উন্নয়ন উদ্ভাবন কৌশল ও আজকের বাংলাদেশ
- মো. শহীদ উল্লা খন্দকার
জনপ্রশাসনের মূল দায়িত্ব জনগণকে সেবা প্রদান এবং শৃঙ্খলা রক্ষা— যার দুটোই নিয়ম-নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রচলিত ধারণা হলো, জনপ্রশাসনের পক্ষে এই নিয়ম-নীতির বাইরে বেরিয়ে চিন্তা করা বা কাজ করা অত্যন্ত দুরূহ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে সরকার বর্তমানে রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে, সেই সরকার জনপ্রশাসন নিয়ে সাধারণ নিয়ম-নীতির বাইরে জনগণের উন্নয়ন ও কল্যাণ হয়, এমন বিষয়গুলো নিয়ে উদ্ভাবনমূলক কাজ করে যাচ্ছে। যেকোনো উদ্ভাবনের শুরু হয় প্রথা বা নিয়মের বাইরে এসে এবং নিয়ম-নীতির বাইরে কাজ করে। কিন্তু বর্তমান সরকার সম্পূর্ণ নিয়ম-নীতি বজায় রেখে ও জনপ্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে জনকল্যাণ ও মানুষের উন্নতি হয় এমন বিষয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে উদ্ভাবনমূলক কাজ করে যাচ্ছে।
অনেকেই জানেন, দেশের সকল ইউনিয়ন পরিষদে যে ডিজিটাল সেণ্টার আছে সেখানে প্রতি মাসে প্রায় ৪৫ লক্ষ সুবিধাবঞ্চিত মানুষ প্রায় ১০০টিরও বেশি সেবা নিতে যান; জমির পর্চা নিতে এখন ৪০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে জেলা প্রশাসকের রেকর্ডরুমে ভোগান্তির কবলে পড়তে হয় না— সেটির আবেদন করা যায় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেণ্টার থেকে। যে জন্ম নিবন্ধন ১৮৭৩ সাল থেকে শুরু করে ২০১০ সাল নাগাদ ১৩৭ বছরে মাত্র ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিল, তা গত ৯ বছরে প্রায় ৯০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। একজন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হতদরিদ্রদের জন্য একটি স্বাস্থ্য-কার্ড চালু করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের সেবা দিচ্ছেন; একজন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ডিজিটাল জ্ঞানভাণ্ডার তৈরি করে তার মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফসলের রোগের প্রতিকার বাতলে দিচ্ছেন; উপজেলা ভূমি অফিসে নামজারি করতে ৪৫ দিনের পরিবর্তে এখন গড়ে ১৫ দিন লাগছে; প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লক্ষাধিক শিক্ষক একে অন্যকে শিখিয়ে শিক্ষক-প্রশিক্ষণে এক অভিনব মাত্রা যোগ করেছেন। অনেকে নিশ্চয়ই জানেন, প্রতিটি জেলা প্রশাসক ফেসবুক ব্যবহার করে জনগণের ভোগান্তির চিত্র আহ্বান করছেন এবং তার প্রতিকারের জন্য সচেষ্ট হচ্ছেন।
রূপকল্প ২০২১কে উপজীব্য করে ডিজিটাল বাংলাদেশের জনবান্ধব প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে একটি মধ্যম আয়ের দেশ গড়ার যে প্রত্যয়ে জনপ্রশাসন নিজেকে নিয়োজিত করেছে তারই অনন্য উদাহরণ হলো উপর্যুক্ত এই বিষয়গুলো। রূপকল্প ২০২১ (মধ্যম আয়ের দেশ) এবং রূপকল্প ২০৪১ (উচ্চ আয়ের দেশ) ঘোষণার পর জনপ্রশাসন, বিশেষ করে মাঠ প্রশাসন নিজেকে কীভাবে জনবান্ধব করার সুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছে তারই প্রমাণ পাওয়া যায় উপর্যুক্ত কাজগুলো করার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য যে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই (একসেস টু ইনফরমেশন) প্রকল্পের যৌথ প্রয়াসে গত বছরের জুলাই মাসে ‘উন্নয়ন উদ্ভাবনে জনপ্রশাসন’ শীর্ষক যে আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করা হয়, সেখানে উন্নয়ন উদ্ভাবনে জনপ্রশাসনকে কাজে লাগানোর বিষয়টি পূর্ণতা পায়। প্রধানমন্ত্রী এ সম্মেলনটির উদ্বোধন করেন। বাত্সরিক জেলা প্রশাসক সম্মেলনকে পাশে রেখে অনুষ্ঠানটির আয়োজনের ফলে সকল জেলা প্রশাসকসহ সকল বিভাগীয় কমিশনার এ সম্মেলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন। জনকল্যাণে উদ্ভাবনের যে জোয়ার মাঠ প্রশাসনে বয়ে যাচ্ছে তার উপযুক্ত সমন্বয়কের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকগণ। তাই এ সম্মেলনে তাদের অংশগ্রহণ অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং এটি একমাত্র সম্ভব হয়েছে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের পাশাপাশি ওই আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করার ফলে। জনপ্রশাসনে নতুন এই সংস্কৃতির বীজ বপিত হয়েছিল আজ থেকে ৮ বছর আগে ২০০৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর থেকেই। জনপ্রশাসনের ক্ষেত্রে বিগত ৮ বছরে চালু হওয়া চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষণীয়। যেমন:
১. মান্ধাতার আমলের সেবাপদ্ধতি বদলে নতুন সেবাপদ্ধতি চালু হচ্ছে। কোথাও কোথাও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দূরত্ব এবং খরচ কমিয়ে ফেলা হচ্ছে যাতে করে সেবা যথাসম্ভব সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু তার থেকেও বেশি জরুরি, আবেদন করার পর যতগুলো ধাপ পেরিয়ে একজন সাধারণ মানুষ সেবাটি পেতেন, তা কমিয়ে ফেলা হচ্ছে যাকে অভিহিত করা হচ্ছে— সেবা পদ্ধতি সহজিকরণ নামে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর এবং জেলা প্রশাসনে সেবাপদ্ধতি সহজিকরণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
২. সেবা প্রদানে উদ্ভাবনের একটি সহজ সংজ্ঞা তৈরি করা হয়েছে। কোনটাকে উদ্ভাবন বলা হবে আর কোনটাকে না, সেটা নিয়ে যখন বিভিন্নমুখী আলোচনা হয়েছে সরকারের নানা পর্যায়ে, তখন এটুআই থেকে এই সংজ্ঞাটি বেরিয়ে আসে এবং তা সরকারের সকল মহলে গৃহীত হয়। সে উদ্যোগটাকেই সরকারি সেবায় উদ্ভাবন বলা হচ্ছে যা নাগরিকের সময়, খরচ ও যাতায়াত (Visit) অর্থাত্ TCV কমায়। মূল্যায়ন করে দেখা গেছে সেবা দেওয়ার বেলায় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলো আগের তুলনায় ৮৫ শতাংশ সময়, ৬৩ শতাংশ খরচ এবং ৪০ শতাংশ যাতায়াত কমিয়েছে। ২৩টি সেবার উপর মূল্যায়ন-গবেষণা থেকে জানা গেছে, সেবা নিতে গিয়ে গত ৮ বছরে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সাশ্রয় হয়েছে ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৪ হাজার ৪ শ কোটি টাকা।
৩. ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া উদ্ভাবন সম্ভব নয়। অথচ প্রচলিত পদ্ধতির রূপরেখাই করা হয়েছে ঝুঁকি এড়ানো ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা। এটি শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই নয়, পৃথিবীর প্রায় সব সরকারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক আমল থেকে উদ্ভূত সরকারের ক্ষেত্রে এটি অতি সাধারণ চিত্র। জনগণকে শাসন করাই ছিল যে নকশার মূল লক্ষ্য, সেটিকে বদলিয়ে জনবান্ধব করা কঠিন। নিয়ম-নীতি, চর্চা, প্রশিক্ষণের ধরন, দর্শন সবকিছুতেই আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। কিন্তু প্রশাসনে বিপ্লব (revolution) সম্ভব নয় তবে বিবর্তন (evolution) সম্ভব। সেই বিবর্তনকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যেই উদ্ভাবনের ব্যাপারে জোর দেওয়া হচ্ছে এবং ঝুঁকি নিতে বলা হচ্ছে। ছোট বা বড় উদ্ভাবনের যে উদাহরণগুলো শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, তার প্রতিটিতেই উদ্ভাবকগণ ঝুঁকি নিয়েছেন। সকল ক্ষেত্রেই উদ্ভাবকের নিজের মানসিকতায় মৌলিক পরিবর্তন এসেছে এবং বাস্তবায়নকারী টিমের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উদ্ভাবককে প্রচলিত প্রথা এবং চর্চার ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হয়েছে। অনেকের বিরাগভাজন হতে হয়েছে, স্বার্থান্বেষী মহলের কাছ থেকে বিরোধিতাও এসেছে। কিছু ক্ষেত্রে নিয়ম ভঙ্গ করতে হয়েছে। এখন ঝুঁকি নেওয়ার একটি সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এটি মন্ত্রণালয় পর্যায়ে দৃশ্যমান না হলেও মাঠ প্রশাসনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে ৫শটির বেশি উদ্ভাবনী উদ্যোগ মাঠ পর্যায়ে চলছে যা উদ্ভাবকগণ নিজ উদ্যোগে শুরু করেছেন। কৃষিতে চেষ্টা চলছে কৃষকের প্রশ্নের উত্তর জরুরিভাবে দেওয়ার; স্বাস্থ্যে চলছে সুবিধাবঞ্চিতদের আরো উন্নত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার; ভূমিতে চলছে দুর্নীতির সুযোগগুলো কমানোর এবং দ্রুত সেবা প্রদানের; যুব প্রশিক্ষণে চেষ্টা করা হচ্ছে কারিকুলামকে বাজার চাহিদার ভিত্তিতে ঢেলে সাজানোর। নীতি-নির্ধারকগণ গত বছরগুলোতে কয়েকশ অনুষ্ঠানে জনসমক্ষে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বলেছেন ‘ঝুঁকি নিন, উদ্ভাবন করুন, TCV কমান, মানুষের ভোগান্তি কমাতেই হবে।’
৪. প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহল থেকে ‘শাসক থেকে সেবক হোন কাজে, কথায় এবং ব্যবহারে’ এ বিষয়টি শুধু বলাই হচ্ছে না মনিটর করা হচ্ছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। শুধু লাঠি নিয়ে কর্মকর্তাদের ভয় দেখানো হচ্ছে না, পুরস্কার দিয়ে তাঁদেরকে উত্সাহ এবং অনুপ্রেরণা দেওয়া হচ্ছে। আর এসবের অংশ হিসেবে প্রেরণা হিসেবে প্রথমবারের মতো জনপ্রশাসন পদক দেওয়া হয়েছে দুই কর্মকর্তাকে, দুইটি দলকে এবং দুইটি প্রতিষ্ঠানকে।
যে চারটি বিষয় উল্লেখ করা হলো, তা সম্যকভাবে উঠে এসেছে উন্নয়ন উদ্ভাবনে জনপ্রশাসন ২০১৬ সম্মেলনে। রাজধানী ঢাকার যে নীতি-নির্ধারকগণ জনবান্ধব প্রশাসন গড়ার লক্ষ্যে উদ্ভাবনী সংস্কৃতি ও ঝুঁকি নেওয়ার বিষয়টিকে উত্সাহ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিসহ মাঠ প্রশাসনের রূপান্তরের গল্পগুলো শোনেন, স্টলগুলো ঘুরে দেখেন জনপ্রশাসনে মানসিকতার পরিবর্তন দেশের উন্নয়নে কী নজিরবিহীন পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। যে নীতি-নির্ধারকরা বা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা খুব একটা মাঠে যাওয়ার সুযোগ পাননি, তারা অবাক হয়ে দেখেন দীর্ঘদিনের অচলায়তন ভেঙে মাঠ প্রশাসন এখন উদ্ভাবনের বিপুল কর্মযজ্ঞে নিবেদিত। প্রতিটি স্টলে মন্ত্রী, সচিব এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা দর্শনার্থীদের ব্যাখ্যা করেছেন তাঁদের সেবা পদ্ধতি কীভাবে সহজ এবং আরো জনবান্ধব হচ্ছে। ছুটির দিনে সরকারি কর্মকর্তাদের উপচে পড়া ভিড় দেখে বোঝা গেছে এ রকম একটি আয়োজনের জন্য জনপ্রশাসনের সদস্যরা কতটুকু অধীর ছিলেন।
উন্নয়ন উদ্ভাবনের ওই সম্মেলনটি সরকারি সেবা প্রদানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বা ই-গভর্নেন্সের প্রদর্শনী ছিল না মোটেই। আক্ষরিকভাবেই এটি ছিল সেবায় জনপ্রশাসনের রূপান্তরের প্রদর্শনী। অনুষ্ঠানের প্রথম দিন শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য নির্ধারিত থাকলেও দ্বিতীয় দিনে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় দিনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ এবং শিক্ষার্থীদের আমন্ত্রণ জানালে সমাজের নানা স্তরের মানুষ জানতে পারেন, সরকারি সেবা এখন সহজে পাওয়া যাচ্ছে, মাঠ প্রশাসন বদলাচ্ছে এবং সমগ্র জনপ্রশাসন বদলানোর জন্য তৈরি হচ্ছে। এখন শুধু দরকার জনগণের উত্সাহ, সহযোগিতা এবং নিরন্তর তাগিদ।
জনপ্রশাসনকে জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে একসেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রামের আওতায় সেই নিরন্তর তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই তাগিদকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা যার যার দায়িত্ব সঠিক ও উদ্ভাবনমূলক মানসিকতা নিয়ে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করলে, তবেই রূপকল্প ২০২১-এর মাধ্যমে মধ্যম আয়ের দেশ এবং রূপকল্প ২০৪১এর মাধ্যমে উচ্চ আয়ের দেশ হতে বাংলাদেশকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না।
লেখক : সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার