চেস্টার বেনিংটন: এক হারিয়ে ফেলা নক্ষত্র
- পুলক বিশ্বাস পার্থ
ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা শব্দটার সাথে মোটামুটি পরিচিত আমরা সবাই। এটা এমন এক রোগ যা থেকে সাময়িক মুক্তি পাওয়া গেলেও একেবারে খুব ঝেড়ে ফেলে দেয়াটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। শুধুমাত্র গানের কথা এবং গলা দিয়ে বিশ্বের লক্ষকোটি তরুণ-তরুণীর কাঁধে যিনি হাত রেখেছিলেন, দিনশেষে সেই চেস্টার চার্লস বেনিংটন নিজেই ডুবে গিয়েছিলেন বিষণ্ণতার অতল গহ্বরে। পরিচয়ে আমেরিকান সঙ্গীতশিল্পী, রচয়িতা এবং অভিনেতা হলেও জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছেছিলেন লিংকিন পার্ক ব্যান্ডের ভোকালিস্ট হিসেবে।
১৯৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনের ফিনিক্সে জন্মগ্রহণ করেন চেস্টার। বাবা লি রাসেল বেনিংটন পেশায় ছিলেন গোয়েন্দা পুলিশ, যার কাজ ছিল শিশুদের প্রতি যৌন আচরণের অপব্যবহারের তদন্ত করা এবং মা সুজান এলায়নে জনসন ছিলেন নার্স। ছোটকাল থেকেই সঙ্গীতের প্রতি চেস্টারের আকর্ষণ ছিল চোখে পড়ার মত।
সব ঠিকঠাক চলছিলো। হঠাৎ চেস্টারের ৯ বছর বয়সের মাথায় ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় বেনিংটন দম্পতির। চেস্টারের দায়িত্ব পান তার বাবা। বাবা-মায়ের ভালোবাসা একসাথে না পাওয়াতেই মূলত এর পর থেকেই চেস্টার মারিজুয়ানা, মদ, অপিয়াম, কোকেইন, মেটাফেটামিন, এল এস ডি’র মত ভয়ঙ্কর সব মাদকের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। তবে তার এই আসক্তির জন্যে ছিলো আরেকটি কারণ। ৭ বছর বয়সে চেস্টার তার থেকে বয়সের বড় এক ছেলে বন্ধুর থেকে যৌন অপব্যবহারের স্বীকার হয়েছিলেন। তাকে কেউ সমকামী বলে জানবে সেই ভয়ে কারও কাছে কিছু বলা থেকে নিজেকে বিরত রাখাই শ্রেয় মনে করেন তিনি। এমন সব অশান্তি থেকে বাঁচার জন্য তিনি সেই বয়স থেকেই ছবি আঁকা এবং এবং গান লেখা শুরু করেন।
১৭ বছর বয়সে চেস্টার মায়ের কাছে ফিরে আসলেও মাদকের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তির কারণে তাকে ঘর থেকে বের হতে দেয়া হয় না। তারপরেও সব উপেক্ষা করে চেস্টার শুধুমাত্র মাদক কেনার জন্য বার্গার কিং নামের বিখ্যাত বার্গার তৈরির কারখানায় কাজ শুরু করেন। স্কুলে পড়ার সময় দুর্বল শরীরের কারণে তার সহপাঠীদের কাছে হাসির পাত্র হতেন তিনি, যা ছিল তার বিষণ্ণতার আরো একটি উল্লেখযোগ্য কারন।
ছোটবেলা থেকে চেস্টারের একটাই বন্ধু ছিল যার সাথে সে সব খারাপ ভালো মুহূর্ত কাটিয়েছে। সেই ক্রিস; পুরো নাম বললে হয়তো আরো ভালোভাবে চেনা যাবে ক্রিসকে। হ্যাঁ, আরেক রক সম্রাট ক্রিস কর্নেল ছিলো চেস্টারের ছোটবেলার বন্ধু। একসাথে দুই বন্ধুকে মঞ্চেও দেখা গিয়েছে একবার। ২০১৭ সালের মে মাসে আত্মহত্যা করে বসেন ক্রিস কর্নেল। একমাত্র কাছের বন্ধুকে হারিয়ে কি করবেন বুঝে উঠছিলেন না চেস্টার। বন্ধুর আত্মহননের সেই রাতেই জিমি কিমিলের সরাসরি অনুষ্ঠানে প্রিয় বন্ধুকে উৎসর্গ করে শোনায় ‘ওয়ান মোর লাইট’ গানটি। সেদিন প্রয়াত বন্ধুর উদ্দেশ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা চিঠিও লিখেছিলেন চেস্টার।
সেই ক্রিস কর্নেলের ৫৩তম জন্মদিনে বন্ধুর মত করেই গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন চেস্টার। ঠিক কি কারনে চেস্টারের এই কঠিনতম পথ বেছে নেয়া তা আজও কেউ সঠিকভাবে বলতে পারেনি। কেউ বলে বন্ধু হারানোর শোক আবার কেউ বলে অতিরিক্ত মাদকাসক্তের ফল। কারন যেটাই হোক, সবকিছুর মূলে যে ওই এক ‘বিষণ্ণতা’ সে ব্যাপারে সবাই একমত।
চেস্টারের চলে যাওয়ার পর ব্যান্ড মেম্বার মাইক শিনোডা বলেছিলেন, প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে পড়তেন চেস্টার। এমনকি রেকর্ডিং চলাকালীন সময়েও। মাঝেমধ্যে ভুলে যেতেন গানের লাইনও।
সঙ্গীতে চেস্টারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু ১৯৯৩ সালে। মূল ভোকালিস্ট হিসেবে যোগ দেন স্থানীয় ব্যান্ড গ্রে ডেজ-এ। সেখান থেকেই পথচলার শুরু তার। ‘সামটাইমস’-এর মত গান ছুঁয়ে ফেলে শত ভক্তের মন, যা ছিলো তার নিজের লেখা। তবে সেখানে বেশিদিন কাটাতে পারেনি চেস্টার। পাঁচ বছরের মাথায় গ্রে ডেজ ছেড়ে চলে আসেন তিনি। এই ছাড়াছাড়ি আগে তার দেখা হয় জোম্বা মিউজিকের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেফ ব্লু’র সাথে। ব্লু তাকে জানান যে জিরো ব্যান্ডের ভোকালিস্টের জন্যে অডিশন চলছে। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন জিরো ব্যান্ডে অডিশনের জন্যে লস এঞ্জেলসে উড়ে যান চেস্টার। তার গলা শুনে ব্যান্ডের অন্যান্য সদস্যরা সেই অডিশন দীর্ঘায়ত না করে তখনই বেছে নেয় তাকে। সেই জিরো ব্যান্ডই আজকের লিংকিন পার্ক।
বেনিংটনের যোগদানের পর ব্যান্ডটির নাম প্রথমে রাখা হয় হাইব্রিড থিওরি। নাম সবার মনের মত না হওয়ায় পুনরায় নাম খুঁজতে থাকে সবাই। চেস্টারের কথামতো ব্যান্ডের নাম রাখা হয় লিংকন পার্ক। কিন্তু ইন্টারনেটে সেই নামের একটা ডোমেইন আগে থেকেই থাকার দরুন শেষমেশ নাম রাখা হয় লিংকিন পার্ক।
নতুন যাত্রার পরের বছরেই লিংকিন পার্ক প্রকাশ করে তাদের প্রথম স্টুডিও এলবাম হাইব্রিড থিওরি যা এখন পর্যন্ত তাদের সবচাইতে সফল এলবাম। সেই এলবাম প্রকাশের পর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি লিংকিন পার্ককে। তারপর একে একে মেটিওরা (২০০৩), মিনিটস টু মিডনাইট (২০০৭), আ থাউজ্যান্ড সান্স (২০১০), লিভিং থিংগস (২০১২), দ্যা হান্টিং পার্টি (২০১৪), ওয়ান মোর লাইট (২০১৭)-এর মতো দুর্দান্ত সব এলবাম উপহার দেন ভক্তদের।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চেস্টার বিষণ্ণতায় ডুবে থাকা মানুষদের নিয়ে ভেবেছেন। সবসময় হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সেইসব মানুষদের দিকে যারা জীবনের খেই হারিয়ে ফেলেছিলো। এমনকি নিজের শেষ কন্সার্টেও বলছিলেন সবাইকে মিলেমিশে থাকতে, একসঙ্গে বাঁচতে। চেস্টার বলেছিলেন ভালোবাসাই একমাত্র জিনিস যার সর্বদা জয় হয়। চেস্টারের কথা রেখেছে ভক্তরাও। চেস্টারের চলে যাওয়ার পর ‘আই এম দ্য চেঞ্জ’ হ্যাশট্যাগে সবাই জানান দিয়েছিলেন তারা বিষণ্ণতার জীবন থেকে ফিরে এসেছেন।
লক্ষকোটি মানুষকে জীবনের পথে ফিরিয়ে আনা মানুষটা যখন নিজেই ডিপ্রেশনের কাছে নিজেকে সঁপে দেয়, তখন পৃথিবীকে বড় আশ্চর্যজনক বস্তু ছাড়া অন্যকিছু মনে হয়না। গানের লাইনে ‘পরিশেষে, কোনোকিছুই ব্যাপার না’ বলে গেলেও, চেস্টারের এভাবে হার মেনে নেয়াটা অন্ততপক্ষে তার ভক্তদের কাছে অনেক বড় ব্যাপার ছিলো। সেজন্যেই হয়তো তিনি বলে গিয়েছেন,
“এন্ড ডোন্ট রিসেন্ট মি, হোয়েন ইউ’র ফিলিং এম্পটি
কিপ মি ইন ইওর মেমরি, এন্ড লিভ আউট অল দ্য রেস্ট,
লিভ আউট অল দ্য রেস্ট।”