‘উহান’ থেকে বলছি

‘উহান’ থেকে বলছি

  • গুস্তাভ রুহান

গত ২৯ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের একটি জনবহুল শহর উহানে মরণঘাতী করোনা ভাইরাসের উপস্থিতির প্রমাণ মেলে। প্রথমদিকে ব্যাপারটি তেমন গুরুত্ব না পেলেও সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে করোনা মহামারি আকার ধারণ করে। বর্তমানে উহান ছাড়িয়ে চীনের সবগুলো প্রদেশে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, জাপান, ভারত, সিঙ্গাপুরসহ বেশ কয়েকটি দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করেছে সেখানকার স্বাস্থ্য বিভাগ।

কর্মব্যস্ত উহানে হঠাৎ করেই নেমে এসেছে নীরবতা। নাগরিক ছন্দপতন ঘটায় এক ভূতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়েছে সেখানে। মানুষের পাদচারণায় পরিপূর্ণ সব জায়গাও জনশূন্য, চলছে না কোনো গাড়ি, দোকানপাট বন্ধ করে সবাই ঘরে বসে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু একটার প্রহর গুনছে।

করোনা ছোঁয়াচে ভাইরাস হওয়ায় সহজেই একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পৃথিবীব্যাপী জরুরী অবস্থা জারি করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ভাইরাসের দৌরাত্ম্য কোটি মানুষের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে তারপর থামবে। করোনা ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক তৈরি না হওয়ায় আপাতত সতর্ক থাকা ছাড়া উপায় নেই।

২৯ বছর বয়সী গুও জিং সামাজিক আন্দোলনের একজন কর্মী। তিনিও অন্য সবার মতো বাড়তি সতর্কতার জন্য বাড়িতে অবস্থান করছেন। এমন নাজুক পরিস্থিতির চিত্র লিপিবদ্ধ করেছেন নিজের ডায়েরিতে। সে কথাগুলোই বিবিসির মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দিতে চান তিনি। তার কথাগুলো হুবহু তুলে ধরছি এখানে।

বৃহস্পতিবার, ২৩শে জানুয়ারি: আপাত গৃহবন্দি!

আমি সকালবেলা ঘুম থেকে জেগে উঠি এবং তখনই প্রথম লক-ডাউন সম্পর্কে জানতে পারি। বুঝতে পারছিলাম না আমি কী করব; কারণ লক-ডাউন এর মানে বুঝতাম না আমি। এই পরিস্থিতি কতদিন ধরে চলবে এবং আমাকে কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া উচিৎ; তার কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নজর রাখছিলাম, যাতে সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা ধারণা পেতে পারি। সেখানে অনেকেই মন্তব্য করছে, “ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরও অনেকে জায়গার অভাবে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না। তাই তারা মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।’’ আমার বন্ধুরা আমাকে পর্যাপ্ত মাস্ক মজুদ করার পরামর্শ দিল। এদিকে দোকানগুলোতে চাল এবং নুডলসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

একজন লোক ইচ্ছেমত লবণ কিনে নিচ্ছিল! তা দেখে অন্যরা অবাক হয়ে এত লবণ কেনার কারণ জানতে চাইল। জবাবে লোকটি বলল, “যদি লকডাউন পুরো এক বছর ধরে চলে!’’

আমি একটি ফার্মেসিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেখানে মাস্ক আর জীবাণুনাশকের মজুদ শেষ হয়ে গিয়েছে। ক্রমেই শহরে গাড়ি এবং পথচারীদের আনাগোনা কমে আসছিল। হঠাৎ করেই সেখানে রাজ্যের নীরবতা নেমে এলো। এই শহর আবার জেগে উঠবে কবে?

শুক্রবার, ২৪শে জানুয়ারি: সাদামাটা নববর্ষের প্রস্তুতি 

আমার কাছে মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী যেন থমকে আছে, এমন নীরবতা ভয়ের জন্ম দিচ্ছে মনের ভেতর। যেহেতু আমি একা থাকি তাই করিডোর ধরে যখন কেউ হেঁটে যায়, তখন মনে হয় পৃথিবীতে এখনও মানুষ আছে!

কীভাবে টিকে থাকব- সেটা ভাবার যথেষ্ট সময় রয়েছে, কিন্তু যথেষ্ট রসদ কিংবা আলাপচারিতা করার মতো মানুষ নেই।

আমাকে যেভাবেই হোক সুস্থ থাকতে হবে, সেজন্য দরকার নিয়মিত অনুশীলন। আর অনুশীলনের পর প্রয়োজন হবে খাবারের। তাই সবগুলো দিক বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে আমাকে।

সরকার চলমান অচলাবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানাচ্ছে না আমাদের। লোকজন বলাবলি করছে, এটি মে মাস পর্যন্ত স্থায়ী হবে। আশপাশের ফার্মেসি এবং খাবারের দোকানগুলো বন্ধ রয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, হোম ডেলিভারি সার্ভিসগুলো এখনও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

আজ আমি বাজারে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে রসুনের অঙ্কুর আর ডিম কিনে এনেছি। বাজারে নুডলসের কোনো নতুন চালান আসেনি, তবে চালের যোগান রয়েছে এখনও। বাড়িতে ফিরেই ভালো করে গোসল সেরে নিয়েছি। আর কিছু ধরার পরই হাত পরিষ্কার করে নিচ্ছি। এই সময় ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

বাইরে বেরোতে পারার কারণেই মনে হচ্ছে পৃথিবীর সঙ্গে এখনো আমার যোগাযোগ বজায় রয়েছে। বৃদ্ধ আর প্রতিবন্ধীরা কীভাবে যে এমন পরস্থিতি সামাল দিচ্ছে কে জানে!

আজকের রাতটিই চীনা বর্ষপঞ্জির শেষ রাত। তাই বিশেষ খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করার কথা ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এখন আয়েশ করার মতো অবস্থায় নেই। তাই প্রয়োজনের বেশি রান্না করিনি।

রাতে খাওয়ার সময় বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছিলাম। তাদের অনেকেই উহানের পার্শ্ববর্তী শহরে ছিল। বাড়িতে ফিরে আসতে ভয় পাচ্ছিল তারা, আবার কয়েকজন এত কিছুর পরও একসঙ্গে আড্ডা দিতে উদগ্রীব ছিল। আমরা প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে অনলাইনে মজা করেছি। তখন নিজেকে অনেক সুখী মনে হয়েছে।

কিন্তু ঘুমাতে যাওয়ার পর বিগত কয়েকদিনের ঘটনা মনে করে আর ঘুমাতে পারলাম না। অনেক অসহায় লাগছিল ভেতর থেকে; কান্না করে নিজেকে কিছুটা হালকা করতে চাইলাম। কষ্ট আর হতাশায় আমি মৃত্যুর কথাও ভেবেছিলাম কয়েকবার। কিন্তু নিজের কাছে আমার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। আমার জীবনটা যথেষ্ট অর্থবহ, তাই আমি সময়ের আগেই মরতে চাই না।

শনিবার, ২৫শে জানুয়ারি: একাকী নববর্ষ পালন

আজ চীনা নববর্ষ। দিবস উদযাপনের ব্যাপারে আমার কখনোই তেমন আগ্রহ ছিল না। এবারের নববর্ষ তো আরও বেশি অর্থহীন।

সকালবেলা হাঁচির সঙ্গে কিছুটা রক্ত বেরিয়েছিল। আমি প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, তবে ভাইরাসের উপসর্গগুলো প্রকাশ না পাওয়ায় সাহস পেলাম মনে। বাইরে বের হবো না ভেবেছিলাম, কিন্তু অবশেষে বেরিয়ে পড়লাম। আমার মুখে দুটো মাস্ক পরা ছিল, কারণ পণ্যগুলো নকলও হতে পারে। যার জন্য এই বাড়তি সতর্কতা। যদিও সবাই এটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে। বাইরে গিয়ে তেমন মানুষজনের দেখা পেলাম না।

ফুলের দোকানগুলোর প্রবেশমুখে এমন কিছু ফুল সোভা পাচ্ছিল, যেগুলো কেবল শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে সাজানো হয়। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না তারা কেন এরকম সাজিয়েছে!

সুপার শপে তরিতরকারি বিক্রির তাকগুলো একদম খালি ছিল, সেই সঙ্গে এবারও নুডলসের দেখা পেলাম না। ক্রেতাহীন অলস সময় পার করছিল দোকানীরা।

আমি চাইছিলাম প্রতিবার বাইরে বেরোনোর সময় বেশি করে জিনিসপত্র কিনে বাসায় ফিরতে। তাই আরও আড়াই কেজি চাল কিনলাম, যদিও বাসায় যথেষ্ট মজুদ ছিল। সেই সঙ্গে মিষ্টি আলু, মটরশুঁটি, সসেজ, লবণের প্রলেপ দেওয়া ডিম কিনে নিলাম। যদিও নোনতা ডিম খেতে আমার খুব একটা ভালো লাগ না। তাই ভাবলাম অচলাবস্থা কেটে গেলেই এগুলো বন্ধুদের দান করে দেব!

বাসায় ফিরে দেখলাম আমার ১ মাস চলার মতো খাবার মজুদ হয়ে গিয়েছে! এভাবে খাবারের স্তুপ জড়ো করার ব্যাপারটা পাগলামি মনে হচ্ছিল আমার কাছে। কিন্তু নিজেকেই বা কীভাবে দোষ দেই?

নদীর ধারে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম; দেখলাম অনেকগুলো জুটি সেখানে হাঁটছে। সঙ্গে তাদের পোষা কুকুরকে আনতেও ভোলেনি। আমি এই রাস্তায় তেমন একটা আসতাম না। তাই ভাবলাম আমার মতো তারাও চার দেয়ালে অবরুদ্ধ হয়ে পড়তে চাইছিল না।

রবিবার, ২৬শে জানুয়ারি: নিজের অস্তিত্বের জানান দাও

আমি চলমান অচলাবস্থার প্রথমদিন থেকেই অনলাইন সেন্সরশিপের কারণে তেমন কিছুই লিখতে পারিনি। চীনে অনলাইনে অনেক আগে থেকেই কড়াকড়ি রয়েছে, কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন মনে হচ্ছে আমার কিছুই বলার অধিকার নেই!

আপনার জীবন যখন ওলটপালট হয়ে যায়, তার প্রভাব দৈনন্দিন সব কাজের উপর পড়ে। আমি মোবাইলে অ্যাপ ব্যবহার করি ব্যায়াম করার জন্য। কিন্তু এখন কোনো কাজেই ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারি না।

আমি আজ আবার বাইরে গিয়েছি। যাত্রাপথে কতজন মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে সেটার হিসাব রেখেছি। বাড়ি থেকে ৫০০ মিটার দূরে নুডলসের দোকান, যাত্রাপথে কেবল ৮ জনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে!

উহানে এসেছি আজ ২ মাস হলো, তাই শহরটা ভালো করে না ঘুরেই বাড়ি ফিরতে চাইনি। স্বাভাবিকভাবেই এখানকার মানুষজন এবং বেশিরভাগ স্থান আমার অচেনা।

আজ সর্বমোট ১০০ জনকে রাস্তায় বের হতে দেখেছি। আমাকে আরও বেশি পরিমাণে মানুষের সঙ্গে দেখা দিতে হবে, যাতে তারা আমার ব্যাপারে জানতে পারে। বন্ধুরা, আমি আশা করি ভবিষ্যতে আমরা আবার দেখা করতে পারব, যাতে নিজেদের গল্পগুলো একসঙ্গে বসে বলা যায়।

রাত ৮ টার দিকে হঠাৎ মানুষের সম্মিলিত চিৎকার শুনতে পেলাম ‘’গো উহান!’  নিজেদের জানালাগুলো খুলে দিয়ে তারা কথাটা বারবার বলছিল। এটা শহরের নাগরিকদের মাঝে আশা জাগানোর সংকেত। আমরা কেউ একা নই- এই অনুভূতি ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল এর উদ্দেশ্য।  

মঙ্গলবার, ২৮শে জানুয়ারি: অবশেষে আলোর দেখা পেলাম

আতঙ্কগ্রস্ত হলে মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়। সবার জন্য বাইরে বেরোলে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটা ভালো একটা উদ্যোগ, কিন্তু কখনো কখনো এমন নিয়ম ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ করে দেয়।

বেশ কয়েকজনকে মাস্ক না পরার কারণে গণপরিবহন থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি জানি না কেন তারা মাস্ক পরেনি! হয়তো তারা সামর্থ্যবান নয়, কিংবা তারা ভাইরাসটি নিয়ে কোনো ঘোষণা শুনতে পায়নি।

অনলাইন ভিডিওতে দেখেছি, যাযাবর গোছের লোকদের তাদের ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়ে ঘরগুলো সিলগালা করে দেওয়া হয়েছিল। তাদের আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তবে কিছু পরিবার ভবঘুরে কয়েকজন মানুষকে থাকার জায়গা করে দিয়েছেন।

সরকার চাইলেই প্রতিটি ঘরে মাস্কের যোগান দিতে পারত। এমনকি নাগরিকদের ঘরে অবস্থানের জন্য পুরস্কৃতও করা যায়।

আজ অনেকদিন পর নিজের মনমতো সূর্যের আলোর দেখা পেয়েছি। আমার কমপ্লেক্সের লোকজনদের দেখা পেলাম অবশেষে। কয়েকজন কমিউনিটি কর্মী এসেছেন কমপ্লেক্সের অনাবাসিক নাগরিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে।

শহর জুড়ে অচলাবস্থা চলার কারণে মানুষের বিশ্বাস আর মনোবল ভেঙে পড়েছিল প্রায়। উহান আজ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত; নিজের ভারই বহন করতে পারছে না যেন। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায়  নিজেকে সতর্ক থাকা ছাড়া বেশি কিছু করার নেই আমার।

প্রতিনিয়ত নিজেকে শহরের আরও গভীরে নিয়ে যেতে হবে। নইলে জীবনের কোনো অর্থ থাকবে না। নিজেদের স্বার্থেই আমাদের সামাজিক সম্পর্ক তৈরিতে আরও বেশি করে অংশগ্রহণ করা দরকার। প্রত্যেককেই সমাজের দায়িত্ব নিতে হবে জীবনকে অর্থবহ করে তোলার জন্য। আর এই নিঃসঙ্গ শহরে আমাকে আমার ভূমিকা খুঁজে নিতে হবে শীঘ্রই।

সূত্র: বিবিসি

Sharing is caring!

Leave a Comment