পিংক ট্যাক্স আবার কী!
- শারমিন নিশু
পৃথিবীতে বেশির ভাগ জিনিসের একটা ব্ল্যাক ভার্সন থাকে। এর সব থেকে সহজ উদাহরণ ব্ল্যাক মানি। এখন ট্যাক্সের ক্ষেত্রে এসে পিংক ট্যাক্স শুনেই অনেকেই অবাক হতে পারেন। মনে হতেই পারে এটা আবার কেমন ট্যাক্স! তবে নামের আগে পিংক দেখে অবচেতন মন লিঙ্গ ভেদাভেদের কিছু ইঙ্গিত পেতে পারেন। বিষয়টা আসলেই সেরকম। পিংক ট্যাক্স মূলত কোনো রাষ্ট্রীয় ট্যাক্স নয়। এটি হচ্ছে কিছু জিনিসের উপর পুরুষরা যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করে নারীদের ক্ষেত্রে তার থেকে বেশি অর্থ প্রদান করতে হয়। অর্থাৎ একই পণ্য বা কাছাকাছি ধরনের পণ্যে পুরুষের তুলনায় নারীরা যে অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে থাকে সেটাই পিংক ট্যাক্স।
পিংক ট্যাক্স কি এই প্রশ্নের উত্তরেই আমরা এটি যে একপ্রকার লিঙ্গ বৈষম্য তার প্রমাণ আমরা পেয়ে যাই। এবার আমরা যদি এবিষয়টি নিয়ে করা বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলের দিকে তাকাই তাহলে এই বৈষম্য সম্পর্কে আরো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। পিংক ট্যাক্স বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রসাধনী সামগ্রী বা ব্যক্তিগত কেয়ারের জিনিসের জন্য নারীদের দিতে হয়। যেমন শুধু রঙের পার্থক্যে একই মানের ডিওডোরেন্টের জন্য ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের গড়ে ৩০ সেন্ট বেশি খরচ করতে হয়। অথচ নারীদের জন্য গোলাপি আর পুরুষদের জন্য নীল রঙ ছাড়া তেমন কোনো পার্থক্যই ডিওডোরেন্টে থাকে না।
এমনকি সামান্য একটি রেজার কেনার ক্ষেত্রেও ছেলেরা যে পরিমাণ অর্থ দেয় মেয়েদের জন্য তা প্রায় তিনগুণ বেশি। তথ্য অনুযায়ী, ভারতে একটি রেজারের জন্য পুরুষদের দিতে হয় ৮০ রুপি আর নারীদের ক্ষেত্রে সেটা ২৫০ রুপি।
মেয়েদের পিরিয়ড সম্পর্কিত পণ্যের জন্যও অধিক মূল্য পরিশোধ করতে হয়। ভারতে এ নিয়ে প্রতিবাদ হলে ২০১৮ সালে সরকার এসব পণ্যের উপর ১২% মূল্য কমিয়ে আনে। কিন্তু বাকি অনেক জিনিস এই মূল্যহ্রাসের আওতাবহির্ভূত রয়ে গেছে, যেগুলো শুধু মেয়েদের ব্যবহার উপযোগী বলে বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এরমধ্যে মেয়ে শিশুদের খেলনাও অন্তর্ভুক্ত। খেলনা, পুতুল এমনকি পোশাকেও শুধু মেয়েদের উদ্দেশ্যে বাজারজাত হয়েছে বলে গুণগত মান একই হওয়া স্বত্বেও তার দাম লিঙ্ক ভেদে বেড়ে যায়।
এখন প্রতিবাদের কারণে পিরিয়ড সম্পর্কিত পণ্যে মূল্য হ্রাস হলেও বাকি ক্ষেত্র গুলোতে পিংক ট্যাক্স এড়ানোর সম্ভাবনা খুব একটা নেই। বলা যায় পিংক ট্যাক্স বাহ্যিক সৌন্দর্যকে হাতিয়ার করে পু্ঁজিবাদীর একটা প্রতারণামূলক উদাহরণ। কারণ নারীদের প্রসাধনী, ব্যবহারযোগ্য জিনিসকে একটা খোলসে আড়ালে রেখে অর্থাৎ নারীদের দুর্বলতাকে পুঁজি করে ব্যবসা করে যাচ্ছে।
এর থেকে বেরোনোরও তেমন সম্ভাবনাময় উপায়ের হদিশ নেই বললেই চলে। কারণ এই বিষয় সম্পর্কে এখনো অনেকের স্পষ্ট ধারণাও নেই। অল্প সংখ্যক নারীই আছেন যারা এই পিংক ট্যাক্সের বিষয়টা কাটিয়ে উঠতে পারেন। বাকীরা নিজেরাও জানেনা প্রতিবছর এই পিংক ট্যাক্সের নামে কত টাকা ব্যয় করে ফেলছেন। ফোর্বসের সূত্রানুযায়ী, প্রতি বছর নারীরা এই পিংক ট্যাক্সের নামে ১৪০০ ডলার অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে থাকে। নিউ ইয়র্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অভ কনজ্যুমার অ্যাফেয়ার্সের হিসেব অনুযায়ী, এই অর্থ একজন নারী তার জীবনের প্রথম ৩০ বছরে ৪০,০০০ ডলারে দাঁড়ায়।
অথচ একটু খুঁটিয়ে দেখলে একটা রেজারের ব্যবহার কিন্তু নারী-পুরুষ ভেদে বদলে যায় না। তাও শুধু নীলে জায়গায় গোলাপি রঙের খোলসে নারী-পুরুষ ভেদে তার দাম বদলে যায়। আবার এদিকে আয়ের হিসেবেও নারীদের অবস্থান যথেষ্ট বৈষম্যপূর্ণ। একই শ্রম দিয়েও নারীদের আয় পুরুষের তুলনায় কম। বিশেষ করে কৃষিভিত্তিক সমাজে এটা বেশ ভালো করে বোঝা যায়। কৃষিকাজে শ্রম সমান বা বেশি দিয়েও আয় কিন্তু পুরুষেরই বেশি হয়। তাহলে প্রশ্ন থেকে আয়ের হিসেবেও নারীরা পিছিয়ে, তাহলে তাদের জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় ব্যয়ে তাদের বেশি দিতে হবে কেন?
তাহলে এ পরিস্থিতি নারীরা কিভাবে অতিক্রম করবে? সেখানে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গী নাকি নারীদের সচেতনতা কাজে দেবে? সচেতনতার কথা আসলে বলা যায়, নারীরা একই জিনিস পুরুষের জন্য বাজারজাতকৃত পণ্যটি ব্যবহার করতে পারে। তাতেও কি খুব একটা পরিস্থিতি বৈষম্যহীন হবে? সে এক গোলকধাঁধার মত ধোঁয়াশার বিষয়। তবে এ বিষয়ে নারীদের জ্ঞান থাকা অতি জরুরি। যে পিংক ট্যাক্সের কতটা অতিরিক্ত দাম দিচ্ছে তারা।