সন্তান মাদকাসক্ত, কী করবেন মা বাবা
- নাইমা আনজুম মুন
বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা তরুণ-তরুণীদের মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়া। মাদকাসক্ত হওয়ার ফলে বাবা-মার সাথে সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত এবং এই আসক্তি কাটিয়ে উঠার জন্য বাবা-মার পাশে থাকা অতীব জরুরি।
মাদকদ্রব্যের উপর তীব্র নেশাকে মাদকাসক্তি হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশের পাঠ্য-পুস্তকে যেসব মাদকদ্রব্য অভিহিত করা হয়েছে যা দ্রবণে তরুণ-তরুণীদের স্মৃতিশক্তি লোপ পায়, মাদকের প্রতি আসক্তি ও স্বাভাবিক জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা কমে যাওয়াকে বোঝায়।
ব্যাপক অর্থে যেসব দ্রব্য গ্রহণের ফলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক চিন্তা-ধারার নেতিবাচক প্রভাব ঘটে এবং ওই দ্রব্যের প্রতি ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়ে, যেসব দ্রব্যকে মাদকদ্রব্য বলে। যেমন – সিগারেট, গাঁজা, মদ, হেরোইন, আইস, এলএসডি, ইয়াবা ইত্যাদি হলো মাদকদ্রব্য।
২০১৯ সালে বেসরকারি এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশে মাদকাসক্তের পরিমাণ প্রায় ৭৫ লাখের বেশি এবং ৮০ শতাংশ তরুণ-তরুণী যা ২০২১ সালে এই সংখ্যা আরও ভয়াবহ রূপ নেয়।
জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. অরূপ রতন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সী প্রায় ২৫ লাখ কিশোর যারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। সন্তানদের মাদকাশক্তি থেকে ফেরানোর জন্য বাবা-মাকে মূখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রথমে আপনাকে জানতে হবে কিশোর-কিশোরীরা মাদক কেন গ্রহন করছে?
১. নানা কারণে তারা মাদকসেবন করে থাকে। প্রথমে বন্ধু-বান্ধবের দ্বারাই এই মাদক এর সাথে পরিচয় ঘটে যা বাংলাদেশের এক প্রেক্ষাপটে এক জরিপে দেখানো হয়েছে। চলতি বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান-সংস্কৃতি পরিষদ আয়োজিত মাদকাসক্তি সমস্যায় বাংলাদেশ শীর্ষক এক সেমিনারে বলা হয়, স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শতকরা ৬ ভাগ ছাত্র মাদকদ্রব্য সেবন করে যা বন্ধুদের প্ররোচনার ফলে বা কৌতুহলবশত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাদকের সাথে প্রথম পরিচয় ঘটে সিগারেটের মাধ্যমে। কারণ এটি সহজলভ্য।
২. অনিরাপত্তাবোধ, ট্রেন্ড বা যুগের সাথে তাল মিলাতে অথবা বন্ধুদের সামনে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য ধূমপান করেন। অনেকে যা বয়সের দোষ বলে আখ্যায়িত করেন।
৩. পরিবারে অন্য কোনো সদস্য মাদকসেবন করলে পরবর্তিতে তা সন্তানের উপরও প্রভাব ফেলে। সন্তান তখন মাদক গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয়।
৪. মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি। বাবা-মার ঝগড়া বা শিশুদের অনিরাপত্তাবোধ থেকে হতাশা, দুশ্চিন্তা, ডিপ্রেশন এসব কারণে মাদকসেবন করে।
৫. অতিরিক্ত আবেগপ্রবনতা থেকেও অনেক মাদক গ্রহণ করে।
৬. যে কোনো দুর্ঘটনা বা ট্রমাটিক ঘটনা, নির্যাতনের শিকার হলে।
৭. ধোকা, বিশ্বাসঘাতকতার মতো ঘটনা থেকে অনেকে মাদক গ্রহন করে।
মাদকাসক্তির পরিণাম
১. যারা অল্প বয়সে মাদক নেয়া শুরু করে তাদের পরবর্তিতে এই নেশা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে।
২. মাদকাসক্তের ফলে বিচার-বুদ্ধি লোপ পায় এবং বার বার ভুল সিদ্ধান্তে জড়িয়ে পড়ে।
৩. অনিরাপদ মিলনে জড়িয়ে পড়ে। ফলে বিভিন্ন রোগের সষ্টি হয়।
৪. মানসিক স্বাস্থ্য এতটাই দুর্বল যে তারা প্রতিনিয়ত ডিপ্রেশন, অ্যানজাইটি, এমনকি আত্নহত্যার প্রতি প্রবণতা বেড়ে যায়।
৫. যে কোনো দুর্ঘটনায় পড়তে পারে।
৬. একাডেমিক পড়াশুনা থেকে পিছিয়ে পড়ে। স্মৃতিশক্তি লোপ পায়।
৭. শারীরিক অক্ষমতা, দুর্বলতা, অসুস্থতার জন্য বিভিন্ন রোগ যেহেতু-হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, লিভার ফেইলর, ফুসফুস অকেজো, সিজোফ্রেনিয়া এমনকি মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়।
কী করবেন মা বাবা
এমন অবস্থায় প্রতিটি বাবা-মার উচিত তাদের সন্তানদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করা এবং কেন সে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে তার কারণ খুঁজে বের করা। তাদেরকে আশ্বস্ত করা আপনি তাদের বন্ধু যাতে করে সে আপনাকে ভরসা করে তার মনের কথাগুলো জানাতে পারে নির্ভয়ে। কখনোই ভেবে নিবেন না যে, একবার কথা বলার মধ্যে দিয়েই সব ঠিক হয়ে যাবে এবং আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে শুনবে। আপনাকে সময় দিতে হবে এবং সময় দিতে হবে। এ ধরনের স্পর্শকাতর ইস্যুতে বার বার সন্তানকে মাদক নেয়া শুরু করবে।
মাদকের কুফল বা ভয়াবহ সম্পর্কে তাকে জানান, কিভাবে তার স্বাভাবিক জীবনকে ক্ষতি করছে তা উপলব্ধি করানো এবং তাদের মনে কোনো জেদ সৃষ্টি না করা। কোনো স্পর্শকাতর বিষয়ে বার বার মনে না করিয়ে দিয়ে সেখান থেকে কিভাবে বের হয়ে আসা যায় তা শিখানো। সন্তানের রোল মডেল হয়ে উঠুন যাতে সে আপনাকে বিশ্বাস করে।
এর বাইরে আপনি যা খেয়াল করবেন, আপনার সন্তান কাদের সাথে মিশে, তাদের বন্ধু-বান্ধব চিনে রাখুন। তার মনের খবর রাখুন যাতে সে অনিরাপওাবোধ না থাকে।
কীভাবে বুঝবেন সন্তান মাদকাসক্ত কিনা
১. সে যদি আগ্রাসী আচরণ করে।
২. চুপচাপ থাকে বা নিজেকে সবসময় গুটিয়ে রাখে।
৩. খাওয়া ও ঘুমের তালিকা পরিবর্তন।
৪. শারীরিক গঠন হঠাৎ পরিবর্তন।
৫. মেজাজ এর তারতম্য ঘটে।
৬. হঠাৎ কোন কিছুর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে অদ্ভুত আচরণ করা।
এসব দেখলে সর্তকতার সাথে আগে যাচাই করুন তারপর পদক্ষেপ নিবেন। মনে রাখবেন এই ভয়াবহ নেশার হাত থেকে তখনই আপনার সন্তান বেড়িয়ে আসবে যখন আপনি তার সামনে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিবেন। নিশ্চিত করুন সে যাতে আপনাকে ভরসা করে এবং আপনি তাকে সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর জীবন উপহার দিবেন।