যত্তসব ভুল ধারনা !
- অজন্তা রেজওয়ানা মীর্জা
মুক্ত পেশাজীবীরা অন্যদের কাছ থেকে যেসব কথা সবচেয়ে বেশি শোনে সেগুলো হলো:
‘বাসায় বসে কাজ কর…এটা কি কিছু হলো?’
‘রাত জেগে জেগে কাজ করতে হয়!’
‘এই কাজের কোনো গ্যারান্টি আছে নাকি? আজকে আছে, কালকে নাই!’
‘আরে এইটা কোনো কাজ হলো?এই কাজ তো সবাই পারে।’
উপরের সবগুলোই যে মোটামুটি ভ্রান্ত ধারণা, সেটা নিয়েই আজকের লেখা।
ভুল ধারণা-১
‘বাসায় বসে কাজ কর’- এটা আসলে একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। আমরা যারা মুক্ত পেশাজীবী তারা বাসায় বসে কাজ করি, না ছাদে বসে কাজ করি, নাকি কোনো কফি শপে বসে কাজ করি, তার সাথে আমাদের কাজের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি বাংলাদেশে বসে আছি, আর আমার ক্লায়েন্টরা যুক্তরাষ্ট বা ইউরোপের কোনো দেশে বসে আছে। আমরা একা তার কাজ করছি তাই আমার প্রয়োজন পড়ছে না এই কাজের জন্য একটি অফিস খুলে বসতে। আমি তাই আমার বাসায় বসে, আমার ওয়ার্কস্টেশনে বসে কাজ করতে পারছি। হ্যাঁ, যদি আমার সাথে আরও দশ জন বসে কাজ করতো, তাহলে আমার হয়তো একটা ছোট অফিস খুলতে হতো। তার প্রয়োজন নেই বলেই আমি আমার ঘরে থেকেই কাজ করতে পারছি, সেটা আমার জন্য একটা বাড়তি সুবিধা।
এমন অনেক বড় বড় মুক্ত পেশাজীবী আছেন যারা নিজেদের অফিস নিয়ে, নিজেদের বড় একটা দল নিয়ে কাজ করছেন; আবার আমার মতো কিছু নতুন ফ্রিল্যান্সার নিজেদের বাসায় একটা ছোট অফিসের মতো তৈরি করে কাজ করছি। যারা আরও নতুন, তারা হয়তো এখনও নিজেদের বেডরুমে বিছানায় বসে কাজ করে যাচ্ছে। তাই বলছি, কে কোথায় বসে কাজ করে তা একান্ত তাদের নিজের এবং আপেক্ষিক একটি ব্যাপার।
ভুল ধারণা-২
‘রাত জেগে কাজ করা’ ব্যাপারটাও আপেক্ষিক।প্রথমে মনে রাখতে হবে, আমাদের ক্লায়েন্টের প্রায় সবাই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা বা কোনো ইউরোপিয়ান দেশের বাসিন্দা। যখন আমাদের রাত, তাদের দিন। যদি আমরা তাদের কাজগুলো পেতে চাই, আমাদের প্রয়োজনেই আমাদেরকে রাত জাগতে হবে তাদের সাথে কথা বলার জন্য; তারা কষ্ট করে আমাদের জন্য রাত জাগবেন না। তাছাড়া, রাতের বেলা বেশি বেশি করে কাজ পোস্ট হয়। নতুন ফ্রিল্যান্স কর্মীরা তাই রাত জেগে কাজে আবেদন করতে থাকে। একটু নামডাক হলে, বা ভালো একটা বাঁধা ক্লায়েন্ট পেলে আর কেউ পরে রাত জাগে না।
আরেকটা বড় কারণ আছে এই রাত জেগে কাজ করার পেছনে। অনেক শিক্ষার্থীরা আজকাল তাদের অবসর সময়ে এমন টুকটাক ফ্রিল্যান্স কাজ করছেন। তারা দিনের বেলায় ক্লাস আর পড়াশোনা করছেন, আর রাতে কাজ করে হাতখরচের টাকাটা জোগাড় করছেন। আমি এমন কিছু চাকরিজীবীর কথাও জানি যারা রাতে কয়েক ঘণ্টা ফ্রিল্যান্স কাজ করে কিছু অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য। তাদের জন্য রাত জেগে কাজ করাটাই স্বাভাবিক।
ভুল ধারণা-৩
‘এই কাজের কোনো গ্যারান্টি আছে নাকি?’ এই কথাটা একসময় বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও মানুষ বলত, যা এখন আর কেউ বলে না। আগে মানুষ সরকারি চাকরি পছন্দ করত। ফ্রিল্যান্স কাজের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই।
আমরা যারা একটা মার্কেটপ্লেসে প্রোফাইল করে কাজ করি, তাদের জন্য আসলে একটু গ্যারান্টি কমই থাকে। কোনো কারণে যদি আমাদের প্রোফাইলে কিছু হয়, আমরা অনেকটা পিছিয়ে যাবো। হয়তো আরেকটা প্রোফাইল বানাতে হবে, আবার নতুন করে কাজ শুরু করতে হবে। কিন্তু যারা সরাসরি কোনো ক্লায়েন্টের সাথে কাজ করছে, তাদের জন্য ঝুঁকি কম। এমনও ফ্রিল্যান্স কর্মী আছে যারা বছরের পর বছর একজন ক্লায়েন্টের সাথেই কাজ করে যাচ্ছে; তাদের জন্য এটা একটা সাধারণ চাকরির মতোই। পার্থক্য একটাই, ক্লায়েন্ট আর কর্মী দু’জন দু’দেশে বসে আছে।
আরেকটা কথা মনে রাখবেন, কেউ যদি আসলেই কাজ পারে, তাকে আটকানো কঠিন। যেকোন চাকরিতে, যেকোনো প্রতিষ্ঠানে, যে কোন ভাবেই হোক, সে কাজ করতে পারবে-সেটা একটা সাধারণ চাকরিই হোক, আর ফ্রিল্যান্স হোক।
ভুল ধারণা–৪
এই কাজ তো সবাই পারে। ব্যাপারটা এত সহজ নয়। যারা ফ্রিল্যান্স কাজ করছে তারা সবাই কষ্ট করে কাজ শিখে, অনেক চেষ্টা করে আস্তে আস্তে একটা ভালো পর্যায়ে আসতে পেরেছে। এমন নয় যে কাজগুলো অনেক সহজ কিছু, একবার শুরু করলেই অনেক সফল হওয়া যায়। উল্টো আমি বলবো যে একজন ফ্রিল্যান্স কর্মী’র কাজ অনেক বেশি কঠিন; এখানে সফল হওয়া অনেক বেশি কষ্টের।
বাংলাদেশে মোটামুটি সবার জীবনের একটাই লক্ষ্য থাকে-একটা ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো সিজিপিএ নিয়ে বের হওয়া। তারপর একটা ভালো চাকরী খোঁজা। এর কারণে দেখা যায়, ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক আর কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক দু’জন একই অফিসে বসে কাজ করছেন!
আমরা যারা ফ্রিল্যান্স কাজ করি তাদের কাজটা পুরোপুরি তাদের নিজেদের দক্ষতার উপর নির্ভর করে। আমি যে কাজটা পারি বা যে কাজটা আমি শিখে এসেছি, শুধু সেই কাজটাই আমি করতে পারবো। কাজটা আমাকে খুব ভালোভাবে জানতে হবে; কাজটাতে আমাকে দক্ষ হতে হবে।