তারা বইঠা বেয়ে স্কুলে যায়
- নিউজ ডেস্ক
ছোট হাতে বইঠা বেয়ে চলেছে একজন। সেই ডিঙি নৌকায় বসা তার বয়সী আরও কয়েকজন। তাদের পরনে স্কুলের পোশাক। অনেকের হাতে বই–খাতা। সারি ধরে বয়ে চলা নৌকাগুলো আচমকা দেখে মনে হতে পারে, এ যেন খুদে শিক্ষার্থীদের নৌকাবাইচ কিংবা শখের নাও বাওয়া। আদতে খাল পাড়ি দিয়ে শিশুদের এই ডিঙিযাত্রা আলোর সন্ধানে। তারা পানি কেটে ছুটে চলেছে বিদ্যালয়ে।
নৌকায় করে শিক্ষার্থীদের এমন স্কুলযাত্রা চোখে পড়বে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার দেউলবাড়ি দোবরা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। বছরের পর বছর ধরে এই এলাকার শিশুরা হাতেখড়ির আগেই তুলে নেয় বইঠা, শিখে ফেলে সাঁতার। কারণ, যাতায়াতের জন্য নৌকাই এখানে একমাত্র বাহন।
এই এলাকায় স্কুলযাত্রা অদম্য ইচ্ছাশক্তির ব্যাপার। যাদের এমন ইচ্ছাশক্তি আছে, তারাই কয়েক কিলোমিটার পথ নাও বেয়ে যায় স্কুলে।
জলে ভাসা গ্রামে এক দিন
নাজিরপুর সদর থেকে দেউলবাড়ি দোবড়া ইউনিয়নের দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। ৯ সেপ্টেম্বর ভোরে পিরোজপুর থেকে মোটরসাইকেলে চেপে রওনা হলাম দোবড়ার উদ্দেশে। সড়কপথে গাওখালী বাজার পর্যন্ত গিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় উঠতে হলো। নৌকা ছুটে চলল খাল–বিলের বুক চিরে। পথে ছোট–বড় নানা আকারের নৌকার দেখা মিলল। এসব নৌকায় মানুষ পণ্য নিয়ে হাটে যাচ্ছে। আবার কেউ হাট থেকে বাড়ি ফিরছে।
মধ্য গাওখালী গ্রাম পার হয়ে উত্তর গাওখালী গ্রামের সীমানায় পৌঁছাতেই চোখে পড়ল ডিঙিনৌকা চালিয়ে শিশুরা বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। একেকটি নৌকায় দুই থেকে আটজন করে শিক্ষার্থী। পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা যখন ৬ নম্বর উত্তর গাওখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছালাম, ঘড়িতে সময় তখন সকাল নয়টা। ডিঙিনৌকা বেয়ে হাঁসের ঝাঁকের মতো শিশুরা আসছে বিদ্যালয়ের পাশের ঘাটে। ৭ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুরা নৌকা চালায় দক্ষ মাঝির মতোই।
ঘাটে নৌকা বেঁধেই বই–খাতা নিয়ে শিশুরা মহা আনন্দে দৌড়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে। কে কার আগে গিয়ে ক্লাসে ঢুকতে পারে, সেই প্রতিযোগিতা। দূরদূরান্ত থেকে নৌকা বেয়ে আসার পরও ওদের মধ্যে নেই কোনো ক্লান্তির ছাপ। তাদের দেখে মনে হলো, দুনিয়ার তাবৎ মানুষ এভাবে নৌকা বেয়ে স্কুলে যাওয়া–আসা করে।
বিলডুমুরিয়া গ্রাম থেকে দুই কিলোমিটার নৌকা বেয়ে বিদ্যালয়ে এসেছে সানজিদা আক্তার। সে ৬ নম্বর উত্তর গাওখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। সানজিদা শুরুতে অন্য একজনের নৌকায় স্কুলে আসত। তারপর ধীরে ধীরে নিজেও নৌকা বাওয়া রপ্ত করেছে। ও বলল, ‘প্রথমে নৌকার বইঠা চালাইতে একটু কষ্ট হইত। হাত ব্যথা করত। এখন অভ্যাস হইয়া গেছে।’
প্রাথমিক বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিলীপ রায়ের কাছে জানা গেল, তাঁর বিদ্যালয়ে এখন শতাধিক শিক্ষার্থী, যাদের বেশির ভাগই নৌকা চালাতে পারে।
দুপুর সাড়ে ১২টায় বিদ্যালয়ে এল আরেক দল শিক্ষার্থী। তারা তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। পঞ্চম শ্রেণির সাব্বির হোসেন বলল, ‘খালে এখন কচুরিপানা বেড়ে গেছে। নৌকা চালাতে খুব কষ্ট হয়।’ এই সাব্বির স্বপ্ন দেখে একদিন সে চিকিৎসক হবে।
বিদ্যালয়ের ঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেই সাব্বিরের কষ্টের কথা মনে হলো। খালে কচুরিপানা এতটাই বেড়ে গেছে যে ইঞ্জিনচালিত নৌকা চালাতে হলো অন্যদিকে। এবারের গন্তব্য ৩২ নম্বর মনোহরপুর সরকারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
বিদ্যালয়ে পৌঁছার আগে দেখা হলো কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, মনোহরপুর গ্রামের ৯০ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী। বিলে ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি ও রবিশস্য আবাদ করেন তাঁরা। তবে কিছু জমিতে ধান চাষ হয়। ধান ও সবজি চাষ আর খালে–বিলে মাছ ধরে জীবন চালান তাঁরা।
স্কুল চলে জোয়ার–ভাটার সময় মেনে
নৌকা নিয়ে গন্তব্যে ছুটে চলা গ্রামবাসীর কথা শুনতে শুনতে আমরা ঘুরে ফেলি মনোহরপুর সরকারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মনোহরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়। কথাও হয় কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাপস ঘরামী বললেন, ‘দুর্গম যোগাযোগব্যবস্থার কারণে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি অনেক কম। তা ছাড়া বছরের নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত খালে পানি কম থাকে। তখন খালে জোয়ারের সময় শিক্ষার্থীরা নৌকায় বিদ্যালয়ে আসা–যাওয়া করে। পুরো শীত মৌসুম জোয়ার–ভাটা অনুসরণ করে বিদ্যালয় চলে।’
জলমগ্ন সাত গ্রাম
দেউলবাড়ি দোবরা ইউনিয়নের গ্রামগুলো জালের মতো জড়িয়ে রেখেছে খাল ও বিল। তাই বছরজুড়ে জলমগ্ন থাকে পদ্মডুবি, দাসপাড়া, মনোহরপুর, বিলডুমুরিয়া, সোনাপুর, দেউলবাড়ি ও উত্তর গাওখালী গ্রাম। এসব গ্রামের বেশির ভাগ এলাকায় সড়ক নেই। গ্রামগুলোর বাসিন্দারা শত বছর ধরে নৌকায় খাল ও বিল দিয়ে যাতায়াত করে। তাই প্রতিটি বাড়ির পাশেই দেখা মেলে একটি বা দুটি করে নৌকার।
মনোহরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অনিল চন্দ্র বড়াল শোনালেন নানা সমস্যার কথা। যেমন মনোহরপুর গ্রামে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। চিকিৎসার জন্য তাঁদের যেতে হয় ১৫ কিলোমিটার দূরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। বিল অঞ্চলের বেশির ভাগ গ্রামের বাড়িতে বিদ্যুতের সংযোগ নেই। শিক্ষার্থীরা কুপির আলোয় পড়াশোনা করে। তাঁর কথায়, ‘সন্ধ্যা নামার পর মনে হয় দ্বীপের মধ্যে বন্দী হয়ে আছি। দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাস করছি আমরা।’
এসব প্রতিবন্ধকতা মেনে নিয়েই গ্রামের খুদে শিক্ষার্থীরা রঙিন স্বপ্ন বুকে ধারণ করে বইঠা বেয়ে ছুটে চলে বিদ্যালয়ে। তাদের কেউ প্রকৌশলী হতে চায়, কেউবা চিকিৎসক।