বাংলার টুপির বিশ্বযাত্রা

বাংলার টুপির বিশ্বযাত্রা

  • এসএম মুকুল

ধর্মপ্রাণ মুসলমাদের জন্য টুপি আবশ্যক। টুপির ব্যবহার হয় ঈদে এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে টুপির বাজার বছরজুড়ে। ধর্মীয় রীতি ও দিবস পালনে- হজ, রোজা ও ঈদের সময় টুপির চাহিদা বেড়ে যায়। তারপরও আমরা হয়ত জানি না যে- বাংলার টুপির রয়েছে বিশ্ববাজারে ব্যাপক চাহিদা। টুপির বাণিজ্য সুবাদে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে ‘মেইড ইন বাংলাদেশের সুনাম। কেবল টুপি রফতানি করেই বছরে আয় হয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। ফেনী জেলায় গোড়াপত্তন হলেও এ শিল্প ছড়িয়ে পড়ছে ভোলা, চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর, ময়মনসিংহ, সিলেট, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। টুপি শিল্পের কল্যাণে ভিন্নধর্মী বিকল্প পেশার খোঁজ পেয়েছেন লাখো নারী।

  • টুপি শিল্পের বিকাশ- মাস্কাট থেকে বাংলাদেশ

ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের পূর্ব জয় নারায়ণপুর গ্রামের বেলায়েত হোসেন ১৯৮১ সালে ভাগ্যের অন্বেষণে ওমানের রাজধানী মাস্কাটে চাকরি করতে গিয়ে সেখানকার পুরুষদের মাথায় সুন্দর নকশা করা টুপি দেখে তারও টুপি বানানোর ইচ্ছে জাগে। টুপি তৈরির কৌশল অনুসন্ধানে বেলায়েত একদিন মাস্কাট থেকে ওমানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর সালালায় যান। সেখানেই সন্ধান মেলে নকশি টুপি তৈরির কারখানার। সেখানে এক পাকিস্তানী নাগরিকের সহকারী হিসেবে ছয়মাস নকশি টুপির কাজ শেখেন। তারপর সালালায় বাংলাদেশীসহ বিভিন্ন দেশের ৭০ থেকে ৮০ জন কর্মীকে এ কাজ শিখিয়ে শুরু করেন টুপি তৈরির ব্যবসা। ১৯৯০ সালে তিনি সালালা ছেড়ে আবার মাস্কাটে গিয়ে নকশি টুপির শোরুম খোলেন। টুপি তৈরি হয় সালালায় বিক্রি হয় মাস্কাটে। তারও তিন বছর পর ওমানে দুটো শোরুম। এভাবে নকশি টুপির বড় রকমের বাণিজ্যের স্বপ্ন নিয়ে দেশে ফিরে আসেন বেলায়েত। ১৯৯৩ সালে ফেনীতে গড়ে তোলেন ‘সেভেন স্টার হস্তশিল্প কারখানা’। দেশী কাপড় দিয়েই বিদেশী টুপির নকশা অবলম্বনে বাংলাদেশের তৈরি টুপি বিক্রি করেন ওমানে। এই পথ ধরেই ফেনীতে গ্রামীণ হস্তশিল্প, নিউ সেভেন স্টার, জনতা, জনসেবা, হৃদয়, আইমন, সুপারস্টার, নিউ সুপার, ভাই ভাই হস্তশিল্প প্রভৃতি নামে টুপি তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। বেলায়েতের সাফল্যে অনুপ্রাণীত হয়ে দাগনভূঞা ও আশপাশের অঞ্চলে গড়ে উঠেছে প্রায় ৩০টি টুপি তৈরির কারখানা। এসব কারখানায় কাজ করছেন প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক।

  • বাংলার টুপির বিশ্বজয়

টুপির মান এবং ডিজাইন আকৃষ্ট করে বলেই হজের মৌসুমে সৌদি আরবে আগত হাজীরা বাংলাদেশের টুপি ক্রয় করেন। আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, থাইল্যান্ড, কাতার, ওমান, মালয়েশিয়া, দুবাইয়ের হাজীরা বাংলাদেশী টুপি সবচেয়ে বড় ক্রেতা। তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে- বাংলাদেশী টুপি তুলনামূলক দামে সস্তা, বিক্রয়ে লাভ ভাল। রাজধানীর পুরান ঢাকার হরনাথ ঘোষ রোডে ‘আলিফ ক্যাপ গার্মেন্টস’-এর এসব টুপি রফতানি হচ্ছে শ্রীলঙ্কা, মরক্কো, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, চীনসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি দেশে। আলিফ টুপির কারখানায় ২৫০ জন শ্রমিক ও ছোট-বড় ৪০০ মেশিনের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৬ লাখ টুপি বিদেশে রফতানি করছে। তবে চাহিদা প্রায় ১২ লাখ টুপির। জানা যায়, ২৮ বছর ধরে দেশীয় বাজারের অধিকাংশ চাহিদাই মেটাচ্ছে আলিফ টুপি।

  • আশা জাগাচ্ছেন টুপি কন্যারা

গ্রামে টুপি তৈরির কারখানায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাজ করে সাবলম্বী হচ্ছে। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে জানা গেছে, টুপি তৈরির কারখানাগুলোতে নারী শ্রমিকই বেশি। গৃহবধূ থেকে মেয়ে শিক্ষার্থীরা অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে টুপিতে বাহারী নকশার কাজ করে বাড়তি উপার্জনের মাধ্যমে পরিবারের সচ্ছলতা আনছে। টুপিতে নকশি বা গুটির কাজ করে কুমিল্লার দাগনভূঞা, সেনবাগ, নাঙ্গলকোট, কোম্পানীগঞ্জ, সোনাগাজী, ফেনী সদর, ছাগলনাইয়াসহ আশপাশের কয়েক উপজেলায় প্রায় অর্ধলক্ষ মহিলার বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বগুড়ার জালি টুপি দেশের গ-ি পেরিয়ে দখল করেছে মধ্যপ্রাচ্যের বাজার। প্রতিমাসে ১০ লক্ষাধিক পিচ জালি টুপি তৈরি হয়। বিক্রি হয় প্রায় আড়াই কোটি টাকা। চট্টগ্রামের দেশ বিদেশ মিডিয়া ছাড়া চাদনী এ্যান্ড ব্রাদার্স, ছাকিনা মঞ্জিল, ফেনীর হস্তশিল্প, জনসেবা হস্তশিল্পসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান টুপি রফতানি করছে। মঙ্গাপীড়িত এলাকা কুড়িগ্রামের পাশাপাশি ১০টি গ্রামের গৃহবধূ, তরুণী সবাই বছরে গড়ে ৬০ হাজার টুপি তৈরি করেন। মধ্যপ্রাচ্যে এসব টুপির গড় মূল্য এক হাজার টাকা হিসেবে এসব গ্রামে বছরে প্রায় ৬ কোটি টাকার টুপি তৈরি হয়। রংপুরে কাউনিয়া উপজেলায়, রংপুর সদর, লালমনিরহাটের তিস্তাচর, কড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন গ্রামের মহিলারা টুপি বানিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন ১৫ হাজার মহিলা। গত দুই দশক ধরে এই টুপি তৈরি করে আসছেন, হোমনার ৬টি গ্রামের তিনশর বেশি কারিগর। নওগাঁর নিয়ামতপুর ও মহাদেবপুর উপজেলার অর্ধ শতাধিক গ্রামে টুপি তৈরি হচ্ছে। বগুড়ার ধুনট উপজেলার বিলকাজুলি, অলোয়া, শ্যামগাতী, পিরহাটি, খাদুলী, হিজুলী, সাগাটিয়া, কাশিয়াহাটা, ভুবনগাতী, শাকদহ, পেঁচিবাড়ী, জালশুকা, বিশ্বহরিগাছা, বহালগাছা, বেলকুচি, মথুরাপুর ও মাটিকোড়সহ প্রায় দেড়শ’ গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। তেঁতুলিয়ার আজিজনগর, মাথাফাটা, ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের প্রায় দু’শতাধিক নারী ও পুরুষ টুপি তৈরির কাজের সম্পৃক্ত। ফরিদপুর শহরের বায়তুল আমান এলাকার পদ্মা নদীর ভাঙনে সর্বস্ব হারানো শতাধিক পরিবারের নারী সদস্যরা টুপি তৈরি করে। এভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গ্রামাঞ্চলের নারীরা তাদের হাতের সুনিপুণ দক্ষতায় টুপি তৈরিতে এনেছে আধুনিকমাত্রা। নিজেদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি রফতানি আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছেন এবং অর্জন করেছেন ‘টুপি কন্যা’র খেতাব। favicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment