তৌহিদ এখন শীর্ষ ফ্রিল্যান্সার

তৌহিদ এখন শীর্ষ ফ্রিল্যান্সার

  • রাহিতুল ইসলাম

২০০৯ সালে প্রায় শূন্য হাতে নাটোর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন উচ্চমাধ্যমিক পেরোনো তরুণ তৌহিদুর রহমান। এখন তিনি বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ফ্রিল্যান্সার। মাসিক আয় ৭ হাজার ডলারের বেশি (প্রায় ৬ লাখ টাকা)। পড়ুন এক উদ্যমী তরুণের কথা।

ঠিক ১০ বছর আগে একরকম শূন্য হাতে নাটোর থেকে ঢাকা শহরে এসেছিলেন তৌহিদুর রহমান। তখন তিনি উচ্চমাধ্যমিক পেরোনো তরুণ। তেমন কোনো দক্ষতা ছিল না, ভালো ইংরেজি বলতে পারতেন না। কোথায় যাবেন, কী করবেন, কী পড়বেন, ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিলেন না। এখন তিনি একজন ফ্রিল্যান্সার, উদ্যোক্তা। তাঁর মাসিক আয় গড়ে ৭ হাজার ডলারের (প্রায় ৬ লাখ টাকা) বেশি। তৌহিদুর রহমানের কৃষক বাবা হাসিমুখে বলেন, ‘কী যে কঠিন সময় পেরিয়ে এসেছি, সেটা শুধু ও আর আমরাই জানি।’ কঠিন সময়টার কথা শুনব বলেই ১৯ ডিসেম্বর তৌহিদুর রহমানের মুখোমুখি বসেছিলাম।

ফিরে দেখা

‘জানেন, ছোটবেলায় একবার স্কুলড্রেস পরে ঈদ করেছিলাম। নতুন ক্লাসে উঠব, তখন আবার সামনেই ঈদ। ঠিক হয়েছিল, দুবার জামা কেনা হবে না। নতুন স্কুলড্রেস কেনা হবে, ঈদের দিন সেই জামাই পরব। ঈদের দিন স্কুলড্রেস পরে বাইরে বের হতে কী যে লজ্জা লাগছিল! একটু বাইরে বের হয়েই আবার দৌড়ে ঘরে ঢুকে গিয়েছিলাম।’ বলছিলেন তৌহিদুর রহমান। এটুকু বলেই যোগ করলেন, ‘অবশ্য আমার মা-বাবার কষ্টের কাছে আমার এই কষ্ট কিছুই না। আমাদের তিন ভাইকে পড়ালেখা করানোর জন্য তাঁরা যে কষ্ট করেছেন, সেটা অতুলনীয়।’

তৌহিদুর রহমানের বাবা লিয়াকত আলী নাটোরের বড়াইগ্রামের একজন কৃষক। মা নাছিমা বেগম। পাঁচজনের ছোট্ট সংসার। কৃষিকাজ করে যে টাকা আয় হতো, তা দিয়ে সংসার চালানোই মুশকিল। তবু আয়ের একটা বড় অংশই লিয়াকত আলী খরচ করতেন ছেলেদের পড়ালেখার পেছনে। লোকে নানা কথা বলত—‘ছেলেদের এত পড়ালেখা শিখায় কী করবা? একটা জমি কিনো। কৃষিকাজে লাগাও।’ লিয়াকত আলী সেসব কথায় কান দেননি।

নাটোরের গোপালপুর উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করতেন তৌহিদুর। তাঁর সঙ্গে যখন কথা হচ্ছে, হাত এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেখেন, হাতে কাঁচির দাগ এখনো দেখা যায়। জীবনের দুটি দিকই আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি।’

ঢাকার পথে

নাটোরের রাজাপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তৌহিদুর রহমান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর ঠিকানা হয় পাবনার এডওয়ার্ড কলেজের ইংরেজি বিভাগে। অভাবের সংসার। হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা করতে গিয়ে তৌহিদুর বুঝতে পারছিলেন, আরও অনেক কঠিন সময় অপেক্ষা করছে তাঁর সামনে।

‘এমন সময় মনে হলো, আমি নিজে কিছু করে যদি পড়ালেখার পাশাপাশি সংসারে সাহায্য করতে পারতাম, তাহলে ভালো হতো। হাতে টাকাকড়ি নেই। তবু একদিন অতশত না ভেবে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলে ফেললাম, “আমি ঢাকায় গিয়ে পড়ব” শুনে বাবা খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে স্রেফ একটা কথাই বলেছিলেন, “আচ্ছা”।’

২০০৯ সালে ঢাকায় এসে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তৌহিদুর রহমান। ধারদেনা করে ছেলেকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন লিয়াকত আলী। বলেছিলেন, ‘পড়ালেখা শুরু করার টাকাটা আমি তোমাকে দিতে পারি। বাকি ব্যবস্থা তোমাকেই করে নিতে হবে।’

তৌহিদুর যখন ঢাকার বাসে চড়েছেন, তখনো তাঁর মনে একরাশ অনিশ্চয়তা।

চাকরি ও ফ্রিল্যান্সিংয়ের শুরু

ঢাকায় এসে তৌহিদুরের প্রাথমিক কাজ ছিল দুটি। পড়ালেখা, আর রাস্তায় হেঁটে হেঁটে চাকরি খোঁজা। খুব আগ্রহ নিয়ে পত্রিকায় চাকরির বিজ্ঞাপন দেখতেন। কারণ জানতেন, নিজের পড়ালেখার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। সঙ্গে পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যয় তো ছিলই।

ছিল না শুধু আত্মবিশ্বাস। ইংরেজি বলার দুর্বলতা, আর চাকরির বাজারের তুমুল প্রতিযোগিতার কারণে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছিলেন না তিনি। নানা বাধা–বিপত্তি পেরিয়ে তৌহিদুর রহমান কাজ পান একটা কল সেন্টারে। সেই কল সেন্টারও বন্ধ হয়ে যায় মাত্র ১৪ দিনের মাথায়। তবু ১৪ দিনের কাজের অভিজ্ঞতাই তাঁকে খানিকটা সাহস দিয়েছিল। এরপর একে একে বেশ কয়েকটা কল সেন্টারে কাজ করেন তিনি। চলতে থাকে পড়াশোনাও।

তৌহিদুর বলছিলেন, ‘সারা রাত কল সেন্টারে কাজ করে ভোরবেলা ছুটতাম বাসায়। তারপর আবার ক্লাস। কখনো কখনো এমন হয়েছে—বাসা থেকে বেরিয়ে ভার্সিটি যেতে যেতে বাসে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, টেরও পাইনি। ভার্সিটির এলাকা পেরিয়ে বাস চলে গেছে আরও দূরে। তখন আবার উল্টো বাস ধরে ভার্সিটি আসতে হতো। সারা দিন ক্লাস করে বিকেলে ঘুমাতাম। রাতে আবার অফিস।’

২০১০ সালে একবার অফিসে বসে কাজ করছিলেন। এর মধ্যে এক বন্ধু এসে ওডেস্কে (বর্তমানে আপওয়ার্ক) অ্যাকাউন্ট খুলে দেন। বন্ধুই জানান, অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে আয় করা যায়। ধীরে ধীরে কাজ শিখতে থাকেন তৌহিদুর।

বাঁক বদল

আপওয়ার্কে টেলিমার্কেটিং এবং বিক্রয় পেশাদার হিসেবে কাজ করে তৌহিদুর রহমানের প্রথম আয় ছিল ১৫৭ ডলার। প্রথম কাজটার কথা ভেঙেই বললেন তিনি, ‘আমি একটা মার্কিন রিয়েল এস্টেট এজেন্সির হয়ে কাজ করেছিলাম। আমার কাজ ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বাড়ির মালিকদের ফোন করে জিজ্ঞেস করা, তাঁরা তাঁদের বাড়ি বিক্রি করতে চান কি না।’

ইংরেজিতে ভীষণ দুর্বলতা নিয়ে যিনি ঢাকায় পা রেখেছেন, নিজের চেষ্টাতেই তিনি একটু একটু করে ভাষাটা রপ্ত করে নিয়েছিলেন। প্রচুর ইংরেজি সিনেমা দেখতেন, একা একা কথা বলতেন। কল সেন্টারে কাজের অভিজ্ঞতা থেকেও অনেক কিছু শিখেছেন। তাই টেলিমার্কেটার হিসেবে কাজ করতে বেগ পেতে হয়নি তৌহিদুর রহমানকে।

সেই থেকে শুরু। এরপর একের পর এক কাজ পেয়েছেন। এখন কী কী কাজ করছেন? জানতে চাইলে বললেন, ‘নিজে তো ফ্রিল্যান্সিং করছিই। পাশাপাশি আমার একটা এজেন্সি আছে। এজেন্সির মাধ্যমে আমরা ভিনদেশের বিভিন্ন রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোকে প্রয়োজনীয় সেবা দিই। এ ছাড়া ফিডফন্ড নামে আমার একটা ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের প্রতিষ্ঠান আছে। আমরা সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সেবা দিই। আমার কোম্পানিতে ১৬ জন তরুণ কাজ করেন।’

তৌহিদুর রহমান এখন গ্রামে বাড়ি করেছেন, গাড়ি কিনেছেন। জীবনের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট ছিল কোনটা? জানতে চাইলে বললেন, ‘সেই যে ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সেই দিনটাই বোধ হয় আমার জীবন বদলে দিয়েছিল।’

সূত্র: প্রথম আলো

Sharing is caring!

Leave a Comment