জিল্লুর-তনির আলো ছড়ানো বন্ধুত্ব
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
জিল্লুর রহমান ক্যাম্পাসে পা ফেলেই হাত বাড়িয়েছিলেন সাহায্যের। তাঁকে যেন কেউ একটু ক্লাস পর্যন্ত পৌঁছে দেন। আশপাশে অনেকে ছিলেন। কিন্তু এগিয়ে এসেছিলেন তনি আসফিম। চোখের আলো হারানো জিল্লুরের সেদিনের পর ক্যাম্পাসে আর কারও সাহায্য চাইতে হয়নি। বন্ধু হয়ে পাশেই আছেন তনি। দুজনের বন্ধুত্বের বাকি কথা লিখেছেন তাঁদের শিক্ষক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রংপুরের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ।
তাঁরা দুজন বন্ধু
তনি আসফিমের কাছেই জানতে চেয়েছিলাম কীভাবে পরিচয় হয়েছিল জিল্লুরের সঙ্গে। আসফিম বলছিলেন, ‘একদিন দেখি জিল্লুর দুই হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, “আমাকে কেউ ধরেন, আমাকে কেউ ধরেন। আমি চোখে দেখি না।” জিল্লুরের এই কথাগুলো আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। জিল্লুর চোখে দেখে না। আমি তো দেখি। সে আমাদের বন্ধু। আমরা একই ক্লাসে পড়ি। ও কেন অন্যের কাছে সাহায্য চাইবে? তারপর থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিই, আমি যতটা সম্ভব ওর পাশে থাকব।’
জিল্লুর রহমান ও তনি আসফিম রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। তাঁরা দুজনই কিছুদিন আগে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শেষ করেছেন। তনি আসফিম জিল্লুর রহমানের বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের প্রায় চার বছর খুব কাছ থেকে দেখেছেন। জিল্লুর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষ। তাই তাঁকে বাসে তুলে দেওয়া, বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে আসা, ক্লাসের পড়ায় সহযোগিতা করা, এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসের সময়টুকু সঙ্গ দেওয়ার কাজ করেছেন তনি। সহপাঠীরা যখন দলবেঁধে আড্ডা দিয়েছে, হই-হুল্লোড় করেছে, তখন তনি আসফিম জিল্লুর রহমানের সঙ্গে বসে একাই সময় কাটিয়েছেন। জিল্লুরের সুবিধা-অসুবিধাটাই দেখেছেন সবার আগে। এক আকাশ উদারতা, গভীর সংবেদনশীলতা না থাকলে এমন বন্ধুত্ব অকল্পনীয়। তনি আসফিম আমাদের সমাজে একটা দৃষ্টান্ত। তিনি আমাদের শেখান বন্ধুত্বের অন্তর্গত সমীকরণ।
শুনতে হয়েছে কটূক্তি
শুরুতে অনেকেই তাঁদের এই বন্ধুত্ব নিয়ে নানান কটু কথা বলেছে। তনি সেসবে দমে যাননি। নিয়মিত জিল্লুর রহমানের হাত ধরে নিয়ে আসা-যাওয়ার শুরুতে তনি আসফিমের অনেক বন্ধু তাচ্ছিল্য করেছে, জিল্লুর রহমানের সঙ্গে তাঁর প্রেম ধরে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছে। বন্ধুরা কেউ কেউ সন্দেহের কথা জানিয়ে খুদে বার্তাও পাঠিয়েছে। তনি সেসবের তোয়াক্কা করেননি। তনি আমাকে বলেছেন, ‘আমাদের বন্ধুরা যখন আমার বন্ধুত্ব নিয়ে বাজে কথা বলত, আমার মন খারাপ হতো।’ শুধুই বন্ধুত্ব আর পরোপকারের ইচ্ছা থেকেই তিনি জিল্লুরের বন্ধু হয়েছেন। ক্যাম্পাসে তনিকে একলা খুব একটা চোখে পড়ত না।
অদম্য জিল্লুর
জিল্লুর জন্মান্ধ নন। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে দুটো চোখ হারান। তারপরও তাঁর স্বপ্নকে মরে যেতে দেননি। ব্রেইল পদ্ধতি শিখে নিজে লেখাপড়া চালিয়ে নিয়ে গেছেন। জিল্লুর অনেক দূর থেকে কষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসতেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০ কিলোমিটার বাসে যেতে হয় ধাপ মেডিকেল মোড়। বাস না থাকলে ১০ কিলোমিটার অটোরিকশায় যেতে হয়। এরপর আবার বাসে উঠে প্রায় ১০ কিলোমিটার যেতে হয় পাগলাপীর নামক স্থানে। সেখান থেকে রিকশা দিয়ে উত্তর খলেয়ায় তাঁর বাড়িতে। জিল্লুর বাড়িতে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা-ইংরেজি পড়ান।
জীবনের সমস্ত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তনি আসফিম অদম্য জিল্লুর রহমানের স্বপ্নকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টাকে সহজ করে দিয়েছেন। তাঁদের সহপাঠী মুনতারিন জাহান বলেন, ‘আমরা যা পারিনি, সমাজ যা পারে না, তনি তা করে দেখিয়েছে।’
বন্ধুর জন্য আরও অনেকটা পথ
বন্ধুত্বের পথে আরও অনেকটা হেঁটেছেন তনি আসফিম। জিল্লুরের কাছে তিনি শিখে নিয়েছেন ব্রেইল পদ্ধতির পাঠ। বিনা পারিশ্রমিকে তিনি প্রতিবন্ধী স্কুলেও পড়ানোর কাজ করেছেন। জিল্লুরের প্রতি বন্ধুত্ব যেন সব প্রতিবন্ধীর জন্যই তৈরি হয়েছে।
জিল্লুরের কথায় বন্ধুত্বের প্রতি যে ভালোবাসা, সেটাই উঠে আসে। জিল্লুর তনি সম্পর্কে বলেন, ‘একজন ভালো মানুষ কীভাবে একজন ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে, তার উদাহরণ হচ্ছে তনি। একজন বন্ধু হিসেবে যে অন্যের দুঃখ-কষ্ট সমানভাবে উপলব্ধি করতে হয়, সে মানসিকতা তনির মধ্যে ছিল। সে অনেক সময় অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও আমার প্রয়োজনে এগিয়ে এসেছে। গোটা পৃথিবীর মানুষকে বলতে চাই, যদি ভালো বন্ধু হতে চান, তনি আসফিমকে অনুসরণ করুন।’
বন্ধুত্ব কোনো আরোপিত বিষয় নয়। বিপদেই নাকি বন্ধুত্বের পরিচয়। অনেক সময় আমরা দেখি, কেউ বিপদে পড়লে বন্ধুরা দূরে চলে যায়। আমরা তখন বলি দুধের মাছি। সমাজে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা সব সময় বিপদে পাশে থাকেন। একজন ভালো বন্ধু পাওয়া অনেক কঠিন। তনি আসফিম শেখাচ্ছেন কীভাবে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়।