দিদিয়ের দ্রগবা: এক স্বপ্নবাজ ফুটবলার
- পুলক বিশ্বাস পার্থ
মানুষ মাত্রই স্বপ্নবাজ। ছোট থেকে শুরু করে সাধ্যের বাইরের স্বপ্ন দেখতেও মানুষ পিছপা হয়না। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারলে মানুষ হয়তো তার স্বপ্নের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে। ঠিক তেমনই ফুটবলার বা যেকোনো ক্রীড়াবিদের দৌড় সচরাচর মাঠ পর্যন্তই দেখা যায়। ২১ শতকে মাঠে থেকে রাজত্ব করা অন্যতম ফুটবলার দিদিয়ের দ্রগবা, যিনি শুধু দেশের ফুটবল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ না থেকে চলে গিয়েছিলেন নিজের দেশের প্রত্যেকটি ঘরে, আইভরি কোষ্টের পুরো জাতিকে গেঁথেছিলেন এক সুতোয়।
১৯৭৮ সালের ১১ই মার্চে আইভরিকোস্টের আবিদজানে জন্ম নেন দিদিয়ের দ্রগবা। ৬ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় হওয়ার দরুন স্বভাবতই পরিবারের দায়িত্বের চিন্তা ছোটবেলা থেকেই তাড়া করতো তাকে। যদিও তাদের পুরো পরিবারের সাথে ফুটবলের পরিচিতি আগে থেকেই থাকার কারণে তার ফুটবলে নাম লেখাতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি।
আইভরিকোস্টে জন্ম নিলেও দ্রগবার ফুটবলের হাতেখড়ি হয় ফ্রান্সে। ৫ বছর বয়সেই ফ্রান্সে বসবাসরত তার এক চাচার কাছে চলে যান তিনি। সেখানে পাঠ চুকিয়ে ১৯৯১ সালে পুরো পরিবারসহই স্থায়ী হন সেখানে।
পেশাদার ফুটবলে দ্রগবার পদচারণা ২১ বছর বয়সে, ফ্রান্সের সেকেন্ড ডিভিশনে খেলা ক্লাব লা মাঁসের হয়ে চুক্তিবদ্ধ হন তিনি। সেখানে খুব একটা সফল বলা চলেনা দ্রগবাকে। তিন বছরে গোলের দেখা পান মাত্র ১২টি। তারপরও লীগ ওয়ানের ক্লাব গুইনগ্যাম্পের কোচের নজরে আসেন সেই উঠতি বয়সের দ্রগবা। তার জয়ের জন্যে আগ্রাসী মনোভাব দেখে নিজের দলে টেনে নেন তিনি।
গুইনগ্যাম্পেও শুরুতে দ্রগবা হতাশ করেন তার কোচকে। প্রথম মৌসুমটা পুরোটাই ইঞ্জুরির কারণে প্রায় পুরো সময়টায় বেঞ্চে বসে থাকতে হয়েছে তার। তার পরের মৌসুমে নিজের নতুন রূপে ফিরে আসেন দিদিয়ের দ্রগবা। সেবার ৩৪ ম্যাচে ১৭ গোল করে লীগের সর্বোচ্চ স্কোরারের খেতাব নিজের করে নেন তিনি।
দেশের জার্সিতে সবসময় আইকন ছিলেন দিদিয়ের দ্রগবা। সালটা তখন ২০০৫, বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব চলছিলো আফ্রিকার দেশগুলোতে। সুদানকে হারিয়ে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলার সুযোগ পেলো আইভরি কোষ্ট। ওদিকে পুরো আইভরি কোষ্টে তখনো চলছে ২০০২ থেকে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ। দেশের উত্তর খন্ড ছিলো বিদ্রোহী মুসলিমের দখলে এবং দক্ষিণ ভাগ ছিলো ক্ষমতাসীন খ্রিস্টান দলের লোকজনদের। প্রথমবারের মত বিশ্বমঞ্চে সুযোগ পেলেও সারা দেশজুড়ে তখন রক্তের ছাপ।
সুদানকে হারিয়ে ড্রেসিংরুমে আইভরির প্লেয়ারদের বাঁধভাঙা উল্লাস ছিলো দেখার মত। সবাই একসাথে উদযাপন করছিলো সেই মুহূর্তকে, একজন ছাড়া। ড্রেসিংরুমের এক কোনায় চুপচাপ বসে ছিলেন দেশের ফুটবল আইকন দিদিয়ের দ্রগবা। তার মাথায় ঘুরছিলো অন্যকিছু। আচমকা উঠে দাঁড়ালেন, সবাইকে থামতে বলে চলে গেলেন মিডিয়া রুমে। ড্রেসিংরুমে ডেকে নিয়ে আসলেন সবধরনের মিডিয়া চ্যানেলকে। সেখান থেকে খেলোয়াড়দের সরাসরি সম্প্রচার দেখছিলো সারা দেশ। সবাইকে নিয়ে মেঝেতে হাটু গেড়ে বসে পড়লেন দ্রগবা।
মাইক্রোফোন হাতে পুরো জাতির সামনে হাতজোড় করে বললেন, “আমার আইভরির বন্ধুরা, উত্তর থেকে দক্ষিণ এবং পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সবাইকে বলছি, আজ আমরা প্রমান করেছি যে আমরা আইভরিয়ানরাও একসাথে থাকতে পারি এবং একই জিনিসের জন্যে লড়াই করতে পারি। আজ আমরা বিশ্বকাপ নিশ্চিত করেছি। আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে আমরাই একমাত্র দেশ যারা কিনা তাদের ঐশ্বর্য শুধুমাত্র এই গৃহযুদ্ধের কারণে হারাতে যাচ্ছি। আমি আপনাদের সামনে হাত জোড় করে বলছি, দয়া করে আপনারা অস্ত্র ফেলে দিন। আপনারা ভোটের ব্যবস্থা করুন। তা আমাদের জন্যেই মঙ্গলকর হবে।”
কিছুদিন পর ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ থেকে ডাকা হয় তাকে। সেখানকার সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, “আমি যা বলেছি তা সবই আমার মন থেকে এসেছিলো। আমাদের সব ফুটবলাররা দেশের ওই সমস্যাটাকে ঘৃনা করতো। বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া ছিলো একটা অসাধারণ আবেগের জায়গা, যেখান থেকে আমরা দেশের মানুষদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। আমাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই দুপক্ষই সাময়িক চুক্তিতে এসেছিলো।”
২০০৮ সালে আফ্রিকা কাপ অব ন্যাশন্স কোয়ালিফায়ার ম্যাচের ভেন্যু পড়লো মাদাগাস্কারে। তখনো ঠান্ডা হয়নি পুরো দেশ। দ্রগবা নিজে কতৃপক্ষকে অনুরোধ করেন যাতে ম্যাচটা বৌয়াকা শহরে অনুষ্ঠিত হয়। দ্রগবা আবারো ডাকলেন দুই পক্ষকে। দ্রগবা বললেন তিনি একদিনের জন্যে হলেও শান্তি চান। আরো একবার পুরো দেশ পুনরায় থেমে গিয়েছিলো। নিরাশ করেনি দ্রগবারা। ৫-০ গোলে জয় তুলে নেয় এলিফ্যান্টরা। ম্যাচের পর মাঠে নেমে আসে হাজারো দর্শক।
অনেকদিন পর সেই ম্যাচ সম্পর্কে দ্রগবা বলেন, “ম্যাচটা হয়ে উঠেছিলো দুই পক্ষের শান্তি চুক্তির প্রতীক! দুই পক্ষের সৈন্যদলকে আমি একসাথে ম্যাচটা উপভোগ করতে দেখেছি। আমি এটাও বলতে শুনেছি যে, ‘দ্রগবা যদি বৌয়াকোতে থাকে তার মানে হচ্ছে আমরা নিরাপদে বাড়ি পৌঁছাতে পারবো।’ এটা ভাবতেও অসাধারণ লাগছিলো যে একজন ফুটবলারও দেশের প্রতি কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে!”
ব্রিটিশ এক সাংবাদিককে তিনি বলেছিলেন, “ক্যারিয়ারে কোনো অর্জনই আমাকে নিজ দেশের গৃহযুদ্ধ থামানোর চেয়ে বেশি আনন্দ ও মর্যাদা দেয়নি।”
শুধুমাত্র আফ্রিকানই না, ফুটবলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবেও নিজেকে চিনিয়েছেন দ্রগবা। ইতিহাস যাকে জানবে নিজ দেশের যুদ্ধ থামানোর জন্যে অবতার রূপে নেমে আসা এক ফুটবলার হিসেবে, যিনি পরবর্তীতে আখ্যা পেয়েছিলেন ‘দ্য আফ্রিকান কিং’ নামে। তিনি শুধুমাত্র একজন ফুটবলার হয়েও পরিচয় পেয়েছিলেন একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হিসেবে।