হিলাসবোর ট্র্যাজেডি: ফুটবলের কালো রাত
- পুলক বিশ্বাস পার্থ
আজ থেকে প্রায় ৩৩ বছর আগে ঘটে যাওয়া হিলসবোরোর সেই ট্র্যাজেডি, যাকে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম মর্মান্তিক দিন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ঠিক কি ঘটেছিলো সেদিন? ফুটবল ম্যাচ দেখতে এসে কেনো ৯৬ জনের ইহলোকের মায়া ত্যাগ করতে হলো?
সেসময়ে নিয়মানুযায়ী এফএ কাপের সেমিফাইনালের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হত নিরপেক্ষ ভেন্যুতে। ১৯৮৯ সালে শেফিল্ড ওয়েডনেসডে ক্লাবের হোমগ্রাউন্ড হিলসবোরো স্টেডিয়ামকে লিভারপুল বনাম নটিংহ্যাম ফরেস্টের মধ্যকার সেমিফাইনাল ম্যাচের জন্যে নির্বাচন করা হয়।
ম্যাচ শুরুর আগে থেকেই লিভারপুল সমর্থকরা তাদের জন্য নির্ধারিত লেপিংস লেন স্ট্যান্ডের দিকে ধরে এগোতে থাকে। সবসময়ের মত সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ এড়াতে দুই দলের সমর্থকদের গ্যালারি ভাগ করে দেয়া হয়েছিলো। এই লেপিংস লেন স্ট্যান্ডে প্রবেশের একটাই পথ থাকার কারনে প্রচুর পরিমানে ভিড় বাড়তে থাকে এবং হুলস্থুল অবস্থার শুরু হয়। সামনের ভিড়ের জন্যে দর্শকদের প্রবেশের গতি একেবারেই কমে যায়। এদিকে ভিড় সামাল দিতে যখন পুলিশ ব্যর্থ হচ্ছে তখন অন্যদিকে বাইরে তখনও প্রচুর দর্শক ভেতরে ঢোকার জন্যে দাঁড়িয়ে।
লেপিংস লেন স্ট্যান্ডের প্রবেশমুখে ৭টা সংক্রিয় ঘূর্ণায়মান গেট ছিলো যা দিয়ে প্রায় ১০ হাজার দর্শক প্রবেশ করতে পারতো। দর্শকদের বিশাল একটা অংশ এর মধ্যেই সেন্ট্রাল প্যানেল দিয়ে এগোতে থাকার কারনে গেটমুখী দর্শকদের গতি আরো কমে গিয়ে চরম মাত্রার ঠাসাঠাসি তৈরী হয়। সময় যত যেতে লাগলো ততই সাথে দর্শকদের উপস্থিতি বাড়তে লাগলো। এমতাবস্থায় চিফ সুপারিন্টেনডেন্ট ডাকনফিল্ডের খেলা শুরুর সময় পেছানোর আবেদন নাকচ করে দেন পুলিশ প্রধান। দর্শকদের সেই চাপ কমাতে ডাকেনফিল্ড স্ট্যান্ডিং বরাবর একটা এক্সিট গেট খুলে দেবার আদেশ দেন।
এক্সিট গেট খুলে দেয়া মাত্রই দর্শকদের সেই প্রবল ভিড় কোনো ধরনের নির্দেশনা ছাড়াই এগোতে থাকে সামনের দিকে। অধিকাংশ দর্শক ৩ ও ৪ নং স্ট্যান্ডের দিকে এগোতে থাকে। কিন্তু বাধ-সাধে আরেক জায়গায়। কোনো প্রকার দিক নির্দেশনা না থাকার কারণে সেই দর্শকদের ভিড় জানতো না যে স্ট্যান্ড দুটো ইতোমধ্যেই পরিপূর্ন হয়ে আছে। সেখানে তিল ধারনেরও জায়গাটাও ছিলো না, অন্যদিকে এক্সিট গেট দিয়ে ঢুকে সেখানেই উপস্থিত হয়ে যায় অনেক বেশি সংখ্যক দর্শক। ওদিকে একদম পেছনে থাকা দর্শকরাও খেলা দেখার জন্যে চরম উদ্বিগ্ন। খেলা দেখার জন্যে তারা পেছন থেকে তাদের সামনের দর্শকদের প্রবলভাবে চাপ দিতে থাকলো।
কিন্তু সামনে তিল পরিমান জায়গা না থাকার কারনে পিছের মানুষদের চাপের ফলে সামনে থাকা বেষ্টনীর সাথে লেগে গিয়ে চ্যাপ্টা হতে থাকলো সামনে থাকা মানুষগুলো। অন্যদিকে পিছন থেকে ধাক্কার পরিমান ক্রমাগত বাড়তেই থাকলো। ঠিক সেই সময়ে জীবন বাঁচাতে অনেকে গ্যালারির বেষ্টনী বেয়ে উপরের স্যান্ডে উঠে যেতে চাইলো, পারলো না। একপর্যায়ে সেই প্রবল চাপ সহ্য করতে না পেরে ভেঙ্গেই গেলো বেষ্টনী!
খেলার বয়স সবেমাত্র ৭ মিনিট। আকাশ থেকে পিঁপড়ার মতো একের পর এক লিভারপুল ভক্ত নিচের দিকে পড়া শুরু করলো। দর্শকরা পেছন থেকে আরো চাপ দিয়ে সামনের এগোনোর চেষ্টা করতে থাকলে মাঝের সবাই সামনের দিকে চলে আসতে থাকলো। প্রচণ্ড চাপে পদদলিত হয়ে সেইখানেই মারা যান অনেকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনার জন্যে কিছুক্ষণের মধ্যে মাঠে পুলিশ ঢুকে পড়ে এবং রেফারীকে খেলা বন্ধ করার নির্দেশ দেয়।
প্রথমেই খেলোয়াড়দের নিরাপদ অবস্থানে সরিয়ে নেন তারা এবং আহতদের জন্যে তখনই মাঠে এম্বুলেন্স ঢুকে পড়ে। সেসময়ে পদদলিত হয়ে এত বেশি পরিমানে দর্শক আহত হয়েছিলো যে তাদের অপসারণ করতে হিমশিম খাচ্ছিল পুলিশবাহিনী। এমতাবস্থায় সাধারণ সমর্থকরাও এগিয়ে আসে পুলিশকে সাহায্য করতে। স্ট্রেচারের কমতি দেখা দিলে বিজ্ঞাপন বোর্ডকে স্ট্রেচারের মত করে ব্যবহার করে তারা আহতদের অপসারণ করে এবং সেখানেই প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু হয়। বেশিরভাগ দর্শকই ভিড়ে চাপা পড়ে আহত হয়। পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে থাকে লাল-সাদা স্কার্ফ, লাল-সাদা টুপি আর লাল-সাদা পতাকা।
আহতদের সঙ্গে সূর্যও সেদিনের মত বিদায় নেয়। পরিসংখ্যানে জানা যায় ঘটনাস্থলেই প্রান হারায় ৯৫ জন। আহতদের সংখ্যা গিয়ে ঠেকে ৭৬৬ জনে। এই হিলসবোরো দুর্ঘটনার পর ৪ বছর কোমায় থেকে মারা যায় আরেকজন দর্শক। মৃতের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় তারা ৯৬ জন, যার মধ্যে বেশিরভাগ ছিল তরুন দর্শক। আহতদের থেকে অনেকেই দীর্ঘদিন অথবা পরবর্তীতে আজীবনের জন্যে কোমায় চলে যায়।
মৃতদের মধ্যে বয়স ৩০ বছরের নিচে ছিলেন ৭৮ জন! ৩৮ জন ছিলেন ২০ বছরের কম! মোট ৮৯ জন পুরুষ, নারী ছিলেন ৭ জন। সেই ৭ জনের মধ্যে ছিলেন দুই বোনও। একইসঙ্গে দুই ছেলেকে হারানোর শোক সয়েছে ৬টা পরিবার! সেদিন ৯৬ জনের ৯৪ জনের মৃত্যু সেদিনই হয়।
আশির দশকে দশকে সব মিলিয়ে মোট ৫টা সেমিফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় সেই হিলসবোরো স্টেডিয়ামে। ১৯৮১ -এর টটেনহাম আর উলভারহ্যাম্পটনের ম্যাচে সেই লেপিংস স্ট্যান্ডের ছাদ থেকে পড়ে আহত হয় ৩৮ জন। অপয়া উপখ্যান শুরু হয় স্টেডিয়ামটার।
পুলিশ নিজেদের পরিষ্কার রাখার উদ্দেশ্যে সব দায় চাপায় সমর্থক তথা দর্শকদের উপর। সেদিনে দর্শকদের নিরাপত্তার ভার ছিলো ইয়র্কশায়ার পুলিশ বিভাগের প্রধান অধীক্ষক ডাকেনফিল্ডের উপর। তাদের বক্তব্যে তারা পরিষ্কার জানিয়ে দেন যে দর্শকদের শুধুমাত্র তাড়াহুড়োয় কারণে এই দুর্ঘটনা। তিনি আরো বলেন, দর্শকরা মাতাল ছিলো। তারা তাদের হুশ হারিয়ে গেলেছিলো।
পুলিশ এরপরেও দাবী করে, মৃতদেহ এবং পুলিশের উপর মূত্র বিসর্জন, মৃতদেহ থেকে মানিব্যাগ সহ মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি করে লিভারপুল ভক্তরা এবং তারা পুলিশকেও উদ্ধারকাজে বাধা দেয়। নিজেদের দোষ ঢাকতে সব দোষ চাপায় দর্শকদের উপর, দাবী করে তারা ছিলো উগ্র। মদ্যপ অবস্থায় থাকার জন্যেই এমন দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু যাদেরকে মদ্যপ বলে পুলিশ দাবী করে তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলো কিশোর।
অবশেষে ২৭ বছরের অতিবাহিত হওয়ার পর ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিচার বিভাগের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ তদন্তের পর সেই মামলার রায় দেয়া হয়। ৯ সদস্যের বানানো জুরিবোর্ড তাদের রায়ে বলেন, সেদিনের সেই ৯৬ জন্যের মৃত্যু শুধুমাত্রই একটা দুর্ঘটনা ছিলো না। এটা ছিলো পুলিশের দায়। অতঃপর আদালত তার পর্যবেক্ষণ শেষে বলেন সেদিনের অমন ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরী হয়েছিলো পুলিশের ভুলেই। ম্যাচের কমান্ডিং অফিসারের ভুল সিদ্ধান্তেই বেষ্টনী ভেঙ্গে পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছিলো লিভারপুল ভক্তরা। এই রায়ের মাধম্যেই দায়মুক্ত হয় ভক্তদের বিদেহী আত্মা, তাদের পরিবারসহ সকল লিভারপুল ভক্ত।