কলাগাছের আঁশ থেকে হবে আসবাবপত্র

কলাগাছের আঁশ থেকে হবে আসবাবপত্র

  • ক্যাম্পাস ডেস্কঃ 

কলা খেতে খেতে গল্প করছিলেন দুই বন্ধু। হঠাৎ তাদের মধ্যে তর্ক বেধে যায়। একজন দাবি করেন, ফেলে দেওয়া কলাগাছ থেকেও তৈরি হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র। অন্যজন তার বিরোধিতা করেন। তাদের কথা শুনে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক পাট গবেষক জানান, কলাগাছ ব্যবহার করে সত্যিই অনেক কিছু তৈরি করা সম্ভব। কীভাবে সেটা করা যেতে পারে সে ব্যাপারে কিছু পরামর্শও দিলেন তিনি। সেই থেকে শুরু হলো গবেষণা। একপর্যায়ে সাফল্যও পেলেন তারা। কলাগাছের বাকল থেকে তৈরি হলো আঁশ। পরীক্ষায় দেখা গেল, এই আঁশ পাটের মতোই শক্তিশালী। আঁশের ‘কম্পোজিট’ বানানোর পর তারা আরও আশাবাদী হলেন। এগুলো দিয়ে তৈরি করা যাবে হার্ডবোর্ড, যা দিয়ে সব ধরনের আসবাব বানানো সম্ভব। পাশাপাশি কাঁচা ঘরের বেড়া-চাল সবই এই আঁশ দিয়ে তৈরি হতে পারে। এ ছাড়াও তৈরি হবে সুতা, কাপড় ও কাগজ।

বন্ধুকে বলা কথা প্রমাণ করতে ২০১৪ সালের শেষের দিকে এই গবেষণা শুরু করেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বস্ত্র প্রকৌশল বিভাগের তৎকালীন ছাত্র সাগর দাস শিশির। তার বন্ধু রাকিবুল ইসলামও এই গবেষণায় অংশ নেন। পরে এই দলে যুক্ত হন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আশিস সরকার ও আবু সাঈদ অমি। তাদের সব ধরনের সহায়তা দিয়ে গবেষণা এগিয়ে নেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম। আজহারুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘বিশ্বের কয়েকটি দেশে কিছুদিন ধরে কলাগাছের আঁশ নিয়ে গবেষণা চলছে, যা অনেকদূর এগিয়েছেও। তবে বাংলাদেশে এ বিষয়ে গবেষণার কথা তার জানা নেই। তাই কয়েকজন ছাত্র এ নিয়ে কাজ করতে চাইলে তিনি উৎসাহ ও সহায়তা দেন। মাত্র দেড় বছরে সেই গবেষণা এখন পরিণত পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।’

গবেষক দলের প্রধান সাগর দাস শিশির সমকালকে বলেন, ‘পরিসংখ্যানমতে বাংলাদেশে ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে কলা চাষ হয়। সনাতন পদ্ধতিতে কলা সংগ্রহের পর সাধারণত গাছটি কেটে ফেলা হয়। পরিত্যক্ত সেই গাছ থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু তৈরির চিন্তা ছিল তার মাথায়। গবেষণার শুরুতে কলাগাছের বাকল সংগ্রহ করে ৭ থেকে ১০ দিন পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়। বাকল পচে গেলে তা থেকে সংগ্রহ করা হয় আঁশ। পরে তা শুকানো হয়। এই আঁশগুলোকে প্রক্রিয়াজাতের পর আলাদা আলাদা কম্পোজিট করে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করা সম্ভব।’ শিশির আরও জানান, নমুনা হিসেবে তারা কয়েকটি কম্পোজিট তৈরি করেছেন। এর শক্তিমত্তাও পরীক্ষা করে দেখেছেন। কলার আঁশের একটি কম্পোজিট পাটকাঠি বা কাঠের তৈরি হার্ডবোর্ডের থেকে কোনো অংশেই কম মজবুত নয়। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এটির সহনক্ষমতা ৩৫ দশমিক ৩২ সেন্টিনিউটন পার টেক্সট। তবে কলাগাছের জাত অনুযায়ী এই মান কমবেশি হতে পারে। পাটের জাতভেদে সহনক্ষমতা ২৫ থেকে ৪০ সেন্টিনিউটন পর্যন্ত হয়। পাটের বিকল্প হিসেবে সমান শক্তির আঁশ হিসেবে, কিংবা পাটের সঙ্গে মিশিয়ে কলার আঁশ ব্যবহার করা যেতে পারে।

শিশির জানান, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রকৌশলী মোসলেম উদ্দিন তাদের সঙ্গে এ গবেষণায় শুরু থেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। তার ও রাকিবুলের তর্ক শুনে তিনিই সেদিন পরামর্শ দিয়েছিলেন এ নিয়ে গবেষণা করার। গবেষক দলের আরেক সদস্য আশিস সরকার সমকালকে বলেন, ‘রাস্তা বা ভবন নির্মাণের শুরুতে সাধারণত মাটির ওপর পলিথিন রেখে ঢালাই দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে পলিথিনের বদলে জিও টেক্সটাইল হিসেবে কলার আঁশের কম্পোজিট ব্যবহার করা হলে তা নির্মাণকে আরও বেশি স্থায়িত্ব দিতে সহায়ক হবে।’ দলের আরেক সদস্য আবু সাঈদ অমি বলেন, ‘কলার আঁশ থেকে মণ্ড তৈরি করে তা দিয়ে উন্নত মানের কাগজ বানানো সম্ভব। কোস্টারিকায় গবেষকরা এরইমধ্যে এ কাজে সফলতা পেয়েছেন। আঁশকে প্রক্রিয়াজাত করে সুতা ও কাপড় তৈরি করাও সম্ভব। জাপানে গরমের পোশাক তৈরিতে কলার আঁশ ব্যবহার করা হচ্ছে। ফিলিপাইনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে ব্যবহৃত রশি তৈরিতে কলার আঁশ ব্যবহার করা হয়। এটি থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি হয় নাইজেরিয়ায়।’ গবেষকরা আরও জানান, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে কাঁচা ঘরবাড়ি তৈরিতে বাঁশ-কাঠ ব্যবহার করা হয়। এর বদলে কলার আঁশ ব্যবহার করা হলে তা আরও সাশ্রয়ী ও টেকসই হবে। এ জন্য সহজে কলাগাছ থেকে ঘরের বেড়া বা চাল তৈরির পদ্ধতি গ্রামের মানুষকে শিখিয়ে দিতে চান তারা।

গবেষক দলের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক আজহারুল ইসলাম বলেন, কয়েকজন মেধাবী তরুণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই গবেষণা পরিচালনা করছেন। এর প্রত্যেক ধাপেই অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। এখন পর্যন্ত তারা নিজেরাই সেই খরচ জোগাচ্ছেন। তবে এই গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিতে সরকারি-বেসরকারি সহায়তা প্রয়োজন।

সুত্রঃ সমকাল , প্রকাশ : ১৮ জুন ২০১৬favicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment