লীরার জীবন বদলে দিয়েছে ‘পুস্কাস’

লীরার জীবন বদলে দিয়েছে ‘পুস্কাস’

  • নিলয় বিশ্বাস

মানুষের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া গল্পগুলোতে একটা ‘টর্নিং পয়েন্ট’ থাকে। ব্রাজিলের ফুটবলার ওয়েনডেন লীরার জীবনেও আছে এমন এক টার্নিং পয়েন্ট। লিরার টার্নিং পয়েন্টের নাম ‘পুস্কাস’!

পুস্কাস? সেটা আবার কী? ২০০৯ সালে ফিফা পুস্কাস অ্যাওয়ার্ডের প্রত্যাবর্তন করে। বছরের সব থেকে সুন্দর গোলের জন্য দেওয়া হয় পুস্কাস। পুরস্কারের নামকরণ করা হয় সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ কিংবদন্তি ফুটবলার ফ্রেন্স পুস্কাসের নামানুসারে। ৫২৮ ম্যাচে ৫১২ গোল করে নাম লিখিয়েছেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বেশি গোল করা খেলোয়োডের তালিকায়।

এবার লীরার জীবন বদলে যাওয়ার গল্পে ফেরা যাক। পুরো নাম ওয়েন্ডাল সিলভা লীরা। খেলতেন জিয়োনেসিয়া নামের একটি ক্লাবে। ব্রাজিলীয়ান ক্রিশ্চিয়ান রোনালদো, জেমস রুদ্রিগেজ, নেইমার জুনিয়ার হয়তো ভুলেই গেছেন তারা একবার পুস্কাস জিতেছেন। এত ট্রফি, এত পুরস্কার মনে রাখার সময় কই! তাঁরা মনে রেখেছেন কিংবা রাখেননি, কিন্তু পুস্কাস জেতার ইতিহাসে তাদের নাম লেখা থাকবে সোনার অক্ষরে। লীরা নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবেই অবশ্যই। এঁদের মতো খেলোয়াড়দের পাশে নিজের নাম দেখতে পেয়ে।

লীরা পুস্কাস জিতেছেন ২০১৫ সালে। পুস্কাস জেতার দৌড়ে পিছনে ফেলেছেন আরেক ক্লাব লিজেন্ড লিওলেন মেসিকে! এটা জেতার আনন্দ তাকে হয়তো নিয়ে গেছে তার সর্বোচ্চ প্রাপ্তিতে। দারুন এক বাইসাইকেল কিক থেকে গোল করে জয় করে নিয়েছেন বিশ্বের হাজারো সমর্থকদের মন।

পুস্কাস জেতার আগে ব্রাজিলের দিলেমামা শহরে বাস করতেন লীরা। সে সময় বেকার ছিলেন তিনি। ইনজুরির কারণে খেলতেও পারছিলেন না ঠিকমতো। স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন অবস্থা ছিল তখন। ব্রাজীলের যে নিচু সারির লীগে খেলতেন সেখানে শতকরা ৮২ ভাগ খেলোয়াড়ের বেতন ছিল ২৫০ ডলারের নিচে! ব্রাজিলের মাত্র ৬০টি ক্লাবের পুরো সিজনের ক্যালেন্ডার ছিল। আর বাকী ক্লাবগুলোর শুধু ছয় মাস খেলা থাকত। তাহলে ভাবুন ২৫০ ডলারের কম বেতন পেয়ে ৬ মাস কাটত বেশির ভাগ খেলোয়াড়দের। আর বাকী ৬ মাস বসে বেকার থেকেই জীবন পার করতে হতো তাদের।

সেপ্টম্বর ২০১৫তে লিরা ভেবেছিলেন আত্নহত্যা করবেন। সেই গল্প বলেছেন পুস্কাস জেতার সময় এক সাক্ষাৎকারে: ‘আমি আমার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। প্রতিজ্ঞা করে বের হয়েছিলাম যে আজ আত্নহত্যা করবই করব। গাড়ির গতি যত তোলা সম্ভব, সেটা তুলে প্রায় দুই ঘন্টা ড্রাইড করছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, যদি একটা ট্রাকের সাথে সংঘর্ষ করতে পারতাম!’ লীরা ট্রাকের সাথে নিজের গাড়ি প্রায় বাধিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যগুণে বেঁচে যান সেদিন। তখন বেকার ছিলেন, এমন অবস্থা ছিল যে মেয়ের খাওয়ার জন্য দুধের টাকার জোগাড় করতে পারেনি। ঘটনা ঘটতে শুরু করে দুই দিন পর থেকে। ফিফা পুস্কাস এর ১০ জনের তালিকায়  চলে আসে তার নাম। ‘খবরটা পেয়েই নিজের মোবাইল সুইচ অফ করে দেই। লজ্জা পেয়েছিলাম ভীষণ, অনেকের ফোন আসছিল সেদিন। সবার ফোন রিসিভ করাটাও অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। এরপর দুটি কল আসে মোবাইলে, একটা ছিল সাবেক ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার নাটোর। আরেকটা ছিল একটি কোম্পানির পক্ষে থেকে, জুরিখে ফিফার একটি প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য।

জুরিখে যাওয়ার পর লীরার স্ত্রী লুডমিলা এক খেলোয়াড়কে দেখা বলেই ফেললেন ‘এই দেখ, এই সেই পিচ্চি খেলোয়াড়টা না? যার বিপক্ষে তুমি ভিডিও গেমে খেলেছ।’ সেই পিচ্চি ছিলেন এবার বিশ্বকাপে গোল্ডেন জয়ী লুকা মড্রিক। একটু পর স্বদেশি মার্সেলো নিজে এসে লুকা মডরিক, ক্রিশ্চিয়ান রোনালদোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।

ক্রিশ্চিয়ান রোনালদো ছিলেন লীরার আইডল। আইডলের সাথে দেখা হওয়ার ব্যাপারটাও অনেক আনন্দের ছিল লীরার কাছে। ‘আমি প্রথম সিরিয়াস ইনজুরি থেকে ক্রিশ্চিয়ান রোনালদোকে ফলো করি। রোনালদো খুবই ফোকাস এবং পরিশ্রমী খেলোয়াড়। যেকোনো পরিস্থিতে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা রাখে। আমি আগে থেকেই তার বিশাল ভক্ত ছিলাম, দেখা হবার পর সেটা আরো বেড়ে গেছে। সেদিন তার সাথে সময়টা বেশ উপভোগ্য ছিল।’

সেদিন নিজের আরেকটি প্রতিভা বের করে ফেললেন লিরা। ফিফা গেমস খেলার জন্য ফিফা ফুটবল গেমস চ্যাম্পিয়ন আব্দুল আজিজ আর সেরিয়ার বিপক্ষে ক্রিশ্চিয়ান রোনালদো, মেসি, নেইমারকে আমন্ত্রণ জানানো হলে সবাই প্রত্যাখানকরে বসে। কারণ মাঠের খেলা আর ভার্চুয়াল খেলা আলাদা ব্যপার। লীরা সাহস করে এগিয়ে আসলেন খেলার জন্য। প্রিয় ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ নিয়ে আর সেরিয়ার প্রিয় ক্লাব বার্সালোনাকে হারিয়ে দেন ৬-১ গোলে।

সেখান থেকে ফিরে নাম লেখান ব্রাজিলের সেকেন্ড ডিভিশন ক্লাব ভিলা নোভাতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য! ইনজুরির কারণে ৬ মাস পরেই তাকে ফুটবল ছাড়তে হয়। এর পরে হয়ে যান পুরোদমে ইউটিউবার গেমার। ইচ্ছা ছিল ব্রাজিল জাতীয় দলের জার্সি গায়ে বিশ্বকাপ খেলবেন। কিন্তু স্বপ্নটা স্বপ্ন রয়ে গেছে লীরার। যদিও একবার অনুর্ধ ২০ দলের হয়ে ডাক পেয়েছিলেন। লীরার কাছে এটুকুই প্রাপ্তি। এটা পেয়ে নাকি লীরা অনেক খুশি।

জানুয়ারি ২০১৮তে ব্রাজিলিয়ান রেডিও সাগরেস ৭৩০ এর পক্ষ থেকে ডাক পান রাশিয়া থেকে খেলার লাইভ কমেন্ট্ররি করার জন্য। রাশিয়াতে বিমান থেকে নেমে এন্ট্রি ভিসা নিয়ে ঝামেলায় পড়লেন। জানেন না ইংরেজিতে কথা বলতে। কী করতে হবে সেটা বুঝতে পারছিলেন না! কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছিল না। এভাবে পাঁচ ঘন্টা পার করে দিলেন। অবশেষ পাঁচ ঘন্টা পরে পুস্কাসের কল্যাণে আবারো বিপদ থেকে মুক্তি পেলেন। একজন জোরে চীৎকার করে উঠলো ‘পুস্কাস, পুস্কাস’। লীরার এইটুকুই ইংরেজি জানা ছিল! লীরাও সাড়া দিল উত্তরে। অবশেষে পেলেন রাশিয়া প্রবেশের অনুমতি।

‘এটা অনেকটাই কঠিন আপনি যেখানে যাচ্ছেন সেখানকার সর্ম্পকে কিছুই যখন জানা নেই আপনার, এমনকি কি করতে হবে সেটা পড়ার সক্ষমতা যদি না থাকে। রুশ বা ইংরেজি একটাও আমার জানা ছিল না। আমি প্রায় কান্না করে দিয়েছিলাম…..আমার ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিতেই হবে যে রাশিয়ান ব্যক্তি আমাকে চিনতে পেরছিল।’

লীরার এখন সময় ভালোই যাচ্ছে স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে। আগের সেই অবস্থা আর নেই। পুস্কাস তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।

Sharing is caring!

Leave a Comment