মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা : একটি দীর্ঘশ্বাস
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: এই বছর আমার পরিচিত একজন মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষা শেষে আমি তাকে ফোন করেছি, জিজ্ঞেস করেছি পরীক্ষা কেমন হয়েছে। সে বলল, পরীক্ষা যথেষ্ঠ ভালো হয়েছে, এই রেজাল্ট দিয়ে তার কোনো একটা পাবলিক মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা আর হবে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন হবে না? সে বলল মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে যারা সেই প্রশ্ন পেয়েছে তারা ৯০-১০০ করে উত্তর করেছে। আমরা যারা লেখাপড়া করে পরীক্ষা দেই তারা খুব বেশি হলে ৭০-৮০ উত্তর দেই।
ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর আমি তার একটি টেলিফোনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সেই টেলিফোন এলো না। আমি বুঝে গেলাম সে যেটা আশংকা করেছিল সেটাই ঘটেছে। যারা ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন দিয়ে ৯০-১০০ করে উত্তর করেছে তারা বেশির ভাগ জায়গা দখল করে নিয়েছে। যারা পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়েছে তারা প্রতিযোগিতায় হেরে গেছে। হয়তো শব্দটা প্রতিযোগিতা না, হয়তো শব্দটা নৃশংসতা। যারা এই বয়সের কিশোর-কিশোরী কিংবা তরুণ তরুণীর স্বপ্ন ধ্বংস করে দেয়, যারা জেনেশুনে সেটা সহ্য করে এই দেশে তাদের থেকে বড় নৃশংস অপরাধী আর কে আছে?
পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে আগে আমি অনেক চেঁচামেচি করেছি কোনো লাভ হয়নি, মন্ত্রণালয় কখনো স্বীকার করেনি, কোনো পরীক্ষা কখনো বাতিলও করেনি- যদিও কিছুদিন আগে এখনকার শিক্ষামন্ত্রী সংসদে বলেছেন যে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস এই সরকারের জন্য জীবন-মরণ সমস্যা! যদি সত্যি এটা এই সরকারের জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে কেন এর সমাধানে কোনো চেষ্টা নেই? জীবন-মরণ সমস্যা সমাধানের জন্য কি জীবন-মরণ চেষ্টা করতে হয় না? আমরা কী সেটা দেখছি? যেন কিছুই হয়নি ঠিক সেভাবেই কি দায়িত্বপ্রাপ্ত সবাই ব্যবহার করে যাচ্ছেন না?
পরীক্ষার পর থেকে আমার কাছে অসংখ্য টেলিফোন এসেছে, এসএমএস এসেছে, ইমেইল এসেছে। আমি যখন আমার টেলিফোন ধরছি তখন শুনেছি অন্যপাশে একজন হাউমাউ করে কাঁদছে। সরকারের নির্লিপ্ততার সুযোগ নিয়ে যখন কিছু দুর্বৃত্ত কারো সারা জীবনের স্বপ্নকে ধ্বংস করে দেয় তখন তার কান্নার শব্দ থেকে কষ্টের আর কিছু থাকতে পারে না। কিশোর, কিশোরী, তরুণ-তরুণীর এসএমএস আর ইমেইল হাহাকার আমি শুনে যাচ্ছি, দেখে যাচ্ছি কিন্তু কিছু করতে পারছি না। একটি অভুক্ত শিশু যখন তার হতদরিদ্র মায়ের কাছে খাবার চায়, মা যখন তার মুখে কিছু তুলে দিতে পারে না তখন সেই অসহায় মায়ের কেমন লাগে আমি সেটা অনুভব করতে পারি।
আমি নিজে সারা জীবন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে এসেছি আমার জীবনে সেই স্বপ্নকে সত্যি হতে দেখেছি। স্বপ্ন পূরণের আনন্দের কথা আমি যে রকম জানি ঠিক সে রকম স্বপ্ন ভঙ্গের কষ্টের কথাও জানি। মানুষ কষ্ট সহ্য করে একসময় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ যদি হতাশায় রূপ নেয় তখন সে আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। এই সরকার পুরো দেশের দায়িত্ব নিয়েছে, দেশের এই তরুণ প্রজন্মের দায়িত্বও তাদের নিতে হবে। প্রশ্ন ফাঁসের এই ভয়ঙ্কর অন্যায় মেনে নিয়ে তারা এই প্রজন্মকে হতাশায় ঠেলে দিতে পারবে না। এখন পুরো ব্যাপারটি অস্বীকার করে দুই বছর পর তারা বলতে পারবে না এটি ছিল জীবন-মরণ সমস্যা! দেশের সবাই জানে কী ঘটেছে, ইন্টারনেটে প্রশ্ন ফাঁসের অসংখ্য প্রমাণ আছে। কিছু দুর্বৃত্বকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। লাখ লাখ নয়, কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। ঠিক করে তদন্ত করা হলে তার সব কিছু বের করা যাবে। একটি রাষ্ট্র প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করতে পারবে না কিংবা প্রশ্ন ফাঁস হলে যারা এটি ঘটিয়েছে তাদের ধরতে পারবে না- আমি সেটা বিশ্বাস করি না। যে সব বড় কর্মকর্তা এই দেশের লাখ লাখ সাধারণ মানুষের সাধারণ ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন তাঁদের নিজেদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে তাঁদের কোনো ভাবনা নেই। অর্থ আর ক্ষমতার জোরে তারা ঠিকই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যায়তনে লেখাপড়া করাবে। তাই দেশের সাধারণ ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁদের এত বড় অবহেলা।
একটা দেশের সবচেয়ে বড় সর্বনাশ করা সম্ভব সেই দেশের তরুণ সমাজকে হতাশার মাঝে ঠেলে দিয়ে- এই সরকার কী জানে, জেনে হোক না জেনে হোক তারা ঠিক এই কাজ করে ফেলেছে! আমি আশাবাদী মানুষ, জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়েও আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখে এসেছি। আমি সরকারের কাছে করজোরে প্রার্থনা করি উটপাখির মতো বালুর ভেতর মাথা গুঁজে থাকবেন না, কী ঘটেছে সেটা তদন্ত করে দেখুন। যদি সত্যি প্রশ্ন ফাঁস হয়ে থাকে তাহলে দুর্বৃত্তদের ধরুন, পরীক্ষা বাতিল করে আবার পরীক্ষা নিন। এ জন্য যে বাড়তি যন্ত্রণাটুকু পোহাতে হবে সেটি এই দেশের তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যতের তুলনায় কিছুই নয়। এই দেশ আমাদের অনেক ভালোবাসার দেশ, যে তরুণ-তরুণীরা এই দেশটিকে গড়ে তুলবে তাদের হতাশার মাঝে ঠেলে দেবেন না। এই পৃথিবীতে সত্যের জয় হয়, অসত্য অন্যায় যত ক্ষমতাশালীই হোক ধুলায় মিশে যায় তাদের সেই বিশ্বাস নিয়ে বড় হওয়ার সুযোগ করে দিন। দোহাই আপনাদের।