নেটফ্লিক্স এন্ড চিল : এক অঘোষিত রাজার উত্থান!
- মো: তানভীর রহমান
নেটফ্লিক্স এন্ড চিল! বাক্যটির সাথে পরিচয় নেই এমন সিনেপ্রেমিক তরুন বা তরুনীর সংখ্যা অন্তর্জালে হয়ত খুব কমই রয়েছে। মাত্র ৩০ জন কর্মচারী নিয়ে একটি অনলাইন ডিভিডি রেন্ট কোম্পানি হিসেবে এর যাত্রা শুরু হলেও আজ এটি একটি জায়ান্ট টেক এ পরিণত হয়েছে। যার বর্তমান বাজার দর প্রায় ২৪১ বিলিয়ন ডলার। ক্যালেফোর্নিয়ার এক ছোট্ট গ্যারেজ থেকে শুরু হওয়া ডিভিডি রেন্টাল কোম্পানি কিভাবে আজ স্ট্রিমিং মার্কেটের অঘোষিত রাজায় পরিণত হল চলুন সে গল্পই শোনা যাক।
শুরুটা হয়েছিল ক্যালফোর্নিয়ার দুই উদ্যোক্তা রিড হ্যাস্টিংস ও মার্ক র্যান্ডলপের হাত ধরে ১৯৯৭ সালে। যারা কিনা আপনার আমার মতোই সিনেপ্রেমিক ছিল। ঠিক এক বছর পরেই মাত্র ৯২৫ টি ডিভিডি ও ৩০ জন কর্মচারী নিয়ে একটি মুভি রেন্টাল সার্ভিস হিসেবে এর প্রথম যাত্রা শুরু হয়। যেটি ছিল বিশ্বের প্রথম অনলাইন ডিভিডি রেন্টিং সার্ভিস।
এর ব্যবহারকারীরা প্রথমে নেটফ্লিক্সের ওয়েব সাইট থেকে মুভি অর্ডার করে পরে মেইলের মাধ্যমে সংগ্রহ করত আর তা দেখা শেষ হলে আবার মেইল এর মাধ্যমেই ফেরত দিত। এবার প্রশ্ন জাগছে না কত দিনের মধ্যে ফেরত দিতে হত? বলব তবে তার আগে ছোট্ট একটি গল্প বলি। গল্পটা আমার না গল্পটি মূলত রিড হ্যাস্টিংসের। রিড হ্যাস্টিংস একবার ব্লকবাস্টার থেকে এ্যপোলো -১৩ (Apollo 13) নামের একটি মুভির ডিভিডি রেন্টে এনেছিল। কিন্তু তিনি ডিভিডি টি সময়মত ফেরত দিতে পারেননি ব্লকবাস্টারকে। আর যার জন্য গুনতে হয় ৪০ ডলার। আর সে জন্য নেটফ্লিক্স থেকে কোন ডিভিডি রেন্টে আনা হলে তিনি তাতে কোন সময়সীমা দেননি। তবে নতুন একটি ডিভিডি নিতে হলে আপনাকে পুরাতনটি ফেরত দিতে হত।
তবে কি এখান থেকেই ব্লকবাস্টারের সাথে রিড হ্যাস্টিংসের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠা? হয়ত তাই আবার হয়ত না। কারন সে সময় আমেরিকাতে ব্লকবাস্টার ছিল সব থেকে বড় রেন্টাল সার্ভিস। প্রায় নয় হাজার দোকান ছিল তাদের। আর অন্য দিকে নেটফ্লিক্স তার অনলাইন যাত্রায় নিয়ে আসলো নতুন কিছু। ১৯৯৯ সালে নেটফ্লিক্স তাদের প্রথম সাবস্ক্রিবসন সার্ভিস চালু করে। যার মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা একটি মাসিক ফি এর আওতায় আনলিমিটেড ডিভিডি ভাড়া নিতে পারত। ২০০০ সালে নেটফ্লিক্সের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ লাখ ছাড়িয়ে যায়। সেসময় নেটফ্লিক্স ব্লকবাস্টারকে ৫০ মিলিয়ন ডলারে তাদের সার্ভিসটি কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু ব্লকবাস্টার তখন তাদের প্রস্তাবের প্রতি অনাগ্রহ প্রকাশ করে। কেননা তখনকার সময়ে নেটফ্লিক্সের ব্লকবাস্টারের তুলনায় এত চাহিদা এবং জনপ্রিয়তা ছিল না। সে সময় শুধুমাত্র রেন্টাল ডিভিডি সার্ভিসের ব্যবস্থা করা হতো। কিন্তু নেটফ্লিক্স তার যাত্রা সেখানেই থামিয়ে দেয় নি।
এরপর নেটফ্লিক্স মানুষকে পরিচয় করায় তাদের নতুন সার্ভিস ব্যক্তিগত মুভি সুপারিশের সাথে। যেখানে কিনা আপনি আপনার পছন্দের মুভি সুপারিশ করতে পারবেন আর সব থেকে বেশী সুপারিশওয়ালা মুভি নেটফ্লিক্স আপনাকে দিত। এরকম সুযোগটা তখন মানুষের ভালো লাগতে শুরু করে যার ফলে নেটফ্লিক্সের ব্যবহারকারীর সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৮ লাখ ৫৭ হাজারে। আর তার পরের বছরেই নেটফ্লিক্স ১ মিলিয়নে পৌছায়। আর এভাবেই বেশ কিছু দিন ডিভিডি রেন্টিং সার্ভিস দিয়ে অনলাইনে রাজ করে যাচ্ছিল নেটফ্লিক্স।
এত মাত্র রাজ করার গল্প। এবার আসি অনলাইন স্ট্রিমিং মার্কেটের অঘোষিত রাজায় কিভাবে পরিনিত হল সেই গল্পে। নেটফ্লিক্স অনেক আগেই বুজতে পেরেছিল ভবিষ্যৎ অনলাইনে স্ট্রিমিং সার্ভিসের চাহিদা সবার শীর্ষে থাকবে যা ব্লকবাস্টার বুজতে পারে নি। আর হয়ত সে কারনেই নেটফ্লিক্স আজ একটি জায়ান্ট টেক। যাইহোক মূল কথায় আসা যাক, ২০০৭ সালে নেটফ্লিক্স আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয় তাদের “ওয়াচ নাউ” (Watch Now) সার্ভিসের সাথে। যা নেটফ্লিক্সের এই যাত্রাকে বাক নিয়ে একটি সফলতার দিকে গুরিয়ে দেয়। আর এই সার্ভিসটির মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা সরাসরি তাদের কম্পি উটারের মাধ্যমে টিভি শোহ এবং মুভি দেখতে পারত।
মাত্র ১০০০ টি মুভি এবং টিভি শোহ নিয়ে তাদের এই স্ট্রিমিং সার্ভিসটি চালু করে। শুরুর দিকে নেটফ্লিক্স শুধু ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার এর মধ্যে সীমাবদ্ধতা থাকলেও ২০০৯ সালের মধ্যে এক্সবক্স, প্লে-স্টেশন (Xbox, Playstation, Smart TV) সহ আরও বিভিন্ন ইন্টারনেট যন্ত্রের মাধ্যমে মানুষ এর ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। এর পর শুরু করে এর বিস্তার। প্রথমে কানাডাতে এদের সার্ভিস চালু করেলেও এর পরে তাদের সার্ভিস যুক্তরাজ্য এবং আয়ারল্যান্ড সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চালু করে। তখন তাদের ব্যবহারকারীর সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ২৫ মিলিয়নে।
তবে একটি ভালো রাজার গুন কি? সহজ ভাষায় বললে যে রাজার প্রজারা তাকে পছন্দ করে সে রাজাই ভালো রাজা। আর অনেকটা এরকম ভাবেই হয়ত এই স্ট্রিমিং রাজা নিয়ে আসলো তার নতুন আবির্ভাব। যার জন্যই হয়ত আজও এই রাজা রাজ করে যাচ্ছে। তবে কি? হ্যা ২০১৩ সালে নেটফ্লিক্স নিয়ে আসলো তাদের অরিজিনাল কন্টেন্ট। যার জন্য বেশী জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে নেটফ্লিক্স।
আর সে জন্য নেটফ্লিক্স প্রতিবছর তাদের অরিজিনাল কন্টেন্টের পিছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা শুরু করে। তাদের প্রথম ৩ টি অরিজিনাল কন্টেন্ট ছিল হাউজ অব কার্ডস (House of Cards), হেমলক গ্রোভ (Hemlock Grove) এবং অরেঞ্জ ইস দ্যা নিউ ব্ল্যাক (Orange is The New Black). এরপর পরই নেটফ্লিক্স ইউরোপ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও নিওজিল্যান্ডে তাদের সার্ভিস নিয়ে আসে। ২০১৬ সালের মধ্যে বিশ্বব্যপী ১৩০ টি দেশে মোট ২১ টি ভাষায় নেটফ্লিক্স তাদের স্ট্রিমিং সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছিল। আর এই ২০১৬ সালে নেটফ্লিক্সের সবচেয়ে আলোচিত টিভি সিরিজ ছিল স্ট্রেঞ্জার থিংস (Stranger Things). ২০১৯ সালেও প্রায় ৬৪ মিলিয়ন ভিও নিয়ে এটি ছিল নেটফ্লিক্সের সবথেকে বেশী দেখা কন্টেন্ট। তাছাড়া মানি হেইস্ট (Money Heist) ও ডার্ক (Dark) এর মতন জনপ্রিয় কিছু সিরিজ নিয়ে আসে যা ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়।
এবার এর সফলাতার কিছু প্রতিফলন নিয়ে বলি। ২০১৭ সালে নেটফ্লিক্স প্রথম একাডেমি এওয়ার্ড পায়। দ্যা হোয়াইট হেলমেটস (The White Helmets) নামের একটি অরিজিনাল ডকুমেন্টরির জন্য এই একাডেমি এওয়ার্ড জিতে নেটফ্লিক্স। ২০১৮ সালে অরিজিনাল কন্টেন্টের জন্য নেটফ্লিক্স আরও বেশ কিছু একাডেমি এওয়ার্ড জিতে। এছাড়াও এমি এওয়ার্ডে ১১২ টি মনোনয়ন পায় নেটফ্লিক্সের বিভিন্ন অরিজিনাল কন্টেন্ট।
শেষ করব তবে কিছু কথা, ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী নেটফ্লিক্সের সাবস্ক্রাইব সংখ্যা ১৮৫ মিলিয়নের বেশি। এছাড়াও বিশ্বের মোট ১৯০ টি দেশে নেটফ্লিক্সের সুবিধা পেয়ে থাকে। দিন দিন এর সাবস্ক্রিপশনের সংখ্যা বেড়েই চলছে। অর্থাৎ মানুষের মাঝে এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বাংলাদেশেও এর জনপ্রিয়তা ব্যাপক। তবে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে এর পিছনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় যাতে না করা হয়। এর নেতিবাচক দিক পরিহার করে ভালো দিকগুলো দেখতে হবে।
প্রতিবেদকঃ শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি