লেখক – সাংবাদিকের ভাষাজ্ঞান
মোস্তাফিজুর রহমান: লেখকের হাতে ভাষা গতি পায়, প্রাণ পায়, পায় নতুন পথ চলার শক্তি। লেখনির গুণে খুব গোপনে লুকিয়ে থাকা ভাষার সুন্দর্যও ঘোমটা খুলে বেরিয়ে আসে আর তার অত্যাশ্চর্য প্রয়োগে মনের খুব সূক্ষ্ম অনুভতির প্রকাশে আমরা বিমোহিত হই; কাঁদি, হাসি। ভাষা ধারণ করে ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধারণ করে জীবন, জীবিকা, সুখ, স্বপ্ন, কান্না, হাসি; এমনকি ধারণ করে কান্নার নোনা জল, সুখের প্রফুল্ল হাসি, যুদ্ধের তাজা রক্তও। তবে এই ধারণ ভাষা আপনা থেকে করতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন হয় কিছু ভাষা সাধকের। এই সাধকেরা ভাষাকে ধরে রাখে লেখনিতে, দেয় বিশিষ্টতা। কিন্তু তাদের কেউ কেউ যখন সাধনার তু-আক্কা না করে, উপবাস না থেকে, ধ্যান না করে সিদ্ধি লাভ করা সন্যাসী হতে চাই, তখন তথাকথিত সিদ্ধি লাভ ঘটলেও সাধনার ব্যাপারটি আর থাকে না, কোনমতে ভাবের প্রকাশ ঘটলেও ভাষার সেই অপরিসীম সুন্দর্য আর প্রকাশ পায় না, কোথাও কোথাও সুন্দর্য দূরে থাক শব্দ/বাক্যের অর্থও যায় উল্টে!
সাধারণের বলার ভাষা আর লেখকের লেখার ভাষা এক নয়। যদি তাই হত, তাহলে লেখাকে সৃজনশীল কর্ম বলা হত না – এই লেখা বলতে কেবল গল্প, কবিতা, উপন্যাস রচনাকে বোঝাচ্ছি না বরং লেখালেখির গোটা ব্যাপারটাকে বোঝাতে চাইছি; হোক সেটা গল্প, উপন্যাস লেখা, পত্রিকার উপসম্পাদকীয় লেখা অথবা নিরেট খবর লেখা – সব লেখাতেই সৃজনশীলতা আবশ্যক। কথা বলতে গিয়ে আমরা তো কত রকমভাবেই বলি! কখনো কখনো আকার-ইঙ্গিতে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিই। প্রশ্ন হল, এই “আকার-ইঙ্গিত” কী লেখা যায়? হ্যা, যায়। তবে এই “আকার-ইঙ্গিত”কে বর্ণনা করতে অন্তত একটি সম্পুর্ন অনুচ্ছেদের অবতারণা বরতে হয়। অথচ বলার সময় এই “আকার-ইঙ্গিত” এর কোন ব্যাখ্যা দেওয়া লাগে না, মানুষ আপনা থেকেই বুঝে যায়। একইভাবে অস্পষ্ট উচ্চারণ, ভুল শব্দ প্রয়োগ, কথা বলা এবং বোঝার ক্ষেত্রে ততটা সমস্যা হয়ে দাড়ায় না, কেননা আমরা সচরাচর কথা বলি আমাদের কমিউনিটির অথবা চেনাজানা মানুষের সাথেই। দূরের মানুষ হলেও বোঝার ক্ষেত্রে খুব বেশি সমস্যা হয় না। কিন্তু, লেখার ক্ষেত্রে? লেখার ক্ষেত্রে এসব ভুল অমার্জনীয়।
একজন্য অন্য পেশার মানুষ, যে দিনের হিসাবপত্র লিখে রাখা আর কাউকে ব্যাক্তিগত চিঠি লেখা ছাড়া সচরাচর ভাষার চর্চা করেন না, তার ক্ষেত্রে এমন ভুল অন্য কাউকে প্রভাবিত করে না বা অন্য কারো ভাষা জানার পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে ওঠে না। পক্ষান্তরে, এই ভুলগুলো যদি কোন লেখক বা সাংবাদিক করে, তবে তার ফল হয় খুবই মন্দ, কোন কোন ক্ষেত্রে ভয়াবহ। কেননা লেখক-সাংবাদিকরা ভাষার সাধক, বাহক – তারা গোটা দেশের, স্পষ্টত ঐ ভাষায় বিশ্ববাসির শিক্ষক। তাদের কাছ থেকে বিশ্ববাসি ভাষা শেখে; তাদের লেখা শব্দ, বাক্য ধ্রুব হিসাবে ধরে নিয়ে নিজেকে, অন্যকে মুল্যয়ন করে, ভুল থাকলে সুধরে নেই। সুতরাং লেখক এবং সাংবাদিকের জন্য সুদ্ধ লেখা খুব জরুরী। প্রমথ চৌধুরী যেমন লাইব্রেরীকে হাসপাতাল এবং স্কুল কলেজের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তেমন আজকের এই আকাশ সংস্কৃতি, ফেসবুক, চ্যাট বক্স আর এফএম রেডিওর যুগে এসে লেখকদের শুদ্ধ লেখাটা দৈনিক শ্বাস-প্রশ্বাসের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আমি সেই অর্থে কোন লেখকই নই, লিখতে চাই, তাই চেষ্টা করি মাত্র, আবার সাংবাদিক হিসেবেও খুব পোক্ত না, তবুও জোর গলায় বলতে পারি, যে ভাষায় আমি লিখি – নিজের এই বাংলা ভাষাকে নিজের জীবনের মতই ভালবাসি। যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি, ‘লিখব’, সুতরাং আমাকে চর্চা করতেই হবে। মনের মধ্যে খুব রোমান্টিক কিছু খেলে গেলে, তা যেমন তেমন ভাষায় লিখে ফেললেই যেমন লেখক হওয়া যায় না, তেমন সামাজিক যোগাযোগের সাইটে দেওয়া স্টাটাস আপডেটে কয়েক হাজার লাইক পেলেও লেখক হওয়া যায় না। এর জন্য দরকার চর্চা করা। প্রচুর পড়া। এটা সত্যি যে, যারা লেখে বা লিখতে চাই তারা অল্প-বিস্তর চর্চা করেন, তবে চর্চা কতটা যথাযথ হয় সেটা বোঝা যায়, যখন খুব সহজ শব্দ লিখতে গিয়েই কেউ কেউ ভুল করে বসেন। খুব সাধারণ একটা উদাহরণ দিয়ে পারি; বিশেষ করে, “ড়” আর “র” ব্যবহার ঠিকমত জানেন না, এমন লেখকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। বেশ ক-জন সমসাময়িক জনপ্রিয় লেখকের বই হাতে পেয়েছি যাদের মধ্যে এই সাধারণ ভুলটা উল্যেখযোগ্য। প্রথম যখন এজাতীয় ভুল শব্দ চোখে পড়ে তখন ভেবেছিলাম অবচেতনভাবে হয়তো দু-একটা শব্দ ভুলে হয়ে গেছে – অবশ্য এ দায় লেখা কম্পোজকারীর ঘাড়ে চাপিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার বাহানা খুজবেন অনেকে – কিন্তু একই অর্থ বহনকারী সেই শব্দটি যখন পুন:পুন একই বানানে ব্যবহার হতে দেখি তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না, ভূলটা আসলে কার! তার চেয়েও ভয়ংকর ব্যাপার, প্রকাশকও এসব নজরে আনেন না, এ থেকে স্পষ্ট যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকাশ করার আগে কোন সম্পাদনা পরিসদ পা-লিপি মুল্যয়ন করেন না।
এখন যেমন আমাদের শিশুদের মগজ বাংলার চেয়ে হিন্দী শব্দে বেশি সমৃদ্ধ, এই বিকৃতির ধারা অব্যাহত থাকলে একদিন ভাষা আন্দোলনকে স্বরণ করতে হবে অন্য কোন ভাষায়, অথবা আধা ইংরেজি আধা হিন্দীর মিসেলে উদ্ভট কোন জগাখিচুড়ি ভাষায়, যেটা ঠিক বাংলা নয়।
যেমন, দাঁতে দাঁত চেপে যে কামড় দিতে হয়, তা প্রকাশ করতে কেউ কেউ লেখেন, “কামর” আবার শরীরের মধ্যভাগ অর্থাৎ মেরুদন্ড আর পায়ের সংযোগস্থলকে বলা হয় কোমর, এই শব্দটি কেউ কেউ লেখে “কোমড়”। বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে বরই নামের যে ছোট ছোট সুস্বাদু ফল পাওয়া যায়, তার বানান কেউ কেউ লেখেন “বড়ই”। ধরুণ একটা বাক্যে বলা হচ্ছে, “ছেলেটি দৌড়াতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে গেল” এখানে “পড়ে” বানানটি লক্ষ করবেন, এই শব্দটি অনেক লেখে, “পরে”। এটা কেবল ছোটখাট একটা ভুলই না, বাক্যের অর্থও পাল্টে দিতে পারে! কেননা, “পরা” মানে কোন কিছু পরিধান করা।
সংগীত শিল্পী হতে গেলে যেমন সুর, তাল শিখতে হয়, লিখতে হলেও তেমন এই সাধারণ ব্যাকরণ জানতে হয়, শব্দের সঠিক প্রয়োগ শিখতে হয়। আমি বলছি না যে, সারাক্ষণ বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে পড়ে থেকে আপনি ভাষাবিদ হয়ে উঠুন। তবে নুন্যতম জ্ঞানটুকু থাকতেই হবে, যেন আপনার হাতে ভাষা বিকৃত না হয়। ফেসবুকে বন্ধুদের স্টাটাস পড়ে যেমন লেখক হওয়া যায় না, তেমনি হিন্দি, ইংরেজির ঢঙে ভাষার বিকৃত উচ্চরণ করে অথবা এফএম রেডিওর মত ‘জগাখিচুড়ি’ ভাষার চর্চা করে লেখক-সাংবাদিক হওয়া যায় না। প্রমিত ভাষার ব্যবহারে ভাষাকে করে তুলতে হবে আরও সমৃদ্ধ, আরও সুন্দর, এই যেন হয় আমাদের চর্চার কেন্দ্রীয় ভাবনা।
বিরাম চিহ্ন নিয়েও আছে আমাদের বিস্তর সমস্যা। শুধু দাঁড়ি নয়, বাংল ভাষায় আরও অনেকগুলো বিরাম চিহ্ন আছে; কমা, কোলন, সেমি কোলন, বিস্ময়সুচক চিহ্ন, প্রশ্নবোধক চিহ্ন, লোপ চিহ্ন, ড্যাস, হাইফেন, বন্ধনী এরকম আরও বেশ ক-টি যতি বা বিরাম চিহ্ন বাংলা লেখায় ব্যবহৃত হয়। কিন্তু, আশ্চর্য বিষয় হল বারবার ব্যবহার হয় কেবল দাঁড়ি। সুখেও দাঁড়ি, দুঃখেও দাঁড়ি, বিস্ময়েও দাঁড়ি, প্রশ্নেও দাড়ি! দাঁড়ির বাড়াবাড়ি! এত দাঁড়ি কেন ? লেখার সময় আমাকে বাক্য ছোট করতেই হবে অথবা বাক্য বড় করতেই হবে, এই মাথার দিব্বি কে দিয়েছে? অবশ্য লেখক ছোট বাক্যে লিখবে না বড় বাক্যে লিখবে সেটা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার, এটা লেখকের নিজম্ব শৈলী, ভঙ্গি, ভাষা তৈরি করে – এ ব্যাপারে কারো কোন মন্তব্য করা উচিত নয়, আমিও সে ধৃষ্টতা দেখাব না। কিন্তু তথাকথিত সহজ সুপাঠ্য করতে উদ্যেশ্যমুলকভাবে বাক্য ছোট করতে করতে যদি অর্থহীন বাক্য লেখেন, তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়! যেখানে আগের বাক্য শেষ হল সেই দাঁড়ি থেকে পরবর্তি দাঁড়ি পর্যন্ত নিশ্চয় একটি বাক্য, সাধারণত সেটা সম্পূর্ণ একটি বাক্য। কিন্তু, এই ছোট বাক্যওয়ালাদের অনেকেরই দু-তিনটা সম্পূর্ণ বাক্য নিয়ে সাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা সম্পূর্ণ বাক্য হয়। আপনি ছোট বাক্যে লিখতেই পারেন, তাই বলে অসম্পূর্ণ ভুল বাক্য নয়। যেহেতু আমাদের বাক্য ছোট এবং একমাত্র বিরাম চিহ্ন দাঁড়ি হয়ে দাড়িয়েছে তাই কমা’র অস্তিত্ব এখন আর খুজে পাওয়া যায় না। কমা দিলে বরং লিকলিকে মানুষের হাড় গোনার মত একটা একাট শব্দ আলাদা হয়ে যাবে।
রচনা সুপাঠ্য আধুনিক করার নামে ভুল বাক্য লেখা বন্ধ না করলে আমাদের নিজস্বতা বলে একদিন কিছুই থাকবে না। এখন যেমন আমাদের শিশুদের মগজ বাংলার চেয়ে হিন্দী শব্দে বেশি সমৃদ্ধ, এই বিকৃতির ধারা অব্যাহত থাকলে একদিন ভাষা আন্দোলনকে স্বরণ করতে হবে অন্য কোন ভাষায়, অথবা আধা ইংরেজি আধা হিন্দীর মিসেলে উদ্ভট কোন জগাখিচুড়ি ভাষায়, যেটা ঠিক বাংলা নয়। সুতরাং, লেখক-সাংবাদিককেই সজাগ হতে হবে। এই ভাষাকে ধারণ করে, লালন করে আরও সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে। তবেই আসবে আমাদের কাঙ্খিত মুক্তি, মিলবে ভাষার নেতৃত্ব দেওয়া জাতির যথার্থ মর্যাদা!
মোস্তাফিজুর রহমান: সাহিত্যিক, সাংবাদিক
দি প্রমিনেন্ট এডিটর