ডিগ্রি পাস ও অনার্স কোর্সের এ কী হাল!
- বিমল সরকার
১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত ডিগ্রি পাস, অনার্স এবং মাস্টার্স কোর্স শিক্ষাদানকারী কলেজগুলো ছিল ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন। প্রতিষ্ঠার পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি-বেসরকারি এসব কলেজ অধিগ্রহণ করে। ভারমুক্ত হয় উল্লিখিত তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।
পাকিস্তান আমল, এমনকি স্বাধীনতা লাভের পর একেবারে ২০০০ সাল পর্যন্ত দুই বছরমেয়াদি ডিগ্রি পাস কোর্সের সিলেবাস ছিল ৯০০, ১০০০ কিংবা ১১০০ নম্বরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য (হালের ব্যবসায় শিক্ষা) শাখায় আবশ্যিক বিষয় হিসেবে বাংলা এবং ইংরেজি পড়তে হতো না। ৩০০ নম্বরের তিন পত্রবিশিষ্ট তিনটি ঐচ্ছিক বিষয় পড়ে ডিগ্রি (স্নাতক) সার্টিফিকেট অর্জন করা গেছে। এমনকি বিগত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইংরেজি (আবশ্যিক) না পড়েও কলা শাখার ডিগ্রিধারী হওয়া গেছে। এরপর একে একে সব শাখায়ই (কলা, সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও বিজ্ঞান) ১০০ নম্বরের করে বাংলা ও ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করা হয়। ফলে পাস কোর্সে সব শিক্ষার্থীর জন্যই মোট ১১০০ নম্বর নির্ধারিত হয়। দুই-তিন বছর যেতে না যেতেই ২০০১ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন দুই বছরমেয়াদি পাস কোর্সকে করা হয় তিন বছরমেয়াদি। একই সঙ্গে অনার্সের মতোই পাস কোর্সেও সনাতন পদ্ধতির স্থলে চালু করা হয় কোর্স পদ্ধতি। আর তিন পত্রবিশিষ্ট এক একটি ঐচ্ছিক বিষয়কে করা হয় চার পত্রবিশিষ্ট। ফলে সব শাখায়ই পাস কোর্স আর আগের মতো ১১০০ নম্বরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না। ৩০০ নম্বর যোগ হয়ে মোট ১৪০০ নম্বরে পরিণত হল। এভাবেই চলে একনাগাড়ে দশ/বারো বছর। ২০১৩ সাল থেকে পাস কোর্সে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ নামে ১০০ নম্বরের আবশ্যিক একটি নতুন বিষয় চালু করা হয়। এছাড়া ১২ বছর ধরে প্রচলিত চার পত্রবিশিষ্ট ঐচ্ছিক তিনটি বিষয়কেই করা হয় ছয় পত্রবিশিষ্ট। এ হিসেবে পাস কোর্সের যে কোনো শিক্ষার্থীকে এখন আবশ্যিক স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, বাংলা (আবশ্যিক) এবং ইংরেজি (আবশ্যিক) বিষয়সহ মোট ২১০০ নম্বরের কোর্স পড়তে হচ্ছে। অর্থাৎ বিষয়, কোর্স এবং নম্বর বাড়িয়ে ডিগ্রি পাস কোর্সের আকার ও পরিধি আগের তুলনায় বলতে গেলে দ্বিগুণ করা হয়েছে। আর পরীক্ষার সময় তিন ঘণ্টা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে চার ঘণ্টা; পরবর্তীতে সময় ৩০ মিনিট কমিয়ে সাড়ে তিন ঘণ্টা নির্ধারণ করা হয়। পরিবর্তন আনা হয়েছে প্রশ্নপত্র প্রণয়নের ধরন এবং মান বণ্টনেও। পাস কোর্সে চালু করা হয়েছে ইনকোর্স পরীক্ষা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনার্স কোর্সের পরিস্থিতিটিও বলতে গেলে একই রকম- পাস কোর্স থেকে আলাদা করে দেখার খুব একটা সুযোগ নেই। ইংরেজ আমল, পাকিস্তান আমল, এমনকি স্বাধীনতার পর আশি ও নব্বইয়ের দশকেও বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনার্স কোর্স ছিল তিন বছরমেয়াদি (অবশ্য পঞ্চাশের দশকে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ছিল দুই বছরমেয়াদি)। দুই বছরের মাথায় প্রতিটি ৩০০ নম্বরের করে দুই বিষয়ের মোট ৬০০ নম্বরের সাবসিডিয়ারি এবং তৃতীয় বা চূড়ান্ত বর্ষে একসঙ্গে ৯০০ নম্বরের মূল বিষয়ের পরীক্ষা। তিন বছরে মোট ১৫০০ নম্বরের কোর্স। এখন আর সে হিসেব নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন তিন বছরের অনার্স কোর্সকে করা হয়েছে চার বছরমেয়াদি। প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় বর্ষ, তৃতীয় বর্ষ এবং চতুর্থ বা চূড়ান্ত বর্ষ। অনার্সের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বাংলা (আবশ্যিক) ও ইংরেজি (আবশ্যিক) বিষয়কে। এছাড়া ‘মেজর’ এবং ‘নন-মেজর’ হিসেবে নানা বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে অনার্স কোর্সে। বিষয়-পত্র মিলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে এখন মোট ৩০০০, ৩১০০ বা বিভাগবিশেষে ৩২০০ নম্বরের অনার্স কোর্স পড়তে হয়। অনার্স কোর্সের আকার ও পরিধিটিকেও এখন পাস কোর্সের মতোই সত্তর, আশি বা নব্বইয়ের দশকের তুলনায় বলা যায় একেবারে দ্বিগুণ করা হয়েছে। রয়েছে ইনকোর্স পরীক্ষার বন্দোবস্ত। পরিবর্তন আনা হয়েছে প্রশ্নপত্র প্রণয়নের ধরন এবং নম্বর বণ্টনেও। এছাড়া তত্ত্বীয় এক একটি পরীক্ষার সময়সীমাও নতুন করে নির্ধারণ করা হয়েছে।
ডিগ্রি পাস এবং অনার্স কোর্সের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। নতুন করে বছরভিত্তিক নম্বর বণ্টন করে মোট নম্বরসহ উভয় ক্ষেত্রে বাড়ানো হয়েছে কোর্সের পরিধিও। এছাড়া প্রতিবছর বিষয়ভিত্তিক ইনকোর্স পরীক্ষায় নির্ধারিত ২০ নম্বর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীর উপস্থিতির শতকরা হারের বিষয়টিকেও গুরুত্বসহ দেখা হচ্ছে।
এমতাবস্থায় সঠিকভাবে ডিগ্রি পাস কিংবা অনার্স কোর্স পড়তে এবং পড়াতে হলে কিংবা তদারকি করার বেলায় শিক্ষার্থী আর শিক্ষক যে কারও একেবারে হিমশিম খাওয়ার কথা। অথচ বাস্তবে দেখা যায় বেশিরভাগ কলেজেই নিয়মিত ক্লাস নেই, পড়াশোনা নেই; যা আছে তা কেবল নামমাত্র। আছে কেবল ভর্তি হওয়া এবং সময় হলে ফরম পূরণ করে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া। শিক্ষার্থী হিসেবে এর আগে সাময়িক, অর্ধবার্ষিক কিংবা নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণেরও কোনো দরকার হয় না। ডিগ্রি পাস, অনার্স এবং মাস্টার্স সব কোর্সের ক্ষেত্রেই বলতে গেলে একই পরিস্থিতি। ক্লাসে উপস্থিত না হয়ে বা যথাযথ শিক্ষালাভ না করে ফরম পূরণ, চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ এবং অবলীলায় পাস করে যাওয়াটাই যেন আজকাল শিক্ষার্থীদের তপস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেবল কি পাস? বেশ ভালোভাবেই পাস করে যাচ্ছে হাজার হাজার পরীক্ষার্থী। এজন্যই আজকাল শিক্ষার্থীর পরিবর্তে পরীক্ষার্থী শব্দটির বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় এবং তা বোধকরি যথার্থই।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সরকারি-বেসরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষবিমুখীনতার বিষয়টি সংক্রামক ব্যাধির মতোই যেভাবে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে এর দিকে এখনই সঠিকভাবে দৃষ্টি না দিলে পরিস্থিতিটি যে আরও ভয়াবহ রূপ নেবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এর জন্য দায়ী কে?- এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক এবং আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে বিস্তর। কিন্তু কোনোভাবেই একে অস্বীকার করা যাবে না। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে যেমন তেমন, এর উপরের স্তরগুলোর হালহকিকত একেবারেই নাজুক।
দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস, এমনকি অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য বলে মনে হলেও কথাটি সত্য যে বছরের কোনোদিন একটি ক্লাসেও উপস্থিত না থেকে কিংবা নামকাওয়াস্তে দুই-চার দিন উপস্থিত থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন কলেজের হাজার হাজার শিক্ষার্থী ডিগ্রি পাস, অনার্স এবং মাস্টার্সের মতো এক একটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। অনিয়মিত নয়, ক্লাসে উপস্থিত না হওয়াদের নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবেই বছর বছর এই সুযোগটি করে দিয়ে চলেছে কর্তৃপক্ষ। আর অতি সহজেই সুযোগ পেতে পেতে শিক্ষার্থীদের মাঝে এরূপ ক্লাস না করার প্রবণতা দিন দিন কেবল বেড়েই চলেছে। দিনে দিনে পরিস্থিতিটি যে কী ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তা শিক্ষার সঙ্গে যারা সরাসরি সম্পর্কযুক্ত নন তাদের বোধকরি সহজে বিশ্বাসই করানো যাবে না।
শিক্ষক ক্লাসে (শ্রেণীকক্ষ) ঢুকলেন। হাজিরা খাতায় নাম রয়েছে সত্তর জন শিক্ষার্থীর। উপস্থিত আছে পাঁচজন। অন্য একটি ক্লাসে আরেকজন শিক্ষক গিয়ে দেড়শ’ জনের মধ্যে দেখা পেলেন বারোজন শিক্ষার্থীর। এভাবে কোনো কোনো দিন বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক ক্লাসে গিয়ে কোনো শিক্ষার্থীরই দেখা পান না। দর্শন, সমাজকর্ম, রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর ইতিহাস- বলতে গেলে সব বিষয়ের ক্লাসেরই একই পরিস্থিতি। চক-ডাস্টার এবং হাজিরা খাতা হাতে ক্লাসে গিয়ে কোনো শিক্ষার্থী না পেয়ে প্রায় সময়ই ফিরে আসার বিড়ম্বনাময় অভিজ্ঞতা নেই এমন শিক্ষক বোধকরি একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয়, এটাই কি হওয়া উচিত কোনো দেশের উচ্চশিক্ষার চিত্র? বছরের পর বছর এভাবেই ডিগ্রি পাস বা অনার্স কোর্স পড়তে বা পড়াতে হবে?
বিমল সরকার : সহকারী অধ্যাপক