আইফোন কেন এত জনপ্রিয় ?
- বিজ্ঞান প্রযুক্তি ডেস্ক
অ্যাপল ভার্চ্যুয়াল কি-বোর্ডযুক্ত ট্যাবলেট কম্পিউটার তৈরির পরিকল্পনা করেছিল গত দশকের শুরুতে। প্রযুক্তির ভবিষ্যৎদ্রষ্টা প্রয়াত স্টিভ জবসের এ প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীরা সে সময় নিজেদের ফোন নিয়ে ছিলেন মহাবিরক্ত। সেই বিরক্তি ঝাড়তে গিয়ে প্রকৌশলীদের মাথায় বুদ্ধিটা খেলে যায়—আইপ্যাডের বদলে একই সুবিধাসম্পন্ন ছোট আকৃতির একটি ফোন বানালে কেমন হয়?
অ্যাপল প্রকৌশলীদের সেই ভাবনা থেকেই আইফোনের জন্ম ২০০৭ সালের ২৯ জুন। বাকিটা ইতিহাস। গত এক দশকে আইফোনের সমান জনপ্রিয়তা পায়নি আর কোনো ফোন। যেমন ধরুন, আইফোন ৬ মডেলের জন্য প্রায় ৭ কোটি পিস প্রি-অর্ডার পেয়েছিল অ্যাপল। আর কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের ফোন বাজারে আসার আগে এতসংখ্যক আগাম ফরমাশ পায়নি।
এখানেই শেষ নয়। ২০১০ সালে সিডনিতে যেদিন আইফোন বের হলো, সেদিন ভোর চারটা থেকে অ্যাপল স্টোরের সামনে লম্বা লাইন। অথচ দোকান খুলবে সকাল ১০টায়। লাইনে দাঁড়ানো সবাই সেদিন আইফোন কিনে বাড়ি ফিরতে পারেনি। তার আগেই দোকানের স্টক শেষ! পরের বছর অ্যাপলের বেশির ভাগ স্টোরে নতুন আইফোন পাওয়া যায়নি। কারণ, ফ্যাক্টরি থেকে যে কয় পিস বেরিয়েছিল, তা আগাম ফরমাশের সরবরাহ করতেই শেষ। পৃথিবীতে আর কোনো ফোনই বাজারে আসার আগে ফুরিয়ে যায় না। ব্যতিক্রম শুধু আইফোন, যার নতুন মডেলের অপেক্ষায় থাকে পৃথিবীর কোটি কোটি প্রযুক্তিপ্রেমী।
আগামী সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নতুন আইফোনের ঘোষণা দেবে অ্যাপল। এর আগে প্রতি বছর নতুন আইফোন বাজারে ছাড়ার সময় আগের সংস্করণের চেয়ে দাম বাড়িয়েছে অ্যাপল। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর যে আইফোন বাজারে আসবে তার দাম হতে পারে প্রায় এক হাজার মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮০ হাজার টাকার ওপরে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এত দাম হওয়ার পরও আইফোন নিয়ে মানুষের আগ্রহ, মাতামাতি বা পাগলামি কমেনি। কিন্তু কেন আইফোন এতটা জনপ্রিয়?
নকশা
আইফোন প্রথম বাজারে আসার সময় থেকেই বাকি স্মার্টফোনগুলোর থেকে দর্শনদারিতে আলাদা অবস্থান গড়েছে। আইফোনের সামনে বাটন মাত্র একটি, যা দিয়ে আপনি ফোনের মেইন মেনুতে ঢুকতে পারবেন। অন্যান্য স্মার্টফোনের ফ্রন্টে বাটনের সংখ্যা একের অধিক, যে কারণে ঝামেলাও বেশি। আইফোনের একটি মাত্র বাটন চেপে আপনি টাচ স্ক্রিনের সব ধরনের ফাংশনে ঢুকতে পারবেন। স্বতন্ত্র এ নকশার কারণেই আইফোন সবার মাঝে এতটা জনপ্রিয়। যে কারণে বাকি ফোন কোম্পানিগুলোও মাঝেমধ্যে তাদের অনুকরণের চেষ্টা করে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আইফোনের গ্রাফিকস ইন্টারফেস যেকোনো প্রযুক্তিপ্রিয় মানুষকে মুগ্ধ করবে। অপারেটিং সিস্টেমও অত্যাধুনিক, বুদ্ধিদীপ্ত এবং ঝামেলাবিহীন। জবস একবার বলেছিলেন, আইফোনের আসল নকশা এর দেখনদারিতে নয়, এটা যেভাবে কাজ করে সেটাই।
নিরাপত্তা
অ্যাপলের কোনো ডিভাইস ভাইরাসে আক্রান্ত হয় না। হ্যাক করতে গেলেও ঘাম ছুটে যাবে। খোদ এফবিআই বেশ কিছুদিন আগে এক সন্দেহভাজনের আইফোনের লক খুলতে পারছিল না দেখে অ্যাপলের দ্বারস্থ হয়। অ্যাপল সেই লক খুলে দিতে অস্বীকৃতিও জানায়।
শুধু নিরাপত্তার কারণেই আইটিউনস ছাড়া খুব কমসংখ্যক ডিভাইসে ডেটা সিঙ্ক করা যায় না। এটা অনেক ক্ষেত্রে অসুবিধাজনক হলেও নিরাপত্তার ব্যাপারটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মোবাইল অপারেটিং সিস্টেমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ বলা হয় অ্যাপলের আইওএসকে। সাম্প্রতিক এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, মোবাইল অপারেটিং সিস্টেমের সবচেয়ে বড় হুমকি স্পাইওয়্যারের বিপক্ষে শুধু আইওএস ছাড়া আর কোনো মোবাইল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না। অ্যান্ড্রয়েড, ব্ল্যাকবেরি, সিমবিয়ান কিংবা উইন্ডোজের তুলনায় আইওএস অনেক বেশি নিরাপদ। আইফোন হারিয়ে গেলে ‘ফাইন্ড মাই আইফোন’ সিস্টেম দিয়ে আপনি তা খুঁজে বের করতে পারবেন। যদিও এ অ্যাপের শতভাগ সুবিধা রয়েছে শুধুই উন্নত বিশ্বে। পাশাপাশি টাচ স্ক্রিন প্রযুক্তিতেও আইফোনেও সমকক্ষ নেই কেউ।
অভূতপূর্ব প্রযুক্তি
আইফোনের কল্যাণে আমরা এমন কিছু প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, যা এর আগে কেউ কখনো দেখেনি কিংবা জানত না। আজকের দুনিয়ায় অ্যাপসের জয়জয়কার। কিন্তু কার হাত ধরে আমরা প্রথম অ্যাপসের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি? অবশ্যই স্টিভ জবস। আইফোন দিয়ে তিনি বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন অ্যাপস ধারণার সঙ্গে। আইফোনের আইটিউনস অ্যাপস স্টোরে এখন অ্যাপের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লক্ষাধিক। এসব অ্যাপ দিয়ে আপনি সামান্য মোবাইলেও কল্পনাতীত সব কাজ করতে পারবেন। আইফোনের সফটওয়্যারগুলোও সব আপডেট ভার্সন। বাকিরা ভাবতে পারেনি, এমন সব ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছিল আইফোন।
ব্যবহারকারীদের জন্য চমক
আইফোনের প্রতিটি নতুন অপারেটিং সিস্টেমে নিত্যনতুন সব চমক থাকে। ওএসে কিছু গোপন ফিচার দিয়ে অ্যাপল সব সময়ই আইফোনের ইউজারদের চমক উপহার দিয়ে আসছে। প্রতিটি ওএস ভার্সনেই এমন কিছু ফিচার থাকে অ্যাপল ওএস রিলিজের আগে-পরে কখনোই মুখ খোলে না। অ্যাপল ধরেই নেয়, ব্যবহারকারী এসব ফিচার খুঁজে নেবে এবং ভীষণ বিস্মিত হবে। আসলে ঘটেও ঠিক তা-ই। যেমন ধরুন, আইওএস ৭ মডেলে এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক গোপন ফিচার খুঁজে পাওয়া গেছে, যেগুলো অ্যাপল তাদের ক্যাটালগেও উল্লেখ করেনি। ধারণা করা হচ্ছে, আইফোন ৮ মডেলে গোপন ফিচারের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যাবে!
হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার
আইফোনের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার—দুটোই অ্যাপলের বানানো। প্রসেসর থেকে শুরু করে র্যাম, বডি, ক্যামেরা, সবকিছুই অ্যাপলের। চীনে যে আইফোনগুলো বিক্রি হয়, সেগুলোর মানও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে অ্যাপল। অপারেটিং সিস্টেম শতভাগ অ্যাপলের ভেতর থেকে বানানো। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটি কখনো কারও কোনো সাহায্য নেয়নি। দুর্দান্ত এসব সুবিধা ছাড়াও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষদের জন্য আইফোনের ওএসে বিশেষ ধরনের সুবিধা রয়েছে। পৃথিবীর আর কোনো মোবাইল ফোন অপারেটিং সিস্টেম এতটা প্রতিবন্ধীবান্ধব নয়, যতটা আইফোন। সম্প্রতি আইওএস ৮ মডেলে ব্রেইল পদ্ধতিতে টাইপ করার ফিচারও রাখা হয়েছে। এখানে ব্যবহার করা হয়েছে ভাইব্রেশন প্রযুক্তি। মানের ক্ষেত্রে কখনো আপস করেনি আইফোন। বাকি নামকরা ব্র্যান্ডগুলো দামের ক্ষেত্রে আপস করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে আস্থা হারিয়েছে। আইফোন প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতেও এদিকে ঝোঁকেনি।
রহস্যময়তা
আইফোনের মধ্যে জাদুকরি ব্যাপার তো আছেই, আইফোন ঘিরেও একধরনের রহস্যময়তা তৈরি করা হয়। জবস তাঁর ব্যক্তিত্ব দিয়ে এই ব্র্যান্ডের একটি অন্য রকম ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। অ্যাপল তাদের নতুন যেকোনো কিছু নিয়ে তৈরি চমক তৈরি করতে ভালোবাসে। অনেক ক্ষেত্রে তারা চমকে দেয়ও। আবার অতি সাধারণ বিষয় নিয়েও কখনো কখনো হাইপ বা উন্মাদনা তৈরি করতেও তারা সফল হয়েছে। আইফোনের নতুন মডেলের নকশা, সুযোগ-সুবিধা নিয়েও তাই আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় আলোচনা। যেটার প্রভাব পড়ে তাদের প্রি-অর্ডারের বন্যায়; কিংবা মুক্তির দিন অ্যাপল স্টোরের সামনের লম্বা লাইনে।