বড় ফুটবলার, বড় মানুষ কান্তে
- রনি আহমেদ
বর্তমানে সবাই তাকে চিনে বিশ্বের সেরা একজন ট্যাকেল মাস্টার হিসেবে। তবে তার শুরুটা যে হয়েছিল আবর্জনার পর্বত থেকে! মাত্র ১১ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে হয়ে যান সংসারে উপার্জনকারী । শুরু করে দেন পরিত্যাক্ত জিনিসপত্র সংগ্রহের কাজ। তবে নিজের স্বপ্নকে ফেলে দেওয়া জিনিসপত্রের মধ্যে হারিয়ে যেতে দেননি। মনের অদম্য শক্তি এবং কঠোর পরিশ্রম দিয়ে মৃত্যুকূপের কিনারা থেকে নিজের স্বপ্নকে রক্ষা করে আজকে তিনি সবার প্রিয় এনগোলো কান্তে।
১৯৮০ সালে সবুজ চারণভূমির সন্ধানে মালি থেকে ফ্রান্সে পাড়ি জমান এনগোলো কান্তে’র বাবা-মা। ১৯৯১ সালের ২৯ মার্চ ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন কান্তে। মালির এক প্রাচীন রাজার নামানুসারে বাবা-মা তাঁর নাম রাখলেন ‘এনগোলো’। তবে তার বাস্তবতা মালির সেই রাজার মতো ছিল না। তাদের থাকার জায়গাটা কোনোভাবেই প্রাসাদ ছিল না। প্যারিসের উপকণ্ঠে তাদের বাসার দেয়ালে কান পাতলে শোনা যেত শুধুই অভাবের দীর্ঘশ্বাস। চার ভাই এবং এক বোনের মধ্যে কান্তে ছিল সবার বড়, তেমনিভাবে তাদের অভাবটাও আরো বড় হতে থাকে ।
তাদের পায়ের নিচের মাটি শক্ত হবার আগেই কান্তের মাত্র ১১ বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। মায়ের টিকে থাকার সংগ্রামে পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে মায়ের এক মাত্র সঙ্গী হতে বাধ্য হলেন কান্তে। শুরু করে দেন পরিত্যাক্ত জিনিসপত্র সংগ্রহের কাজ। পূর্ব প্যারিসের রাস্তা ধরে মাইলের পর মাইল হাঁটতেন, আবর্জনার স্তূপ দেখলেই দৌড়ে যেতেন। আবর্জনার স্তূপ থেকে বোতল-কাগজ সংগ্রহ করতেন। দিনশেষে এসব থেকে যে কটা টাকা পেতেন তা দিয়ে সাহায্য করে যেতেন পাঁচ ভাই-বোনের সংসারে।
ফুটবল ভালোবাসতেন। তার এই ভালোবাসাটাই বদলে দিয়েছে কান্তের জীবনকে। কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই জনাকয়েক বন্ধুকে নিয়ে শুরু করে দিতেন ফুটবল খেলা। খেলার মধ্যে ফুটবল পায়ে কান্তেকে আটকানো ছিলো অসম্ভব। তবে নিজে গোল করবার চেয়ে সতীর্থদের গোল বানিয়ে দেবার মাঝেই রাজ্যের আনন্দ খুঁজে পেতেন কান্তে। তখন পর্যন্ত কান্তের ফুটবল খেলাটা ছিল শখের বশেই। তবে ১৯৯৮ সালে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ জয়ের প্রধান নায়ক জিনেদিন জিদান বদলে দিলো কান্তের চিন্তাভাবনার চারপাশ। কান্তের মতোই জিদান ও যে ছিলেন আফ্রিকান অভিবাসী বাবা-মায়ের সন্তান। কান্তেও সেদিন থেকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। একদিন তিনিও মাথার উপরে তুলে ধরবেন সোনালী ট্রফিটা ,যাতে করে প্যারিসের সব প্রান্তে কান পাতলেই তার নাম শোনা যাবে।
সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে মাত্র আট বছর বয়সে সারাসনের বয়সভিত্তিক ফুটবল দলে পা রাখলেন। আবর্জনা সংগ্রহের ফাঁকে ফাঁকে ১২ বছর ধরে সারাসনের এই বয়সভিত্তিক দলে খেলে গেলেও নজরে পড়েননি কখনো কোন বড় দলের। তবে বয়সভিত্তিক দলের ট্রফি এনে দেওয়ার মূল কারিগর ছিলেন তিনিই। প্রতিভা থাকলেও বরাবরের মতো চুপচাপ স্বভাবের কারণে প্রচার-প্রচারণা ভাগ্যে জোটেনি। একটি পেশাদার ক্লাবে যোগ দিতে না পারায় একসময় তার ফুটবল ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তেও পৌঁছেছিল। একটা পেশাদার ক্লাবে যোগ দেওয়ার জন্য কান্তেকে অপেক্ষা করতে হয়েছিলো ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত। ২০১০ সালে তিনি নাম লেখান দ্বিতীয় সারির দল বেলোনে। যেখান থেকে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরবর্তীতে কান্তেকে বিনা পয়সায় দলে ভেরাল দ্বিতীয় বিভাগের আরেক দল কায়ে। নতুন দলে এসেও নিজেকে মানিয়ে নিতে সময় নেননি। দুর্দান্ত ফিটনেসের কল্যাণে ৩৮ লীগ ম্যাচের প্রত্যেকটিতে মাঠে নামলেন, লীগে তৃতীয় হয়ে কায়ে প্রথমবিভাগে খেলার সুযোগ পেলো। স্বপ্ন তাহলে সত্যি হয়ে আসতে চলেছে কান্তের সীমানায়!! তবে এরপর যা ঘটল কান্তে নিজেও বোধহয় এতটা আশা করেননি। কান্তের এবার ডাক চলে এলো ইংলিশ চ্যানেলের ওপার থেকে।
আট মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে চব্বিশ বছর বয়সী কান্তেকে দলে ভেড়াল লেস্টার সিটি। কান্তেকে দলে ভেড়ানোর পরেই ১১১ বছর বয়সী লেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাব নিজেদের ইতিহাসে প্রথম ইংলিশ লীগ শিরোপা জিতে নিলো। এছাড়াও কয়দিন আগে ম্যানসিটিকে হারিয়ে চেলসির চ্যাম্পিয়ন লীগ ট্রফি জয়ের মূল নায়ক ছিলেন সেই কান্তেই। ২০১৮ তে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়ের ও মূল চরিত্র থেকে মূল নায়কের ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন এই কান্তে। ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়ের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল তাঁরই। চেলসির চ্যাম্পিয়ন লীগ ট্রফি কিংবা ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়ের মূল নায়ক হলেও ট্রফিটা নিজের মতো করে ছুঁয়ে দেখেন না। অনেক বড় কিছু হবার পরেও ইন্টারভিউতে বলেন, বড় কিছু ছুঁয়ে দেখতে তিনি নাকি লজ্জাই পান।
কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আয় করলেও কান্তে জীবনযাপন করেন অত্যন্ত সাধাসিধাভাবে। লেস্টার সিটিতে খেলাবস্থায় সেকেন্ড হ্যান্ডের মিনি কুপারটা এখনো তিনি চালান। কান্তের ভক্তদের প্রতি ভালোবাসাও বাদ পড়ে না। এই তো একবার তিনি হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন তার এক অসুস্থ ভক্তকে দেখতে। কিংবা ফ্রান্সে বসবাসকারী এক বাংলাদেশী ভক্তের বাড়িতে ডিনারে গিয়েও উপস্থিত হয়েছিলেন কান্তে। এছাড়াও কান্তে স্বীকার করেন, ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের পুরোটা খেলেছেন রোজা রেখে কিংবা গত রমজানে তাকে তারাবির নামাজেও দেখা গেছে।
ট্যাকেল, রানিং কিংবা পাসিং; তর্ক সাপেক্ষে কান্তে বিশ্বের সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। চেলসি এবং ফ্রান্সের মাঝ মাঠের প্রাণ এই ফুটবলার। খেলোয়াড় হিসেবে যতটা না বড় কান্তে, মানুষ হিসেবে তার চাইতেও বড় কান্তে। কারণ, আকাশ ছুঁয়েও তার পা এখনো যে মাটিতেই!