হেভি মেটাল মানে কি চিৎকার চেঁচামেচি?

হেভি মেটাল মানে কি চিৎকার চেঁচামেচি?

  • মেহেরাবুল হক রাফি

হেভি মেটাল! যারা একটু-আধটু হলেও গান শোনেন তাদের কাছে অতি পরিচিত এক জনরার নাম। নাক উঁচু শ্রোতাদের জন্য হেভি মেটাল অবশ্য নেহায়েত চিৎকার-চেঁচামেচি ছাড়া আর কিছু নয়। তবে একজন গুণমুগ্ধ গানের ভক্ত মাত্রই জানেন যে গত কয়েক দশক ধরে রক এন্ড রোলের গুরুত্বপূর্ণ শাখা হয়ে দাঁড়িয়েছে মেটাল ব্যান্ডগুলো।

সালটা ১৯৬৬। কারখানায় ঝালাইয়ের কাজ করতে নিজের ডান হাতের মধ্যাঙ্গুলি ও রিং ফিংগারের উপরের অংশ হারাতে হয় বার্মিংহামের ১৮ বছর বয়সী যুবক টনি আইয়োমির। ছোটবেলা থেকেই গিটারের প্রতি আলাদা টান অনুভব করতো টনি। হাতের সেই দুর্ঘটনা তাই কোনোভাবে দমাতে পারেনি বাহাতি সেই যুবককে। বরঞ্চ এই দুর্ঘটনাই হয়ে দাঁড়ায় তার এবং সংগীত জগতের আশীর্বাদ হিসেবে।

ওজি ওসবোর্নকে সাথে নিয়ে ‘৬৮ এর এক বসন্ত বিকেলে আইয়োমি গঠন করেন ব্ল্যাক স্যাবাথ নামের রক ঘরানার ব্যান্ড। প্রথম এলবামেই ভিন্ন ধরনের মিউজিক শ্রোতা ও সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। আয়রন-ম্যান, প্যারানয়েড, ওয়ার পিগসে আইয়োমির গিটার-প্লেয়িংই পরবর্তী দশকের হেভি মেটাল সিনারিওর চালচিত্র পালটে দেয়। যার পথ ধরে উঠে আসে জেথ্রো টাল, জুডাস প্রিস্ট ও আয়রন মেইডেনের মতন লিজেন্ডারি গানের দল। আজকে আমাদের গানের গল্প সেই আয়রন মেইডেনকে নিয়েই।

বার্মিংহামে যখন চলছে ব্ল্যাক স্যাবাথের জয়জয়কার, ঠিক সেই সময়েই লন্ডনেরই আরেক বালক স্যাবাথের ট্র্যাকে স্বপ্ন বুনছে বড় হয়ে রকস্টার হওয়ার। স্টিভ হ্যারিস নামের বালকটির স্বপ্ন তার কয়েক বছর পরই রূপ নেয় বাস্তবে। ১৯৭৫ এর ক্রিস্টমাসের ছুটিতে বন্ধু ডেভ মারেকে নিয়ে গড়ে তোলেন আয়রন মেইডেন। প্রথমদিকে শুধু এলাকার পাবগুলোতেই পার্ফম করে যেতে থাকে তারা। স্যাবাথ এবং স্করপিয়ন্সের গানগুলো কাভার করেই পাবের সন্ধ্যাগুলো কাটতে থাকে হ্যারিস এন্ড কোংয়ের। এর ঠিক দুই বছর পর ব্যান্ডের ভোকাল হিসেবে যোগ দেন পল ডি’আনো। সাথে ড্রামার হিসেবে ক্লাইভ বার এবং সেকেন্ড গিটারিস্ট ডেনিস স্ট্র্যাটনের যোগদান মেইডেনকে পূর্ণতা দান করে।

এরপর একে একে আয়রন মেইডেন এবং কিলারস এলবামের মাধ্যমে পুরো দুনিয়া পরিচিত হয় ব্রিটিশ হেভিমেটালের নতুন স্রোতের সাথে। কিছুটা পাংক মেটালিশ ফ্লেভারের এলবাম দুটি খুব দ্রুতই ইংল্যান্ড ও আমেরিকার বিলবোর্ডে দখল করে নেয় শীর্ষস্থান। মোটরহেডের পাশাপাশি আয়রন মেইডেনের এই সফলতায় অনুপ্রাণিত হয়েই আশির দশকের প্রথমভাগে জেমস হেটফিল্ডের হাত ধরে পথচলা শুরু হয় আরেক বিখ্যাত থ্র্যাশ-মেটাল ব্যান্ড মেটালিকার। এদিকে প্রথম দুই অ্যালবামের সফলতা মেইডেনকে করে তোলে আরো বেশি উচ্চাকাঙ্খী। ফলে ইংলিশ আইল্যান্ডের বাইরেও বাড়তে থাকে তাদের ট্যুরের চাহিদা। কিন্তু ডি’আনোর মাদকের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ায় ব্যান্ডের টাইট শিডিউলে। আর পারিবারিক কারণে সরে যেতে হয় বার এবং স্ট্র্যাটনকে। ফলে নাম্বার অফ দ্যা বিস্ট এলবামে দেখা মেলে ব্যান্ডের নতুন ভোকাল ব্রুস ডিকিনসন এবং ড্রামার নিকো ম্যাকব্রেইন ও গিটারিস্ট আদ্রিয়ান স্মিথের।

তারপরের গল্পটা শুধুই সফলতার। পাওয়ারস্লেভ, পিস অফ মাইন্ড, ফিয়ার অফ দ্যা ডার্কের মতন এপিক এলবাম দিয়ে হেভি মেটালের ইতিহাসে নিজেদের নাম পাকাপোক্ত ভাবে খোদাই করে ফেলে আয়রন মেইডেন। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রুস এবং আদ্রিয়ান নিজেদের সোলো ক্যারিয়ারে মনোযোগ দেয়ার জন্য ব্যান্ড ছাড়লে সাময়িক সময়ের জন্য জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। তবে তার কয়েক বছর পরই নতুন শতাব্দীতে আবারো ব্রুস এবং আদ্রিয়ানকে সাথে নিয়ে ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ এলবামের মাধ্যমে হেভি মেটাল দুনিয়ার ড্রাইভিং সিটে ফেরত আসে মেইডেন।

এখন পর্যন্ত ১৮টি স্টুডিও অ্যালবাম এবং অগণিত ওয়ার্ল্ড ট্যুর। আয়রন মেইডেনের লিগ্যাসিকে শুধু একটি দৃষ্টিকোণ থেকে আটকে রাখা অসম্ভব। কালজয়ী ক্লাসিক মেটাল ট্র্যাক সৃষ্টির পাশাপাশি নতুন জেনারেশনের মেটাল ব্যান্ডগুলোকে অনুপ্রাণিত করার দিক থেকে মেইডেনের ভূমিকা বরাবরই অগ্রগণ্য। পপ মিউজিকের এই যুগে ব্ল্যাক স্যাবাথের হাতে তৈরি হেভি মেটালকে আজো মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে তাই আয়রন মেইডেনের অবদান সর্বদাই অনস্বীকার্য।

Sharing is caring!

Leave a Comment