রেস্তোরাঁ ব্যবসা ও বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা
- কিউ আর ইসলাম
বাড়িতে রান্না আহার্যের ওপর আমাদের বরাবরই বিশেষ এক আসক্তি ছিল। সাম্প্রতিককালে হোটেল ও রেস্তোরাঁর সংখ্যা বৃদ্ধি থেকে মনে হচ্ছে এটা কমে যেতে শুরু করেছে। ভোজনবিলাসিতা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে আমরা ঘরের বাইরে খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। নতুন নতুন ফাস্টফুডের দোকান, রেস্তোরাঁ ও চায়ের দোকান বা টি-স্টলে ভিড়। শুধু শহরেই নয়, গ্রামেও। গড়পড়তা প্রায় ৩০০ মানুষের জন্য বর্তমানে একটি হোটেল, রেস্তোরাঁ বা খাবারের দোকান এবং প্রতি ৪০০ মানুষের জন্য একটি টি-স্টল। বাংলাদেশে ২০১৩ সালে অর্থনৈতিক জরিপে এ তথ্য পাওয়া যায়। কয়েক দশক আগেও এ দেশে শহরের বাইরে রেস্তোরাঁর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিল। মিষ্টির দোকান বের করা গেলেও দুপুরে বা রাতে আহারের জন্য আতিথ্য গ্রহণ বা নিজস্ব বন্দোবস্তের প্রয়োজন হতো। আমাদের দেশে সম্ভবত উনিশ শতকে হালকা খাবার বা নাশতার মধ্য দিয়ে মূলত ঘরের বাইরে খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়। নাশতার জন্য গজা, জিলাপি, খাজা, মতিচুর ইত্যাদি মিষ্টান্ন পাওয়া যেত।
ওই সময় অবিক্রীত দুধ থেকে তৈরি ছানার সঙ্গে স্বাদ বৃদ্ধির জন্য গুড় বা চিনি মেশানো মিষ্টান্ন তৈরি করা হতো। নাম ছিল ‘মাখা’; বর্তমানে যে সন্দেশ আমরা খেয়ে থাকি, তারই পূর্বসূরি। এর পর উদ্ভাবিত হয় রসগোল্লা। একসময় মিষ্টির দোকানে ভেজা চিড়ার সঙ্গে দই মিশিয়ে প্রাতরাশের ব্যবস্থা শুরু হয়। বাড়িতে কখনো অতিথিকে বাইরে থেকে নাশতা নিয়ে এসে আপ্যায়ন করা হলেও মধ্যাহ্নে ও রাতে বাড়িতেই খাবারের বন্দোবস্ত করা হতো। সেই থেকে আমাদের দেশে এখনকার হোটেল-রেস্তোরাঁ পর্যন্ত এক দীর্ঘ ইতিহাস। চীনে একাদশ এবং ফ্রান্সে আঠারো শতকে হোটেল-রেস্তোরাঁ চালু হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। আমাদের দেশে এর অনেক পরে চালু হয়। নগরায়ণের সঙ্গে হোটেল ও রেস্তোরাঁয় আহারের সম্পর্ক রয়েছে। সঙ্গে আছে অর্থনৈতিক উন্নতি এবং উপার্জন ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি।
ঘরের বাইরে খাওয়া একসময় পুরোপুরি বিলাসিতা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বর্তমানে অনেককেই বাধ্য হয়ে বাইরে খেতে হয়। তবে ভোজনবিলাসীদের সংখ্যাও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। নতুন নতুন খাবার খেতে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। শুরুতে রেস্তোরাঁগুলোয় নাশতার জন্য শিঙ্গাড়া, নিমকি ও পুরি বিক্রি হতো। পরবর্তীতে চাপাতি রুটি, তন্দুরী ও পরোটার পাশাপশি ভাজি, ডাল ও মাংস পাওয়া যেতে থেকে। ভাত খাওয়ার জন্য রেস্তোরাঁ খুঁজতে হতো। নারী ও পুরুষ একসঙ্গে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল না। নারীদের জন্য বিশেষ ও আলাদা কেবিন ছিল। এখন এ ধরনের বাধ্যবাধকতা বা সীমাবদ্ধতা নেই। তাছাড়া খাবারেও এসেছে বৈচিত্র্য। রেস্তোরাঁগুলোয় এখন নতুন নতুন খাবার তৈরির প্রতিদ্বন্দ্বিতা— দেশী ও বিদেশী। কোনো কোনো রেস্তোরাঁয় ‘হোম মেড’ খাবার বলে আকর্ষণ করা হয়। রেস্তোরাঁগুলোর নামকরণেও চমক দেখা যায়। আধুনিক থেকে ঐতিহ্যবাহী নাম এবং নানাভাবে সজ্জিত রেস্তোরাঁ খাদ্যরসিকদের আকর্ষণ করে। আগের মতো হোটেলের সামনে টাঙানো বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ডে গরু, খাসি, মুরগি বা বড় মাছের ছবি আর দেখা যায় না।
এ দেশে মোগলাই খাবারের মধ্য দিয়ে রেস্তোরাঁয় বৈচিত্র্য আসে। ভোজনবিলাসীরা শহরের নির্ধারিত কিছু রেস্তোরাঁয় পোলাও, রোস্ট, রেজালা, বিরিয়ানি, মোগলাই পরোটা, কাবাব, লাচ্ছি খাওয়ার জন্য যেত। চাইনিজ রেস্তোরাঁগুলোর মধ্য দিয়ে মানুষ প্রথম বিদেশী খাবার খেতে শুরু করে। ভোজনবিলাসীরা স্যুপ, ফ্রায়েড রাইস ও চিকেন খেতে ভিড় করতে থাকে। চাইনিজ রেস্তোরাঁগুলো নারী, পুরুষ ও পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে নীরব পরিবেশে আহারের সুযোগ করে দেয়। এর পর আসে থাই খাবার। এখন কোরিয়ান ও মেক্সিকান খাবার, এমনকি অনেকেই জাপানি রেস্তোরাঁয় কাঁচা মাছের সুশিও খেতে যাচ্ছে। তরুণদের পছন্দ পিত্জা, বার্গার আর শর্মা। ফ্রায়েড চিকেন আর আলুর চিপ খেতে সন্তানদের সঙ্গে তাদের মা-বাবাকেও দেখা যায়। লাচ্ছির স্থান দখল করে নিচ্ছে নানা স্বাদের শেক। কুলপির বদলে এসেছে আইসক্রিম। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি, অধিকতর ভ্রমণ, সামাজিক বিধিনিষেধে শিথিলতা ইত্যাদি কারণে ফাস্টফুডের দোকান, হোটেল ও রেস্তোরাঁয় যাতায়াত বেড়েছে।
সত্তরের দশকে ঢাকা রাজধানী শহরের বাণিজ্যিক এলাকার এক রেস্তোরাঁর ছাদে খাবারের আয়োজন করে ভোজনবিলাসীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ওই সময় কয়েকটি রেস্তোরাঁ সুস্বাদু বিরিয়ানি, কাবাব ও বড় বড় মাছের জন্য বিখ্যাত হয়ে পড়ে। এর পর আসে খিচুড়ি ও নান। নব্বইয়ের দশকে উঁচু ভবনের সর্বোচ্চ তলা বা ছাদের ওপর স্থাপিত রেস্তোরাঁ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে ঘূর্ণায়মান রেস্তোরাঁ চালু হয়। হাইওয়েগুলো সড়কে দীর্ঘ পথ যাত্রীদের আকর্ষণ করে। এর আগে বাস ও ট্রেন যাত্রীদের টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার সঙ্গে নিতে হতো। তবে স্টিমার, ফেরি ও লঞ্চে যাত্রীদের খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ঢাকা থেকে খুলনা যেতে স্টিমারে রান্না খাবারের বেশ সুনাম ছিল। আরিচা থেকে পদ্মা নদী পার হয়ে দৌলতদিয়া ও নগরবাড়ী ঘাটে যেতে ফেরিতে অনেকেই সরিষা ইলিশ খেতে ভুলত না। নদী থেকে ধরা তাজা ইলিশ রান্না করা হতো। দেশের প্রায় সব ফেরিঘাটে ছোট বড় অসংখ্য রেস্তোরাঁ ছিল। বর্তমানে শহর, উপশহর ও উপজেলাগুলোয় নতুন নতুন রেস্তোরাঁয় মানুষ খাবার খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। কোনো কোনো রেস্তোরাঁ সুস্বাদু রান্নার জন্য সাধারণ মানুষের কাছে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। যেমন— ভর্তা, ভুনা মাংস, নেহারি এবং ঘন দুধের চা। ইদানীং রাজধানী শহরের কাছাকাছি নদী ও জলাশয়ের ওপর আংশিক ভাসমান রেস্তোরাঁ দেখা যায়।
সারা দেশে অসংখ্য ভ্রাম্যমাণ দোকানে খাদ্য ও পানীয় বিক্রি হয়। ঢাকা শহরের প্রতিটি আবাসিক এলাকায় অগণিত রেস্তোরাঁ দেখা যাবে। উত্তরা আবাসিক এলাকায় নব্বইয়ের দশকের শুরুতে একটি মাত্র রেস্তোরাঁ ছিল। এখন একটি রাস্তারই দু’পাশে কয়েক ডজন রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুডের দোকান, বেকারি, টি-স্টল দেখা যাবে। এমনভাবে শহরে, গঞ্জে, এমনকি গ্রামে রেস্তোরাঁয় মানুষের ভিড় বেড়েছে। এছাড়া ক্যাটারিং সার্ভিস এবং হোটেল ও রেস্তোরাঁ থেকে অনলাইনে যোগাযোগ করে বাড়ি, অফিস ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খাবার সরবরাহ চালু হয়েছে। বিয়েশাদিতে ক্যাটারিং সার্ভিসের দ্বারস্থ হতে হয়। বাড়িতে মেজবানির আয়োজনের পরিবর্তে কমিউনিটি বা পার্টি সেন্টারে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়। অর্থনৈতিক জরিপের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে পাঁচ লাখের উপর হোটেল ও রেস্তোরাঁয় আবাস ও আহার আয়োজনে ১২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাটে বসবাস, ছোট পরিবার ও চাকরিরত নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে হোটেলে ও রেস্তোরাঁয় ভিড় ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে। তবে এই বৃদ্ধি খাদ্যের মান এবং হোটেল, রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকানের বিশ্বস্ততার ওপরও নির্ভর করবে।
বোস্টনে হার্ভার্ড টিএইচ চান স্কুল অব পাবলিক হেলথের এক গবেষক রেস্তোরাঁর অস্বাস্থ্যকর খাদ্য স্থূলতা হার বৃদ্ধির বড় কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, স্থূলতা ও ডায়াবেটিস সাধারণত হাত ধরাধরি করে চলে। বাইরে খেতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে এবং তারা রেস্তোরাঁয় এমন ধরনের খাবার নির্বাচন করছে, যা বাড়িতে রান্না খাবারের তুলনায় স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিসমৃদ্ধ নয়। ফলে মানুষ ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করছে। এতে স্থূলতার হার বৃদ্ধি পেয়ে পরিণামে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বর্ধিত করছে। আমেরিকা ও ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশগুলোয়ও খাদ্যবাহিত রোগে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ পীড়িত হচ্ছে। অনেককেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। শত শত মানুষ মৃত্যুবরণও করে। ফলে এসব দেশে নিরাপদ খাদ্য তৈরি ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়; যাতে রাসায়নিক কারণে শারীরিকভাবে বা জীবাণু থেকে খাদ্যদূষণে ভোক্তাদের স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি না হয়। আমাদের দেশে হোটেল, রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকানগুলোয় এ ধরনের সতর্কতা ও খাদ্যমান নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে।