এখনো আলো খুঁজে বেড়ায় তারা

এখনো আলো খুঁজে বেড়ায় তারা

  • আবু রিফাত জাহান

‘সারাবিশ্বের মানুষ যেমন আছে, আমরাও তেমনই আছি, বড্ড কঠিন সময় পার করছি সবাই!’- কথাগুলো বলার সময় চোখ স্থির আর গালের পেশি যেন স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি শক্ত হয়ে ছিল হিজড়া সম্প্রদায়ের জীবন-মান উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা ‘সাদাকালো’- সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা অনন্যা বণিক। দীর্ঘ পরিক্রমায় যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মাঝ দিয়ে তিনি এসেছেন সেখানে কোভিড সংক্রমণের দরুন দেশব্যাপী লকডাউন তার ভাবাবেগের খুব বেশি পরিবর্তন করতে পারেনি। এই প্রতিকূল সময় যে তাদের জীবনে নিত্যসঙ্গী, তবু অকপটে স্বীকার করেছেন তিনি যে কষ্টে আছেন তারাও।

বাংলাদেশে ২০১৩ সালে হিজড়াদের আইনগতভাবে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দেয়া হয়। তবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিললেও, সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই তাদের চলছেই। সেই লড়াইয়ে এই সম্প্রদায়ের যারা নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তাদের মধ্যেই একজন অনন্যা বণিক। তিনি এলজিবিটি কমিউনিটির বন্ধু সংগঠনের যোগাযোগ কর্মকর্তা হিসেবে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি) কাজ করেছেন। ২০১০ সালে হিজড়াদের পরিসংখ্যান বের করার জন্য আইসিডিডিআরবির চালানো জরিপে (সার্ভে) তত্ত্বাবধায়ক (সুপারভাইজার) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

এছাড়া, নিজেকে তিনি একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি ভালোবাসেন। তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমি থেকে নাচের ওপর ডিপ্লোমা করেছেন। পেয়েছেন নানান স্বীকৃতি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে নৃত্যশিল্পী হিসেবে অনুষ্ঠান করেছেন। ২০১০ সালে জার্মান কালচারাল সেন্টার এবং বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সমন্বয়ে আয়োজিত হিজড়া সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অনন্যা দ্বিতীয় হন।

অনন্যা তার কথায় বার বার বলেছেন, তিনি এদেশের হিজড়াদের সামাজিক সম্মান প্রতিষ্ঠা ও জীবন মানের পরিবর্তন করতে চান। তিনি জানেন, কঠিন অর্থনৈতিক সংগ্রামে হিজড়া সম্প্রদায়ের অনেক মানুষকেই বেঁচে থাকতে হয় দেহ ব্যবসা আর ভিক্ষাবৃত্তির উপর নির্ভর করে। তাই বলতে একটুও কার্পণ্য করেননি তিনি, বরং জোর গলায় এই দুঃসময় পার করার আশাব্যক্ত করেছেন। হিজড়ারা সামাজিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কাজ করার অধিকার ভোগ করবে, স্বাভাবিক মানুষ হিসেবেই তাদেরকে দেখবে এইটুকু হলে হিজড়া সম্প্রদায় হয়ে উঠবে স্বনির্ভর।

বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রজেক্টে আওতাভুক্ত করে হিজড়াদের জীবন-মান উন্নয়নের কার্যক্রম চলছে। ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি(উপ-মহাপরিদর্শক) এর গড়ে উত্তরণ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে অনন্যা বণিককে দুইটি পার্লারের মাধ্যমে অসংখ্য হিজড়াদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির প্রচেষ্টা চলছে। অনন্যা তাই আমাদের সমাজের কাছে আহবান জানিয়েছেন এই কর্মপ্রচেষ্টায় সাধুবাদ জানিয়ে আরো এগিয়ে আসার জন্য। তিনি ধন্যবাদ জানাতে ভুলেননি, যাদের আদর্শে তিনি হিজড়া সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ে কাজে নেমেছেন সেই জয়া, কথা আর পিংকি আপাকে।

অনন্যা বর্তমানে ঢাকা জেলার ধামরাই থানায় বসবাসরত আছেন। তবে তার কাজের ব্যাপ্তি সাভার, আশুলিয়া, ধামরাই, মানিকগঞ্জ থেকে পাটুরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। তিনি হিজড়া সম্প্রদায়ের হয়ে সমস্যা নয়, বরং আশার বানী শুনাতে চান বাংলাদেশকে, সাহায্য নয় বরং কাধে কাধ মিলিয়ে কাজ করার সুযোগ চান সকলের সাথে। আর এখানেই অনন্যা বণিকরা তাদের লড়াই, সংগ্রামের মাঝে স্বপ্ন নিয়ে দিনাতিপাত করছেন।

Sharing is caring!

Leave a Comment