শতাব্দীর সাক্ষী
- এস এম আহমেদ মনি
ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে বাংলার সব জমিদার বাড়িগুলো। তেমনই এক জমিদার বাড়ি ‘পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি’।
পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার অর্ন্তগত নাগরপুর উপজেলা প্রাচীন লৌহজং নদীর তীরে অবস্থিত। মূলত নদী তীরবর্তী এলাকা হওয়ার কারণেই অতীতে নাগরপুরে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন ধরণের ব্যবসা কেন্দ্র। ব-দ্বীপ সদৃশ নাগরপুরের পূর্বে ধলেশ্বরী এবং পশ্চিম পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে যমুনা নদী। একসময় এই যমুনা নদীর মাধ্যমে নাগরপুর এলাকার সাথে সরাসরি কলকাতার দৈনন্দিন ব্যবসায়িক কাজে যোগাযোগ ছিল। ফলে নাগরপুরের সাথে রাজধানী কলকাতার একটি বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক মোঘল আমলের সূচনা লগ্নে নাগরপুরে সুবিদ্ধা খাঁ এর হাত ধরে নাগরপুরের বিখ্যাত ‘চৌধুরী’ বংশের আর্বিভাব ঘটে।
পরবর্তীতে সুবিদ্ধা খাঁ-র পথ অনুসরণ করে পশ্চিম বঙ্গ কলকাতা থেকে রামকৃষ্ণ সাহা মণ্ডল নামে একজন বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তি আসেন । তাঁর জন্মস্থান বিষ্ণপুর(পশ্চিমবঙ্গ)। তাঁর ছিল দুই ছেলে বৃন্দাবন ও রাধা গোবিন্দ। রাধা গোবিন্দ ছিলেন নিঃসন্তান এবং বৃন্দাবন চন্দ্রের ছিল তিন ছেলে। এরা হলেন- ব্রজেন্দ্র মোহন, উপেন্দ্র মোহন ও যোগেন্দ্র মোহন। বৃন্দাবনের মেজছেলে উপেন্দ্রকে তাঁর কাকা নিঃসন্তান রাধা গোবিন্দ দত্তক নেন। ফলে উপেন্দ্র মোহন দত্তক সন্তান হিসেবে কাকার জমিদারীর পুরো সম্পদের অংশটুকু লাভ করেন।
১৯১৫ সালের ১৫ এপ্রিল প্রায় ১৫ একর এলাকা জুড়ে তিন ভাইয়ের নামে উদ্বোধন করা হয় একই নকশার পর পর তিনটি প্রাসাদ বা অট্টালিকা। প্রতিটি মহলের রয়েছে নিজস্ব সৌন্দর্য, লতাপাতার চমৎকার কারুকাজগুলো মুগ্ধ করার মতো। প্রতিটি জমিদার বাড়ীর মাঝ বরাবর লতা ও ফুলের অলংকরণে কারুকার্য মন্ডিত পূর্ণাঙ্গ দুই সুন্দরী নারী মূর্ত্তি এবং সাথে এক মূয়ূর সম্ভাষণ জানাচ্ছে অথিতিকে। এছাড়া দ্বিতীয় তলার রেলিং টপ বা কার্নিশের উপর রয়েছে পাঁচ ফুট পর পর বিভিন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য সুন্দর সুন্দর ছোট আকৃতির নারী মূর্ত্তি। নিয়মিত পরিচর্যার অভাবে প্রাসাদটির আজ প্রায় একেবারেই বেহাল দশা।
তিনটি বাড়ীর সামনেই রয়েছে তিনটি নাট মন্দির। বড় তরফের পূজা মন্ডপের শিল্পিত কারুকাজ শতবছর পর এখনও পর্যটকদের মুগ্ধ করে। জমিদার বাড়ির সামনে বিশাল মাঠ আর মাঠের মাঝখানে রয়েছে দ্বিতল নাচঘর। জমিদার বাড়ির কাছাকাছি পশ্চিমে আছে উপেন্দ্র সরোবর নামে বিশাল একটি আট ঘাটলা পুকুর। এই তিন মহলার জমিদাররা প্রত্যেকেই ছিলেন প্রজানন্দিত।
পরে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা তাঁদের পিতা বৃন্দাবন এবং কাকা রাধা গোবিন্দের যৌথ নামে বৃন্দবন চন্দ্র রাধা গোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয় (বিসিআরজি) প্রতিষ্ঠা করেন। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কৃতি ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্টাতা উপচার্য এবং সাবেক মন্ত্রী ড. এ আর মল্লিক, সাবেক প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান এবং ভবা পাগলার মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। বর্তমানে বিসিআরজি ডিগ্রী কলেজের নতুন একটি ভবন তৈরি করা হয়েছে এবং কলেজের ক্লাস ঐ নতুন বিল্ডিং-এ নেওয়া হয়। এদিকে কলেজ কর্তৃপক্ষ বর্তমানে উপেন্দ্র ভবনটি গ্রামীন ব্যাংক ও যোগেন্দ্র ভবনটি গ্রামীন কল্যাণকে ভাড়া দিয়েছেন যেখানে অফিস কাম ফ্যামেলি কোয়ার্টার হিসাবে তারা বাড়িগুলো ব্যবহার করছেন। তবে এলাকাবাসী এ প্রাসাদ সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ ও এর ইতিহাস সকলের কাছে পৌছে দেয়ার আহ্বান করেন ।
যান্ত্রিক জীবনের অলস সময়টুকুতে ঘুড়ে আসতে পারেন আপনিও। অল্প সময়ের জন্য হলেও জমিদারদের ঐতিহ্যের ছোঁয়ায় জমিদারী হাওয়া আপনার মনে এনে দেবে অনাবিল প্রশান্তি। চলচিত্রের স্যুটিং, শিক্ষাসফর প্রতিনিয়তই মন কেড়ে নিচ্ছে পর্যটকদের।
যেতে হলে আপনাকে বাসে বা নিজস্ব পরিবহনে করে ঢাকা থেকে ঢাকা-আরিচা রোডে কালামপুর স্ট্যান্ড, সেখান হতে সাটুরিয়া হয়ে সোজা উত্তরে ১৫কি.মি এলেই পাকুটিয়া জমিদার বাড়ী। আবার টাংগাইল শহর হতে দক্ষিণে দেলদুয়ার হয়ে লাউহাটি এবং লাউহাটি হতে পাকুটিয়া জমিদার বাড়ী আসতে পারেন।