মুক্ত সফটওয়্যারে মুক্ত বিশ্ব
- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় শনিবার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ‘মুক্ত সফটওয়্যার দিবস’। মূলত মুক্ত সোর্স কোডের সফটওয়্যারের ব্যবহার বৃদ্ধিতে দিবসটি হয়ে ওঠে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উন্মুক্ত বিশ্ব গড়ার অঙ্গীকার। লিখেছেন ইমদাদুল হক
উইন্ডোজ কিংবা আইওএসের মতো আবদ্ধ সোর্স কোড ভিত্তিক সফটওয়্যার বিশ্বজুড়ে দারুণ জনপ্রিয়। বলা যায় আবদ্ধ সফটওয়্যারেরই রমরমা বাণিজ্য প্রযুক্তি বিশ্বজুড়ে। তবে একদল মানুষ স্বপ্ন দেখেন তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক উন্মুক্ত বিশ্ব। আর এজন্য চাই মুক্ত সোর্স কোডের সফটওয়্যার। ব্যয় সাশ্রয়ী এসব সফটওয়্যারের কমতি না থাকলেও বাণিজ্যিক প্রচারণার অভাবে সাধারণের দোরগড়ায় পৌঁছায় না। তবে সাশ্রয়ী মূল্যের পাশাপাশি নিজের মতো ব্যবহারের সুবিধা থাকায় মুক্ত সোর্সের সফটওয়্যারের জনপ্রিয়তা কিন্তু দিন দিন বাড়ছে।
গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও চলছে মুক্ত সফটওয়্যারের পরিচর্যা ও ব্যবহার। বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রীয় প্রেষণে চলছে সফটওয়্যার ব্যবহারে নৈতিকতা উন্নয়ন ও নিজেদের ভাণ্ডার সমৃদ্ধির আয়োজন। তাই এর ব্যবহার এখনও উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে না পৌঁছালেও দিন দিনই তা বাড়ছে।
মুক্ত সফটয়্যার কী
মুক্ত সফটওয়্যার মূলত নির্দিষ্ট কোনো সফটওয়্যার নয়। এটি বিশেষ ধরনের হয়ে থাকে। এটি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যা সবার জন্য উন্মুক্ত। মুক্ত সফটওয়্যারগুলোর বিভিন্ন প্রোগ্রামিং সংকেতগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত থাকায় এগুলো প্রায় সব ধরনের অপারেটিং সিস্টেমে ব্যবহার করা যায়। সম্পাদনা ও উন্নয়নের পথ উন্মুক্ত থাকায় যে কোনো সফটওয়্যারকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নেওয়া যায়। যে কেউ বাধাহীনভাবে ব্যবহার, উন্নতিসাধন, এমনকি পুনর্বিতরণও করতে পারেন। সঙ্গত কারণে কম্পিউটারে বাংলা চর্চার ক্ষেত্রেও এগিয়ে রাখে মুক্ত সফটওয়্যার। তারুণ্যের বাঁধ ভাঙা আনন্দ জোয়ারে ঢেউ তোলে উবুন্টু জুমলা, ফায়ারফক্স, ভিএলসি মিডিয়া প্লেয়ার, জিম্প, ওয়ার্ডপ্রেস, ম্যাজেন্টো, ওপেন অফিস, দ্রুপাল, ওপেনকার্ট এবং ন্যুক্যাশের মতো প্রোগ্রাম ও সফটওয়্যার।
মুক্ত সফটওয়্যারের বৈশিষ্ট্য
যে সফটওয়্যার বা প্রোগ্রামগুলো ইচ্ছেমতো পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যবহার ও বিতরণ করা যায় সেগুলোকেই এক কথায় মুক্ত সফটওয়্যার বলে। এই সফটওয়্যারগুলো কারও ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। এগুলো জনকল্যাণে নিবেদিত। মুক্ত সফটওয়্যার নিয়ে মুক্ত সফটওয়্যার ফাউন্ডেশনের জনক রিচার্ড ম্যাথিউ স্টলম্যান বলেছেন, ফ্রি সফটওয়্যার হচ্ছে একটি স্বাধীনতার বিষয়, মূল্যের বিষয় নয়। প্রথমত, সফটওয়্যারটির কপি পুনর্বিতরণ করার স্বাধীনতা, যার মাধ্যমে প্রতিবেশী বা বন্ধুবান্ধবরা এটি ব্যবহার করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, প্রোগ্রামটির যে কোনো ধরনের পরিবর্তন করার স্বাধীনতা, যেন সফটওয়্যারটি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর এর জন্য অবশ্যই সোর্স কোডে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সবার জন্য সোর্স কোডে প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত থাকায় দিন দিনই ঋদ্ধ হচ্ছে মুক্ত সফটওয়্যারের ভাণ্ডার। কম্পিউটারে সাধারণত যেসব কাজের জন্য সফটওয়্যার প্রয়োজন, তার প্রায় সব কাজের জন্যই মুক্ত ও ওপেন সোর্স সফটওয়্যার রয়েছে। এ ধরনের সফটওয়্যারের আদর্শ উদাহরণ-জিএনইউ লিনাক্স। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বেচ্ছাসেবী সফটওয়্যার নির্মাতাদের সমন্বিত উদ্যোগের ফসল এই সোর্স কোড উন্মুক্ত সফটওয়্যারটি।
মুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহারের সুবিধা
ব্যবহারিক স্বাধীনতাই মুক্ত সফটওয়্যারের সবচেয়ে বড় পরিচয়। এটি সহজ প্রাপ্য। ব্যবহারের জন্য লাইসেন্স কিনতে হয় না। ফলে ক্র্যাক ফাইল সমেত চোরাই সফটওয়্যার ব্যবহারের মতো নৈতিক দুর্বলতার সঙ্গে আপস করার কোনো প্রয়োজন নেই মুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহারে। আবার মুক্ত সফটওয়্যারের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সহজেই নানা রকম অ্যাপ্লিকেশন উন্নয়ন করে বিনিয়োগহীন প্রযুক্তি ব্যবসায়ও শুরু করা যায়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের (বিডিওএসএন) সাধারণ সম্পাদক মুনীর হাসান বলেন, সাধারণ কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের নানা কারণে মুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহার করা প্রয়োজন পড়ে। এ সফটওয়্যারের ব্যবহার একজন ব্যবহারকারীকে তার কম্পিউটারকে নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহার করার স্বাধীনতা প্রদান করে যা স্বত্বাধিকারী সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে কখনোই সম্ভব নয়। স্বত্বাধিকারী সফটওয়্যারে কাজ করে তার মালিক প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছামতো, ব্যবহারকারীর ইচ্ছামতো নয়। মুক্ত সফটওয়্যার একজন ব্যবহারকারীকে তার বন্ধু ও প্রতিবেশীকে সহযোগিতা করতে শেখায়। একটি সুন্দর জীবন গড়ার জন্য এটা খুবই দরকার। অ্যাকাডেমিক শিক্ষাক্ষেত্রে যেমন এটি প্রযোজ্য যেমনটি তা সবার জন্য প্রযোজ্য। আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে চোরাই সফটওয়্যার ব্যবহার প্রবণতা রোধে মুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহারে সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার। ব্যবহারিক সুবিধার জন্য বাংলাদেশে প্রান্তিক পর্যায়ে না হলেও ডেভেলপারদের মধ্যে ওপেন সোর্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। যারা বুঝছে, তারা মুক্ত সফটওয়্যারের ব্যবহার করছে। আর ওয়েব ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্রে দেশের নির্মাতারা লিনাক্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে। মিডিয়া উইকি ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে বাংলাপিডিয়া। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ওয়ার্ডপ্রেসে দেশে অনেক ভালো ডেভেলপার তৈরি হয়েছে। প্রোগ্রামিং নিয়ে যারা কাজ করে তাদের বাইরে অ্যান্ড্রয়েড, ওয়েব ব্রাউজার মজিলা ফায়ারফক্স, ক্রোম, মিডিয়া প্লেয়ার: ভিএলসি এবং মেইলের জন্য থান্ডারবার্ড কিন্তু ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
শিক্ষার্থীদের জন্য মুক্ত সফটওয়্যার
সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। স্কুল-কলেজে সরকারি খরচে ল্যাব তৈরি হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের কম্পিউটারের পাশাপাশি এসব ল্যাবে ব্যবহৃত ল্যাপটপ-ডেস্কটপে মুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে যেমন সরকারের বড় অঙ্কের খরচ কমবে তেমনি শিক্ষার্থীরাও সহজে মুক্ত সফটওয়্যারে অভ্যস্ত হতে পারবে। সিস্টেমের সব কম্পিউটারে সহজেই মুক্ত সফটওয়্যার ইনস্টল করা যায়। এতে একটি স্কুলের কম্পিউটার খাতের খরচ অনেক কমে তেমনি ডিজিটাল বৈষম্য রেখাও ঘুচে যায় অনেকাংশেই। নৈতিকতার পাঠটা হাতে-কলমে পেঁৗছে যায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এছাড়াও মুক্ত সফটওয়্যার একজন শিক্ষার্থীকে একটি সফটওয়্যার কীভাবে কাজ করে, তা জানার ও বোঝার সুযোগ দেয়। এমন অনেক শিক্ষার্থী আছেন, যারা তাদের কম্পিউটার সিস্টেম এবং এর সফটওয়্যার সম্পর্কে সব কিছু জানতে উৎসুক থাকেন। পরবর্তী সময়ে ভালো প্রোগ্রামার হতে হলে এই বয়স থেকেই তাদের শিক্ষা শুরু হওয়া দরকার। ভালো প্রোগ্রামার হতে হলে একজন শিক্ষার্থীকে অনেক প্রোগ্রামিং সংকেত পড়তে হবে এবং অনেক প্রোগ্রামিং সংকেত লিখতে হবে। যেসব প্রোগ্রাম মানুষ দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করে তাদের অবশ্যই সেসব প্রোগ্রামের প্রোগ্রামিং সংকেত পড়তে এবং বুঝতে হবে। তাহলে তারা শিখবে কীভাবে? তারা স্বভাবতই বিভিন্ন সফটওয়্যারের সোর্স কোড সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হবে যা তারা প্রতিদিন ব্যবহার করে। অন্যদিকে, স্বত্বাধিকারী সফটওয়্যার শিক্ষার্থীদের এই জানার তৃষ্ণাকে নষ্ট করে দেয়।
সরকারি উদ্যোগে ওপেন গভ. ডাটা প্রকল্প
মুক্ত সফটওয়্যার আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে ইতিমধ্যে প্রকল্পভিত্তিক উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। সরকারের আইসিটি বিভাগের উদ্যোগে গত জানুয়ারি থেকে কাজও শুরু কয়েছে এই ওপেন ডাটা গভ. প্রকল্পের। এই প্রকল্পের অধীনে সরকারের সব তথ্য-উপাত্ত বিশেষ করে ব্যুরো অব স্ট্র্যাটেস্টিকস যেসব পরিসংখ্যান প্রকাশ করে, তা যে কেউ ব্যবহার করতে পারবে। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে লিনাক্স ব্যবহার কৌশল শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছে কম্পিউটার কাউন্সিল।