পুঁজিবাদের ইতিবৃত্ত
- মো. তানভীর রহমান
পুঁজিবাদী সমাজ বা ক্যাপিটালিজম নিয়ে আমাদের মনে প্রায়ই অনেক প্রশ্নের জাগান দেয়। কিন্তু সময় করে এর সম্পর্কে সঠিক ধারনাটা আর নেওয়া হয়ে ওঠে না। আমাদের সমাজে পুঁজিবাদী নিয়ে একটি কথার প্রচলন রয়েছে—
“From each according to his ability,
To each according to his capital.”
মানে এমন একটি সমাজ যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করে কিন্তু তারা তাদের মূলধন অনুযায়ী রিটার্ন পায়। অর্থাৎ যে ব্যক্তির সবচেয়ে বেশি মূলধন থাকবে সে সবচেয়ে বেশি লাভ পাবে। তাহলে এবার প্রশ্ন আসতে পারে ‘এটা কোন ধরনের সমাজ? যে ব্যক্তির কাছে বেশি টাকা আছে সে বেশি টাকা পাবে!’ চলুন, সেসব প্রশ্নের উত্তর আর ক্যাপিটালিজম সম্পর্কে কিছু ধারনা আজ জেনে নেয়া যাক।
মূলত, পুঁজিবাদ বা ক্যাপিটালিজম হচ্ছে এমন একটি আদর্শ যেখানে বেসরকারিকরণের প্রচারটাই বেশী হয়। জমি, ক্ষেত্র, কারখানা এবং শিল্পগুলোও থাকে ব্যক্তিমালিকানাধীন। অন্যদিকে, সাম্যবাদ বা কমিউনিজমে এসবের মালিকানা থাকে জনগণের অধীনে অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষই মালিক। আবার সাম্যবাদের মতো, পুঁজিবাদও একটি বিস্তৃত শব্দ ও আদর্শ, যেখানে তাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও রয়েছে মতাদর্শের অনেক উপবিভাগ। এবার আপনি যদি একে আরেকটু বিস্তৃতভাবে দেখেন, দেখবেন সেখানে কিছু জিনিসের মধ্যে মিল রয়েছে যা সব ধরণের মধ্যেও সাধারণ। তাহলে সে মিলগুলো কী?
প্রথমেই বলেছি পুঁজিবাদে বেসরকারিকরণের প্রচারটা একটু বেশী হয় অর্থাৎ প্রথমটি হচ্ছে বেসরকারীকরণ। তারপর দ্বিতীয় হচ্ছে সরকারের ন্যূনতম হস্তক্ষেপ। কারণ অধিকাংশ পুঁজিপতিই বিশ্বাস করে, “Government has no business being in business.” যার অর্থ দাঁড়ায় ব্যবসায় সরকারের কোনো ব্যবসা নেই। এবার তৃতীয়টি। তৃতীয়টি হচ্ছে মুক্তবাজার এবং প্রতিযোগিতা। যে সমাজে বাজার থাকবে মুক্ত আর প্রতিযোগিতামূলক। আর সবশেষে চতুর্থ হলো এমন কিছু যা সহজেই একটি পুঁজিবাদী সমাজে দেখা যায়, “Money begets money” যার অর্থ টাকা থেকেই টাকা হয়। এবার প্রশ্ন হচ্ছে, টাকা থেকে কীভাবে টাকা হয়? শুধু কি তাই? যার যত টাকা সে তত বেশি টাকা পাবে একটি পুঁজিবাদী সমাজে। এসব ব্যাপারেই জানব তার আগে আমরা একটু এর ইতিহাসটা ঘুরে আসি।
পুঁজিবাদের প্রাচীনতম উদাহরণ হল সামন্তবাদ। বলতে পারেন এটি পুঁজিবাদের আদিম রূপ। মূলত এর শুরুটা হয়েছিল দশম শতাব্দীর কাছাকাছি কোনো এক সময়ে। এই সময়টায় জমিদাররা জমি দখল করে বেড়াচ্ছিল, আর জমিতে কাজ করা কৃষক ও শ্রমিক, ফসল ফলানোর জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যে লাভ করত তা বেশির ভাগই ভোগ করত এই জমিদাররা। কিন্তু এটি কীভাবে একটা পুঁজিবাদের উদাহরণ? একটু খেয়াল করে দেখুন, জমির মালিক ছিল জমিদাররা। আর জমিতে পরিশ্রম করত কৃষক ও শ্রমিক। কিন্তু লাভ বেশি ভোগ করত কারা? জমিদাররা।
বর্তমানের পুঁজিবাদও আজ একইভাবে কাজ করে। ধরুন আপনি একটি কোম্পানির কর্মচারী, আপনি সারা দিন কাজ করেন এবং বিনিময়ে মাসিক বেতন পান। কিন্তু কোম্পানি যে লাভ করে তা কোথায় যায়? যদিও আপনার কাছে এটি যায় আসার কিছু নয় তবে কোম্পানির মালিকের কাছে ঠিকই যায় আসার একটি ব্যাপার। অর্থাৎ আপনার আর মালিকের মধ্যে স্পষ্টতই পার্থক্য আছে। এবার একটি কোম্পানির মালিক বলতে আমরা কি বুঝি? সহজ করে যদি বলি, মালিক হচ্ছে সেই ব্যক্তি যিনি কোম্পানির সর্বাধিক সংখ্যক শেয়ার ধারণ করেন। এমনকি যে কেউ শেয়ারবাজারের মাধ্যমে শেয়ার কিনে এর মালিক হতে পারেন। তবে শেয়ারবাজার থেকে শেয়ার কিনে মালিক হন বা বেশি শেয়ার থাকার জন্য মালিক হন, দিন শেষে মুনাফা কিন্তু দুই ধরনের মালিকই পায়। এবার একটু ভেবে দেখুন, একজন কর্মচারী একটি কোম্পানিতে মাসিক বেতনের জন্য কাজ করে কিন্তু কোম্পানির দ্বারা অর্জিত মুনাফা এমন ধরনের লোকদের মধ্যে বিতরণ করা হয় যাঁদের কোম্পানির দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পর্কে ধারনা নেই বললেই চলে। তাহলে এই শেয়ার কে কিনে বা বিনিয়োগ করতে পারে? অবশ্যই যার টাকা আছে সে। তাহলে কি আমরা মিল পাচ্ছি? Money begets money। টাকা দিয়েই টাকা আসে। আমরা আজ এমনই একটি পুঁজিবাদী সমাজে বাস করছি। তবে আমাদের সমাজে প্রত্যেকটা নতুন কাজের উদ্যেগেই কারো না কারো হাত থাকে। আর আমরা তাকে সেই কাজের জনক বলি। তাহলে এই পুঁজিবাদী সমাজ তৈরির জনক কে?
অ্যাডাম স্মিথ। পুঁজিবাদের জনক হিসেবে তিনিই পরিচিত। ১৭৭৬ সালে তিনি এই ‘পুঁজিবাদ’ নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন, নাম “The Wealth of Nations”। বইটিতে তিনি একটি নীতি লাইসেজ-ফায়ারের কথা বলেছেন। এটি একটি ফরাসি শব্দ যার আক্ষরিক অর্থ ‘একা চলে যাওয়া’। সেখান থেকেই সূচনা হয় মুক্তবাজার পুঁজিবাদের। অর্থাৎ সরকারকে অর্থনৈতিক দিকটা ছেড়ে দিতে হবে এবং এতে তাদের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। এডাম স্মিথের এই উক্তিটি আমরা একটু সহজ করে বোঝার চেষ্টা করি।
ধরুন আপনি একটি পিজ্জারিয়া খুলতে চান এবং আপনার প্রতিবেশীও তাই চায়। যদি কোনো তৃতীয় ব্যক্তি আপনাদের দুজনের মধ্যে কোনো হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে আপনাদের মধ্যে কিন্তু খুব আকর্ষণীয় এবং ন্যায্য প্রতিযোগিতা হবে। কারণ কে কার থেকে বেশি ভালো পিৎজা তৈরি এবং কম দামে বিক্রি করবেন তা নিয়েই হবে প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিযোগিতার কারণে, আপনারা উভয়েই নতুনত্ব উদ্ভাবন করবেন এবং নতুনভাবে চিন্তা করবেন যে পিৎজা কীভাবে উন্নত করা যায় এবং কম দামে বিক্রি করা যায় সে সম্পর্কে। অ্যাডাম স্মিথের মতে, এই প্রতিযোগিতা হচ্ছে মুক্তবাজারের অদৃশ্য হাত। যেখানে কেউ কাউকে ভালো কিছু করার জন্য বাধ্য না করলেও বাজারের পরিস্থিতি ঠিকই করছে। অর্থাৎ আপনি শুধুমাত্র আপনার স্বার্থের জন্য কাজ করছেন। আপনি চান আপনার রেস্তোরাঁ বাড়ুক এবং আরো মুনাফা অর্জন করুন। কিন্তু আপনার স্বার্থে আপনার কাজ অন্যদেরও উপকৃত করছে। সমাজের স্বার্থেও আপনি আপনার স্বার্থের জন্য কাজ করেন। এটিই ছিল অ্যাডাম স্মিথের দর্শন। তবে বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদ বা ক্যাপিটালিজমের এত সাফল্য কেন?
এতক্ষণ তো আপনি ভালো পিৎজা বানানোর প্রতিযোগিতা করছিলেন। এই কে কার থেকে বেশি ভালো পিৎজা বানাতে পারে প্রতিযোগিতায় আপনি একটা সময়ে বুঝতে পারলেন আপনার এই দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কিছু লোক দরকার। তখন আপনি কিছু লোক আপনার কাজে নিয়ে নিলেন যেমন পিৎজা ডেলিভারির জন্য একজন, অর্ডার নেওয়ার জন্য একজন, পিৎজা তৈরির জন্য একজন ইত্যাদি। আর এটাকে বলে শ্রম বিভাগ। যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি তার কাজে বিশেষীকরণ করছে আর এই বিশেষায়নের কারণে, উৎপাদনশীলতা এবং দক্ষতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সম্পর্কে অ্যাডাম স্মিথ বলেন—
“The greatest improvement in the productive power of labor, and the greater part of the skill, dexterity, and judgement with which it is anywhere directed, or applied, seem to have been effects of the division or labor’’
বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদের সাফল্যতা অর্জনের এটাই মূল কারণ। প্রত্যেকেই বুঝতে পেরেছিল যে তারা যদি আরও ভালো গতিতে আরও ভালো পদ্ধতিতে কাজ করতে চায় তাহলে তাদের এই শ্রম বিভাগ এবং বিশেষীকরণ প্রয়োজন। অ্যাপল কোম্পানিকেই ধরুন, যদি কোনো ব্যক্তি আইফোন তৈরি করতে চায়, তাহলে তার কিন্তু কয়েক বছর সময় লাগবে। তবে সে যদি এই আইফোনগুলো তৈরির জন্য শ্রমিকদের একটি সমাবেশ লাইন তৈরি করে, যেখানে প্রথম ব্যক্তি স্ক্রিন ফিট করবে, দ্বিতীয়টি স্ক্রু ফিট করবে, তাহলে এই সমাবেশ লাইন একদিনে অসংখ্য আইফোন তৈরি করতে সক্ষম হবে। আর এসব ধারণাগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই শিল্পের বিপ্লব শুরু হয়। যার ফলশ্রুতিতে বড় বড় কারখানা গড়ে উঠে।
তবে এ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। ১৯০২ সালের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনার পরে পুঁজিবাদীতে আসে এক নতুন ধারা। সেসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিনটি বড় ইস্পাত কোম্পানি, কার্নেগী স্টিল, ফেডারেল স্টিল এবং ন্যাশনাল স্টিল, একত্রিত হয়ে জন্ম দেয় ইউএস স্টিলের। যার চেয়ারপারসন ছিল এলবার্ট এইচ গ্যারি আর এটিই ছিল বিশ্বের প্রথম বিলিয়ন ডলারের কর্পোরেশন। কোম্পানিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত মোট ইস্পাতের ২/৩ ভাগ ইস্পাত তৈরি করলেও বাজারে এর প্রতিযোগিতা ছিল। তাই গ্যারি তার সকল প্রতিযোগীদের ডিনারের জন্য আমন্ত্রণ জানায় এবং তাদের জিজ্ঞাসা করে, কেন তারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছে, যখন অন্য কেউ তাদের প্রতিযোগিতা থেকে উপকৃত হচ্ছিল? তাই তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন যে তারা একসাথে কাজ করবেন এবং প্রতিযোগিতামূলক মূল্য বন্ধ করবে। আর এভাবেই বিশ্বের প্রথম বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি একচেটিয়া হয়ে ওঠে। অ্যাডাম স্মিথের তত্ত্ব অনুসারে, মুক্তবাজারের অদৃশ্য হাত কাজ করার এবং জিনিসগুলি ঠিক করার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে, এটি ঘটেনি। যখনই কোনো কিছুর বা কোনো কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার থাকে, তখন এটি ভোক্তাদের জন্য হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর। এবার এই ভয়ঙ্করের মাত্রাটা একটু বোঝার চেষ্টা করি।
মনে করুন আপনি গভীর রাতে একটি গ্রামে আটকা পড়ে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছেন। আর নিকটতম শহর ১০০-২০০ কিমি দূরে। আশে পাশে একটি ট্যাক্সি বাদে কোথাও আর কোনও ট্যাক্সি নেই। আপনি ওই ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন সে যাবে কিনা, সাধারনত আপনি যেখানে যেতে চাচ্ছেন তার ভাড়া ৫০০ টাকা। কিন্তু ট্যাক্সি ড্রাইভার আপনার কাছে ৫০০০০ টাকা চাইল। এখন আপনার কোনো বিকল্প রাস্তাও নেই। অর্থাৎ এখানে এই ট্যাক্সি ড্রাইভার আপনার সাথে একটি একচেটিয়া অধিকার দেখালো। কারণ আপনি এমন একটা পরিস্থিতিতে আটকে পড়েছেন যার একমাত্র উপায় হলো, হয় দাও অথবা সেখানে আটকে থাকো। আর এই অতিরিক্ত আদায় করাটাই কিন্তু পুঁজিবাদে মুনাফা হিসাবে পরিচিত।
অ্যাডাম স্মিথের মুক্তবাজারের অদৃশ্য হাত এবং প্রতিযোগিতামূলক সেই বাজার যে আর নেই তা আমরা আজ আমাদের বাজারের দিকে তাকালে স্পষ্টতই দেখতে পাই। ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে এবং দরিদ্ররা দরিদ্রই থাকছে। অন্যদিকে বড় কোম্পানিগুলো হয়ে উঠছে একচেটিয়া। তাহলে প্রশ্ন আসছে না, পুঁজিবাদের সফল ধারনা আসলে কি ছিল? আজ আমরা পুঁজিবাদের বিপজ্জনক ব্যর্থতাগুলি কি সত্যিকারে দেখতে পাচ্ছি?