খালি জায়গা পেলেই গাছ লাগান জহির
- শাহজাহান নবীন, কুষ্টিয়া
‘জহিরের কাজ দেখে অনেকে অনেক রকম কথা বলে। তবুও তিনি দমে যাননি। রাস্তার পাশের ফাঁকা জায়গা দেখলেই সেখানে গাছ লাগিয়ে দেন। আমাদের গ্রামের রাস্তার দুপাশে তিনি নানা প্রজাতির গাছের চারা লাগিয়েছেন। জহিরকে দেখলে বোঝা যায় ভালো কাজ করতে ইচ্ছাশক্তিই সবচেয়ে বড় শক্তি।’ কথাগুলো বলছিলেন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কুমড়াবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হায়দার আলী। চেয়ারম্যান জানালেন আরো নানা কথা। যেমন, মানুষের বাড়িতে ফাঁকা জায়গা পেলেই সেখানে নিজের খরচে গাছ লাগিয়ে দেন জহির রায়হান। এমনকি সেসব গাছের খোঁজখবরও রাখেন নিয়মিত।
গ্রাম্য চিকিৎসক জিল্লুর রহমান জানান-‘ঝিনাইদহ জেলার অধিকাংশ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, রাস্তার মোড়সহ বিভিন্ন জায়গায় জহিরের লাগানো গাছ রয়েছে। এসব জায়গায় সে বকুল ফুলের গাছ লাগাতে পছন্দ করে।’
‘জহির রায়হান গাছ পাগল একজন মানুষ। শুধু গাছ লাগানোই তার নেশা নয়। সে দেয়ালে দেয়ালে জনসচেতনামুলক নানা ধরণের উক্তি ও মনীষীদের বাণী প্রচার করে থাকে। নিজের অর্থেই সে এসব কাজ করে থাকে।’ এভাবে জহির রায়হানের ব্যাপারে জানান সদর উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন।
জানা গেছে, শুধু গাছ লাগানো, পরিচর্যা বা দেয়াল লেখনির মধ্যেই থেমে নেই জহির রায়হানের এগিয়ে যাওয়া। মানবতার কল্যাণে এক নতুন সমাজ নির্মাণের আশা নিয়ে জহির একের পর এক নিয়ে চলেছেন নানা পরিকল্পনা। জহির রায়হানের সাথে কথা বলে জানা গেলো আরো নানা কথা। তিনি বলেন-‘পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখতে হলে তা মানুষের বাসযোগ্য করে রাখা জরুরী। পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন অক্সিজেন। আর অক্সিজেনের জন্য প্রয়োজন গাছ। তাই আমি খালি জায়গা পেলেই গাছ লাগাই।
দেয়াল লেখার ব্যাপারে তিনি বলেন-‘সমাজ পরিবর্তন ও দেশ গড়ার জন্য জনসচেতনতা প্রয়োজন। যেকারণে দেয়াল লেখনির মাধ্যমে জ্ঞানী মানুষদের উক্তিগুলো প্রচার করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এতে যদি একজনও সচেতন হয় তাতেই আমার শান্তি। আমি মনে করি, যার যার সামর্থ অনুযায়ী দেশের জন্য কাজ করা উচিত।’
জহির রায়হানের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল আরো আজব তথ্য। অসহায় মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার খরচ বহন করে চলেছেন এই জহির রায়হান। বর্তমানে প্রায় ৮/১০ জন ছাত্র-ছাত্রীর লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছেন তিনি। এমনকি এতিম মেধাবী এক ছাত্রীকে মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া পাখিদের বসবাসের জন্য গাছের শাখায় শাখায় তিনি বসিয়ে দিয়েছেন মাটির ভাঁড়। ঝিনাইদহ শহর ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে গাছের শাখায় দেখা মিলেছে জহিরের মাটির ভাঁড়ে পাখির বাসা।
এসব ব্যাপারে জহির রায়হান বলেন-‘একদিন ঝড়ের পর দেখি পাখির বাসা গুলো ভেঙে পড়ে আছে। অনেক পাখির বাচ্চা মারা গেছে। সেদিন মনে মনে ভেবেছিলাম, পাখিদের জন্য নিরাপদ বাসার ব্যবস্থা কর যায় কিনা। তাই মাটির পাতিল দিয়ে গাছের ডালে বাসা তৈরীর চেষ্টা করেছি। অনেক পাতিলে পাখিদের এখন বাসা বেঁধে থাকতে দেখেছি। পাখিদের বাঁচানো খুব জরুরী। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য পাখির কোনো বিকল্প নেই।’
জহির রায়হান ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কুমড়াবাড়িয়া ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় রংমিস্ত্রি জহিরের স্ত্রী শাহনাজ রায়হান বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করেন। দুজনের আয়ে কোনো রকমে চলে এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে চারজনের সংসার। তবে জহির জানান, সংসারে তার আরেকটি মেয়ে এসেছে। পাশের এলাকার এক এতিম মেধাবী মেয়েকে পোষ্য মেয়ে হিসেবে নিয়ে এসেছেন বাড়িতে। সন্তানের মর্যাদা দিয়ে মেয়েটিকে স্কুলে ভর্তি করেছেন জহির। রঙমিস্ত্রি জহির মানুষের ঘরবাড়ি রঙ করে থাকেন। পাশাপাশি ব্যানার, সাইনবোর্ড লেখার কাজও করেন তিনি। এসবই তার আয়ের উৎস। এই আয়ের টাকায় বর্তমানে তিন সন্তানের শিক্ষা ও লালন পালন ও সংসারের ব্যয় বহন করছেন জহির রায়হান।