নারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন
- রিয়াজুল হক
সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। বাংলাদেশের জনসংখ্যার এ বিশাল অংশকে বাদ দিয়ে যে দেশের সার্বিক জাতীয় উন্নয়ন আদৌ সম্ভব নয়, তা অনুধাবন করার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। সব ক্ষেত্রে নারীর সমসুযোগ ও সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা জাতীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বে বাংলাদেশ যে অবস্থান করে নিয়েছে সেটা নারীর ক্রমাগত অগ্রসরতাকে ঘিরেই সম্ভব হয়েছে। জাতিসংঘ ‘দ্রুত এগিয়ে চলা’ ১৮ দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে রেখেছে। সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে বাংলাদেশ অগ্রগতি লাভ করেছে। নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তি কার্যক্রম। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নিট ভর্তির হার বালক ৯৯.৪ এবং বালিকা ৯৭.২ শতাংশ।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ জোরদার করার ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। নারীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১’। সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীর অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে গৃহীত হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। প্রযুক্তিজগতে নারীদের প্রবেশকে সহজ করতে ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্রের মতো ইউনিয়নভিত্তিক তথ্যসেবায় উদ্যোক্তা হিসেবে একজন পুরুষের পাশাপাশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে একজন নারী উদ্যোক্তাকেও। তবে শিক্ষার হার কিংবা কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ যেভাবে দ্রুতগতিতে বাড়ছে, ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ সে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। দেশের স্বার্থে পিছিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। স্বনির্ভর দেশ গঠনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যদি কোনো নারী ব্যক্তিমালিকানাধীন বা প্রোপ্রাইটরি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রোপ্রাইটর হন কিংবা পার্টনারশিপ বা জয়েন্ট স্টক কম্পানিতে নিবন্ধিত প্রাইভেট কম্পানির শেয়ার অন্যূন ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক হন, তবে তিনি নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত হবেন। গত ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অর্থায়নসংক্রান্ত সংশোধিত মাস্টার সার্কুলার প্রকাশ করা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলার মোতাবেক, মোট এসএমই ঋণের মধ্যে এসএমই নারী উদ্যোক্তা ঋণের কাঙ্ক্ষিত হার হবে ন্যূনতম ১০ শতাংশ। আগামী পাঁচ বছরে এই হার ১৫ শতাংশে উন্নীত করার পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬ অনুযায়ী ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ঋণের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। একটি জাতীয় দৈনিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বরাত দিয়ে বলা হয়, চলতি বছরের ছয় মাসে এসএমই খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৬৯ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে নারী উদ্যোক্তারা পেয়েছেন তিন হাজার ৮২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৫ শতাংশ ঋণও নারী উদ্যোক্তারা পাননি। এই সময়ে নতুন নারী উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও হ্রাস পেয়েছে। ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত নারী উদ্যোক্তাদের তিন হাজার ১৫৮টি প্রতিষ্ঠান ৫৯৫ কোটি টাকার ঋণ পেয়েছে। বিগত বছরের একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল তিন হাজার ৮২৩। সংখ্যাটি কমে যাওয়া আদৌ কাম্য হতে পারে না।
ব্রিটিশ কাউন্সিল ‘দ্য স্টেট অব সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ ইন বাংলাদেশ’ এবং ‘সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ পলিসি ল্যান্ডস্কেপ ইন বাংলাদেশ’ নামে পরিচালিত গবেষণার তথ্য মতে, বাংলাদেশে সাধারণ ব্যবসায় নারী নেতৃত্ব ৫ শতাংশ এবং সামাজিক ব্যবসার ২০ শতাংশের নেতৃত্ব রয়েছে নারীদের হাতে। বর্তমানে দেশে এক লাখ ৫০ হাজার সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং মোট কর্মীর ৪১ শতাংশই নারী।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে নারী উন্নয়ন বাজেট ছিল ৭১ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নারী উন্নয়ন বাজেট ধরা হয়েছে ৯২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। নারী উন্নয়নে বরাদ্দের শতকরা হার দেশের মোট বাজেটের হিসাবে বৃদ্ধি পেয়েছে ২৭.২৫ শতাংশ। এটা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। আমাদের নারীদের অবমূল্যায়ন করার কোনো সুযোগ নেই। নিজেদের যোগ্যতায় তারা এগিয়ে যাচ্ছে। এখন তাদের জন্য প্রয়োজন সুযোগ-সুবিধার প্রসার। স্বাবলম্বী হওয়া যেকোনো দেশের স্বনির্ভরতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নারীকে আত্মনির্ভরশীল করার জন্য নারীর উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের প্রবাহ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বৃদ্ধির জন্য প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসতে হবে। নারী উদ্যোক্তারা পারবে না, এটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। চ্যালেঞ্জ গ্রহণে ইচ্ছুক নারীরা নির্দিষ্ট ছকের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে অবশ্যই দেশকে এগিয়ে নেবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত হিসেবে গড়ে উঠবে। প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিল্পনীতি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসএমই অর্থায়নবিষয়ক সার্কুলারে নারীদের ঋণ প্রদানের বিষয়ে যে নির্দেশিকা প্রদান করছে, সেগুলো সঠিকভাবে পরিপালন করলে আমাদের নারীরা দেশ গঠনে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। আমাদের সবার প্রত্যাশা স্বনির্ভর বাংলাদেশ, যা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণের মাধ্যমেই সম্ভব।
লেখক : উপপরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক