তিন তরুণের ব্রেইন ইকুয়েশন
- বিজ্ঞান প্রযুক্তি
একটি আইডিয়া বিশ্ব পাল্টে দিতে পারে। জিতে নিতে পারে দেশ-বিদেশের পুরস্কার। গত ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশ থেকে যাত্রা করে আন্তর্জাতিক মানের অ্যাপ ব্রেইন ইকুয়েশন। ৪ মে জিতে নেয় ন্যাশনাল মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন অ্যাওয়ার্ড। আজ তুলে ধরা হলো সেই অ্যাপের পথচলার গল্প—
৪ মে ২০১৭। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের হলরুম। ঘড়িতে সময় সকাল সাড়ে ১০টা। চলছে ন্যাশনাল মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। আটটি ক্যাটাগরিতে মোট ১৬টি অ্যাপ পাচ্ছে এ পুরস্কার। বিজয়ীরা অংশ নেবে অস্ট্রিয়ায় অনুষ্ঠেয় ওয়ার্ল্ড অ্যাওয়ার্ড সামিটের গ্লোবাল কংগ্রেসে। বিজয়ী এসব অ্যাপ বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে।
দর্শক সারিতে বসা তিন তরুণ। তাদের চোখে স্বপ্ন। মননে আত্মবিশ্বাস। ২০ দিন আগে ১৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করে তাদের ব্রেইন ইকুয়েশন অ্যাপ। অ্যাপটি গুগল প্লে স্টোরে দেয়ার সময় চলছিল ন্যাশনাল মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন অ্যাওয়ার্ডে আবেদনের সময়। পত্রিকায় ঘোষণা দেখে তারা আবেদন করেন। অ্যাপটি লার্নিং অ্যান্ড এডুকেশন ক্যাটাগরিতে শর্টলিস্টে থাকলে ২৬ এপ্রিল আইসিটি ভবনে দিয়ে আসতে হয় সংক্ষিপ্ত প্রেজেন্টেশন। সেখানে গিয়ে তাদের চক্ষু চড়কগাছ। কিছু কিছু অ্যাপ তৈরি করতেই বিভিন্ন কোম্পানি খরচ করেছিল কয়েক কোটি টাকা। আর তাদের অ্যাপ! গুগল প্লে স্টোরে অ্যাপ রাখতেই যা দিতে হয়েছিল। বাকি কাজ করেছিল তারা ঘরে বসেই। দিন-রাত কম্পিউটারের সামনে বসে তারা অ্যাপটি তৈরি করে। অ্যাপটির ফাংশন কাজ করে কিনা, তা যাচাই করতে আরো কিছু ছোট ভাইবোনকে কাজ বুঝিয়ে দিয়েছিল। কাজ দেয়ার আগে বলেছিল, বাংলাদেশ থেকে তৈরি হবে বিশ্বমানের অ্যাপ! তাদের অ্যাপ মনোনীত হয়েছিল এ পুরস্কারের জন্য। পুরস্কার বিতরণী শুরু হলে তাদের বুকে ধুকপুক চলছিল। একবার মন বলছে, পুরস্কার পাবে; আবার বলছে পাবে না।
অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে বেশি সময় লাগে না। উপস্থাপনায় ছিলেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান। এক ক্যাটাগরিতে দুটি অ্যাপ পুরস্কৃত হচ্ছে। আট ক্যাটাগরিতে মোট ১৬টি পুরস্কার। যে অ্যাপ পুরস্কৃত হচ্ছে, তার প্রমোশনাল ভিডিও দেখানো হচ্ছে আগে। ভিডিও দেখিয়ে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে পুরস্কার।
লার্নিং অ্যান্ড এডুকেশন ক্যাটাগরির ঘোষণা করার আগেই তিন তরুণ চোখ বন্ধ করে ফেললেন। ভিডিওর সাউন্ড শুনে রেশ কাটল। ব্রেইন ইকুয়েশন লার্নিং অ্যান্ড এডুকেশন ক্যাটাগরিতে রানারআপ হয়েছে। তারা মঞ্চে যেতেই অভিবাদন জানালেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য জামিলুর রেজা চৌধুরী, সাহিত্যিক আনিসুল হক প্রমুখ। মঞ্চে পুরস্কার নিতে যাওয়া তিন তরুণ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের ছাত্র নাদিম মজিদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী টিয়া খানম এবং ফেনী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে সদ্য ডিপ্লোমাধারী তাহসীন বাপ্পি। পুরস্কার হিসেবে তাদের দেয়া হয় ক্রেস্ট এবং ১০ হাজার টাকার প্রাইজমানি। আগামী বছর অস্ট্রিয়ায় অনুষ্ঠেয় ওয়ার্ল্ড অ্যাওয়ার্ড সামিটের গ্লোবাল কংগ্রেসে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মনোনয়ন।
অ্যাপটির ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড জেতার অনুভূতি জানিয়ে ব্রেইন ইকুয়েশন টিমের সদস্য ও ঢাকা কলেজের ছাত্র রায়হান আহমদ আশরাফী জানান, ‘যেদিন আমরা পুরস্কার জিতেছি, সেদিন আমাদের অ্যাপের বয়স মাত্র ২০ দিন। এর আগে আমাদের অ্যাপ তৈরির অভিজ্ঞতা ছিল না। প্রথম অ্যাপটি পুরস্কার পাওয়ায় আমরা আনন্দিত। কোটি টাকা খরচ করে তৈরি হওয়া অ্যাপের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আমাদের পুরস্কার পাওয়া সত্যিই বিশাল অর্জন। এ পুরস্কার প্রমাণ করে তরুণরা কোনো কাজে ভালোভাবে আত্মনিয়োগ করলে বিজয় ছিনিয়ে আনা কঠিন কিছু নয়।’
কী আছে ব্রেইন ইকুয়েশন অ্যাপে?
শিক্ষার্থীরা সরল অংককে ভয় পাই। কারণ এ অংক করতে গেলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর উত্তর মিলে না। উত্তর না মেলার কারণ সরল অংকের একই লাইনে যোগ, বিয়োগ, গুণ এবং ভাগ একসঙ্গে থাকে। কোন অংশের কাজ আগে করতে হবে, তা মনে করতেই সময় লেগে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাদিম মজিদ উদ্যোগ নেন সরল অংককে সবার কাছে সহজবোধ্য করে অনুশীলন করার জন্য অ্যাপ তৈরির। পাশাপাশি চিন্তা করেন, বিশ্বের অনেক দেশেই শব্দছক ও সুডোকুর জনপ্রিয়তা রয়েছে। যদি এ অ্যাপকে পাজল হিসেবে উপস্থাপন করা যায়, তাহলে শিক্ষার্থীরা যেমন মজা করে খেলবে। অন্য বয়সীরাও ব্রেইনস্টর্মিং, অবসর সময় কাটানো, গণিতভীতি দূর প্রভৃতি কাজে এ অ্যাপ ব্যবহার করতে পারবেন।
এ ধরনের অ্যাপ বিশ্বে না থাকায় বাংলাদেশে বসে বিশ্বায়নের সুযোগ নিতে তারা অ্যাপটি তৈরি করেন ইংরেজিতে। বয়স বা চিন্তাভাবনার ক্ষমতা অনুসারে অ্যাপটির ১৬৮টি গেমকে পাঁচটি ডিফিকাল্টি স্তরে ভাগ করা হয়। প্রতিটি গেমের সাদা ঘরগুলো পূরণ করতে হয়। এক্ষেত্রে সরল অংকের নিয়ম অনুসারে, যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের একই কাজ একই লাইনে এলে প্রথমে ভাগের কাজ, তার পর গুণ, তার পর যোগ ও বিয়োগের কাজ করতে হয়। সাদাঘর মেলানোর সময় পাশাপাশি ও উপর-নিচ উভয় দিকে খেয়াল করতে হয়।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ব্রেইন ইকুয়েশন অ্যাপের উদ্যোক্তা নাদিম মজিদ জানান, পাজল চর্চাকারী ব্যক্তির মনোসংযোগ বাড়ায়। অন্য যেকোনো ব্যক্তির চেয়ে তারা যেকোনো জটিল সমস্যা সহজে ধরতে ও সমাধান করতে পারেন। এ কারণে বিশ্বে পাজল চর্চাকারীর সংখ্যা অনেক। ব্রেইন ইকুয়েশনকে পাজল হিসেবে উপস্থাপন করায় বিশ্বে নতুন এ অ্যাপ ছড়িয়ে যাবে। সুডোকুর উত্পত্তিস্থল হিসেবে জাপান, শব্দছকের উত্পত্তিস্থল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের যেমন পরিচিতি রয়েছে, ব্রেইন ইকুয়েশনের কারণে বাংলাদেশও সেভাবে পরিচিত হবে। আগামী তিন বছরে বিশ্বে এ অ্যাপের ব্যবহারকারী থাকবে দুই লাখ।
অ্যাপটির আকার মাত্র ১২ এমবি। গুগল প্লে স্টোর থেকে বিনামূল্যে ডাউনলোড করার লিংক: https://goo.gl/sprhG2 ।