্জাতিক ভু-রাজনীতে যখন রাশিয়ার আবির্ভাব লক্ষণীয়ভাবে প্রবল ও আশাব্যঞ্জক হয়ে উঠতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই রুশভাষী জনগোষ্ঠীর জন্য অ্যালেক্সিয়েভিচির বয়ে আনলেন এই বিরল সম্মান।
প্রথম সাংবাদিক এবং ১৪তম নারী হিসেবে সাহিত্যের সর্বোচ্চ এই সম্মাননা পেলেন তিনি। এছাড়াও তাঁর মধ্যদিয়ে প্রায় অর্ধশতাব্দি পর কোনো নন ফিকশন লেখক সাহিত্যে নোবেল পেলেন। এ বিষয়ে নোবেল পুরষ্কারের ওয়েবসাইটে বলা হয়, সেতলানা অ্যালেক্সিভিচের লেখা আমাদের সময়ের কষ্ট ও সাহসের বহুমুখী বর্ণনার স্মারক। এই পুরস্কার একজন জীবিত লেখককে দেওয়া হয়।
সুইডিশ একাডেমির দেওয়া এই পুরস্কারের অর্থমূল্য আট মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনোর।
অ্যালেক্সিয়েভিচ ৪০ বছর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে পড়াশোনা করছেন। তার কাজ শুধু ইতিহাসের উপর নয় বরং তার লেখায় একটা চিরন্তনতার ছাপ রয়েছে।
সাংবাদিক সেতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচ ১৯৪৮ সালের ৩১ মে ইউক্রেনের আইভানো ফ্রাঙ্কভিস্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা বেলারুশের এবং মা ইউক্রেনের নাগরিক। ইউক্রেনে জন্ম হলেও অ্যালেক্সিয়েভিচ বেড়ে উঠেছেন এবং শিক্ষাগ্রহণ করেছেন বেলারুশে। অ্যালেক্সিয়েভিচ খুব অল্প বয়সেই নিজেরে ক্যারিয়ার ঠিক করে নেন সাংবাদিকতায়। স্কুলের পাঠ চুকিয়ে তিঁনি স্থানীয় একটি পত্রিকায় প্রতিবেদকের কাজ নেন। পরে মিনস্ক ইউনিভার্সিটি থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতক সম্পন্ন করেন।১৯৭২ সালে সাংবাদিকতা শুরু করা অ্যালেক্সিয়েভিচ কাজ করেছেন বেলারুশের সেল স্কাসা গাজেত্তা পত্রিকায়।
অ্যালেক্সিয়েভিচ এর রচিত প্রথম গ্রন্থ ‘ওয়ারস আনওমেনলি ফেস’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে গত শতকের ৭০-এর দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া নারীদের সাক্ষাতকার নেন তিঁনি। তারপর এই সাক্ষাৎকারে পাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের উপর ভিত্তি করে লিখতে শুরু করেন ‘ওয়ারস আনওমেনলি ফেস’ বা ‘দ্য আনওমেনলি ফেস অব দ্য ওয়ার’। লেখা শেষ করেন ১৯৮৩ সালে। সদ্য লেখা এই গ্রন্থে রুশ নারী যোদ্ধাদের বীরত্বকে খাটো করে দেখা হয়েছে অভিযোগ এনে এটি প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। শেষপর্যন্ত ১৯৮৫ সালে মিখাইল গর্বাচেভের পেরেসত্রোইকা সংস্কারের পর বইটি প্রকাশিত হয়।
উল্লেখ্য, রাজনৈতিক লেখক হিসেবে পরিচিত অ্যালেক্সিয়েভিচ নিজ দেশের সরকারের কঠোর সমালোচক। স্টকহোমে সুইডিশ একাডেমির সারা দানিয়াস পুরস্কার ঘোষণার সময় আরও বলেন, অ্যালেক্সিয়েভিচ ৪০ বছর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে পড়াশোনা করছেন। তার কাজ শুধু ইতিহাসের উপর নয় বরং তার লেখায় একটা চিরন্তনতার ছাপ রয়েছে।
বিশ্বব্যাপি অ্যালেক্সিয়েভিচের সবচেয়ে পরিচিত ইংলিশে অনুদিত গুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ভয়েসেস ফ্রম চেরনোবিল’ যা আজ থেকে প্রায় ২৯ বছর আগে ১৯৮৬ সালে চেরনোবিলে পারমাণবিক দুর্ঘটনার মৌখিক বর্ণনা। ২০০৫ সালে পহেলা এপ্রিল এই গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ হয়। এছাড়া সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনার বিবরলে তিনি লিখেছেন ‘বয়েজ ইন জিঙ্ক’।
বিবিসি, গার্ডিয়ান, সিএনএন, নিউ ইয়র্ক টাইমস