জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস: এগিয়ে চলার এক দশক
আজ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন, পুরাতন সকল শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলকে অভিনন্দন, শুভেচ্ছা। “শুভ জন্মদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়!” জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে লিখেছেন এবিসি রেডিও’র সহ-সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মারুফ ইসলাম।
মারুফ ইসলাম: বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে আজ পালিত হচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর পথ চলা শুরু হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের। সে হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টির বয়স নয় পেরিয়ে দশ বছরে পড়ল আজ।
অন্যান্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে জন্মগত পার্থক্য। প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে প্রায় দেড়শ বছরের গৌরবময় ইতিহাস।
টাঙ্গাইলের বালিয়াটির জমিদার কিশোরী লাল চৌধুরী ১৮৮৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন জগন্নাথ কলেজ। যেটি তার বাবা জমিদার জগন্নাথ চৌধুরীর নামানুসারে নামকরণ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে ডিগ্রি কোর্সটি বাতিল করে এর নামকরণ করা হয় জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ। এর আরো ২৮ বছর পরে অর্থাৎ ১৯৪৯ সালে এটিতে পুনরায় ডিগ্রি কোর্স চালু, ১৯৬৮ সালে কলেজটিকে সরকারিকরণ এবং ১৯৭৫ সালে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়। অবশেষে ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর জগন্নাথ কলেজকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়।
বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি অনুষদের ৩৩টি বিভাগ এবং একটি সেন্টারে প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর প্রতিষ্ঠানটির পদ্ধতিগত ও কাঠামোগত নানা পরিবর্তন হয়েছে। ক্যাম্পাসের প্রধান গেটের পাশেই নির্মিত হচ্ছে অত্যাধুনিক ২০ তলা অ্যাকাডেমিক ভবন। এ ভবনের ৭ তলার নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। উদ্বোধনের পর বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে ২০ তলা বিশিষ্ট ছাত্রীনিবাস। যেখানে অন্তত এক হাজার ছাত্রীর আবাসনের ব্যবস্থা হবে। এছাড়া রাজধানীর অদূরে কেরাণীগঞ্জের ঝিলমিল প্রজেক্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস ও শিক্ষকদের আবাসনের ব্যবস্থার কাজও প্রক্রিয়াধীন।
অপূর্ব সুন্দর শতবর্ষী প্রশাসনিক ভবন বয়সের ভার ছাপিয়ে তারুণ্য নিয়ে এখন গৌরবের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই ভবনটির কপালে জুটছে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি। প্রশাসনিক ভবনের পাশে রয়েছে নান্দনিক ও ব্যাতিক্রমধর্মী শহিদ মিনার। এছাড়াও ক্যাম্পাসের অবস্থিত ‘একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’ ভাস্কর্যটি বাংলাদেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্য।
ভাষা শহীদ আব্দুর রফিক, সাহিত্যিক আনিসুজ্জামান, কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব এটিএম শামসুজ্জামান, সংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর ছাড়াও অসংখ্য গুণী মানুষ এ প্রতিষ্ঠান থেকেই উঠে এসেছেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, অজিত কুমার গুহ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, হায়াত মামুদসহ অনেক গুণী ব্যক্তিত্ব শিক্ষকতা করেছেন এ প্রতিষ্ঠানে।
এখানে পড়াশোনা চলছে বিশ্বমান ও বিশ্বরীতিকে মেনে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিটি বিভাগে পাঠদান চলে আসছে সেমিস্টার পদ্ধতিতে। এশিয়া মহাদেশে সর্ববৃহৎ রোভার স্কাউট ইউনিটটি এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই। উচ্চতর গবেষণাকে এগিয়ে নিতে সম্প্রতি চালু হয়েছে এমফিল ও পিএইচডি কোর্স। ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের অন্তর্গত বিবিএ ও এমবিএ প্রোগ্রাম ইতিমধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। একদল তরুন শিক্ষক নিষ্ঠার সঙ্গে শিক্ষার অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখে চলেছেন।
আলোচিত পাথরকুচি পাতা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে ড. কামরুল ইসলাম নামের এক শিক্ষকের গবেষণায়। অচিরেই এ পাথরকুচি পাতা থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের মাধ্যমে পুরো ক্যাম্পাসে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া অ্যাপস তৈরি, বন মোরগের ক্যাপবিভ ব্রিডিংয়ের গবেষণায় সাফল্য লাভ করেছে এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ফলে প্রতিবছরই বহু শিক্ষক-শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি লাভ করছেন।
এছাড়াও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে আরো সাফল্য। প্রশ্নফাঁস ও ভর্তি জালিয়াতির যুগে বারকোড পদ্ধতি প্রবর্তন করে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভর্তি ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করায় বিসিএসসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় জবির শিক্ষার্থীরা ঈর্ষণীয় সাফল্য লাভ করছে। ই-লাইব্রেরি চালু, ফার্মেসি বিভাগে সর্বাধুনিক আইসিপিএমএস যন্ত্র, কম্পিউটার সাইয়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে আধুনিক ল্যাব, মনোবিজ্ঞানে নতুন কনফারেন্স রুম ও ক্যাম্পাসে ওয়াইফাই জোন স্থাপন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন প্রগোজ স্কুলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীভুক্ত করা, ডরমেটারির ঊর্ধ্বমুখি সম্প্রসারণ, শিক্ষার্থীদের ভর্তি ও পরীক্ষা ফিস কমানো, নতুন শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে ছাত্র ও শিক্ষকের অনুপাত হ্রাস, গবেষণা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানে জগন্নাথের বর্তমান প্রশাসনের আন্তরিকতা লক্ষ্যণীয়।
এসব সাফল্যের পাশাপাশি কিছু সংকটও রয়ে গেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দেশের একমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে উপাচার্যসহ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থা নেই। পুরান ঢাকার কিছু ছাত্রাবাস ছাত্ররা দখল করে ছিল। হল আন্দোলনে চারটি হলের জায়গা শিক্ষার্থীরা উদ্ধার করতে পেরেছে।
একটু পিছনে তাকালে দেখা যায়, এ দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন ও অর্জনের ইতিহাসে এ প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে এখানকার শিক্ষার্থীদের ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ।
ভাষা শহীদ আব্দুর রফিক, সাহিত্যিক আনিসুজ্জামান, কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব এটিএম শামসুজ্জামান, সংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর ছাড়াও অসংখ্য গুণী মানুষ এ প্রতিষ্ঠান থেকেই উঠে এসেছেন।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, অজিত কুমার গুহ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, হায়াত মামুদসহ অনেক গুণী ব্যক্তিত্ব শিক্ষকতা করেছেন এ প্রতিষ্ঠানে।