সাক্ষাৎকার: সম্ভাবনাময় পেশা সিএস

সাক্ষাৎকার: সম্ভাবনাময় পেশা সিএস

  • ক্যারিয়ার ডেস্ক

মোহাম্মদ আসাদ উল্লাহ এফসিএস চার্টার্ড সেক্রেটারি তথা কোম্পানি সচিবদের একমাত্র পেশাদার প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশের (আইসিএসবি) প্রেসিডেন্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর করার পর ১৯৮৫ সালে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন আসাদ উল্লাহ। বর্তমানে তিনি বেক্সিমকো গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ও গ্রুপ কোম্পানি সচিব। তার হাত ধরে আইসিএসবি নতুন উচ্চতায় আসীন হয়েছে। ২০১০ সালের জুনে যে আইনের মাধ্যমে আইসিএসবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটির পেছনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে তার।


: ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ বাংলাদেশ (আইসিএসবি) কবে গঠিত হয়?

মোহাম্মদ আসাদ উল্লাহ: রয়েল চার্টার্ডের মাধ্যমে ১৮৯১ সালে বিশ্বের প্রথম চার্টার্ড সেক্রেটারিজ ইনস্টিটিউশনের যাত্রা শুরু হয় ইংল্যান্ডে। ১৯৯৭ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অ্যান্ড ম্যানেজার্স অব বাংলাদেশের (আইসিএসএমবি) কার্যক্রম শুরু হয়। চার্টার্ড সেক্রেটারিজদের জন্য ইংল্যান্ডের মতো একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯৮ সালে সরকারের কাছে আবেদন করা হয়। সে সময়ে নানা কারণে এর খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড.এ.বি. মীর্জা আজিজুল ইসলাম বিএসইসির চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনি এই বিষয়ে উদ্যোগী হন। ২০০৯ সালে আওয়ালী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিষয়টি নিয়ে নতুন করে কাজ শুরু হয়। ২০১০ সালে প্রণীত চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অ্যাক্ট, ২০১০ এর আওতায় আইসিএসবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

: আইসিএসবি গঠনের উদ্দেশ্য কী ছিল?

মোহাম্মদ আসাদ উল্লাহ: কোম্পানি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় যোগ্য জনবল তৈরির লক্ষ্য নিয়েই আইসিএসবি প্রতিষ্ঠা করা হয়। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, কোম্পানি সুশাসনের সঙ্গে চার্টার্ড সেক্রেটারিজদের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এরাই মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি, আরজেএসসিসহ অর্থনৈতিক খাতের বিভিন্ন রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠানের আইন-কানুন পরিপালনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। আইসিএসবিতে এসব আইন-কানুন এবং এর প্রায়োগিক দিকগুলো শেখানো হয়।

: এই প্রতিষ্ঠানে কী কী শিক্ষার সুযোগ আছে?

vcমোহাম্মদ আসাদ উল্লাহ: চার্টার্ড সেক্রেটারিজদের জন্য বর্তমানে আড়াই বছরের কোর্স চালু রয়েছে আইসিএসবিতে। এখানে ৫টি লেভেলে ২০০০ নম্বরের সিলেবাস শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। আইসিএসবি থেকে পাশ করার পরে আমাদের এখানে ৩ মাস ইন্টার্নি করতে হয়। ইন্টার্নি শেষে পেপার জমা দেওয়ার পর তা পরীক্ষা করে তাকে উত্তীর্ণ চার্টার্ড সেক্রেটারির সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। এরপর ৩ বছরের অভিজ্ঞতায় অ্যাসোসিয়েট মেম্বার ও ৫ বছরের অভিজ্ঞতায় ফেলো মেম্বারশিপ দেওয়া হয়।

বর্তমানে আমাদের ৪০০ সদস্য এবং বিভিন্ন পর্যায়ের ৩ হাজার ৭০০ শিক্ষার্থী আছে। আমাদের সদস্যদের অধিকাংশই বিভিন্ন তালিকাভুক্ত কোম্পানির সচিব হিসাবে কর্মরত আছেন। এখানে কোম্পানি সেক্রেটারিদের হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়ার ফলে তারা অতি দক্ষতার সঙ্গে নিজ দায়িত্ব পালন করতে পারছেন; অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকছেন তারা। তবে এটাও সত্য যে, এখনও অনেকেই আছেন, যারা কোম্পানির সচিব হিসেবে খুব ভালো কাজ করছেন- কিন্তু আমাদের ইনস্টিটিউশনের সদস্য হননি।

: চার্টার্ড সেক্রেটারিরা একটি প্রতিষ্ঠানে কী ধরনের কাজ করেন?

মোহাম্মদ আসাদ উল্লাহ: চার্টার্ড সেক্রেটারিরা একটি প্রতিষ্ঠানকে সুন্দরভাবে পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। যদি তারা কোম্পানির সচিব হিসেবে থাকেন; তাহলে তারা পরিচালনা পর্ষদের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। কোম্পানি পরিচালনা করার জন্য সিভিল, ক্রিমিনাল, কোম্পানি আইন, লিস্টিং রুলসসহ বিভিন্ন ধরনের আইন জানতে হয়। এর বাইরে মার্কেটিং, হিউম্যান রিসোর্স, অ্যাকাউন্টিং, ব্যাংকিং, এক্সচেঞ্জ কন্ট্রোলসহ অনেক বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন একজন পরিপূর্ণ মানুষ হল কোম্পানি সচিব। পর্ষদ কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে এর আইনগত দিকগুলো তাদেরকে অবহিত করে থাকেন কোম্পানি সচিব।

: ক্যারিয়ার হিসেবে দেশ-বিদেশে চার্টার্ড সেক্রেটারির সম্ভাবনা কতটুকু?

মোহাম্মদ আসাদ উল্লাহ: পেশা হিসেবে চার্টার্ড সেক্রেটারিজের (সিএস) সম্ভাবনা অপরিসীম। দেশে চার্টার্ড সেক্রেটারিজের ঘাটতি অনেক। প্রতিবছর যে সংখ্যক চার্টার্ড সেক্রেটারিজ পরীক্ষা পাস করছেন, চাহিদা বাড়ছে তার চেয়ে বেশি হারে।

বর্তমানে ডিএসইতে প্রায় ৩০০ কোম্পানি তালিকাভুক্ত আছে। আর আরজেসিতে নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার। যদি ১০ শতাংশ কোম্পানিও চার্টার্ড সেক্রেটারি বা কোম্পানি সচিব নিয়োগ দেয়, তাহলে ১৩ হাজার কোম্পানি সচিব লাগবে। গত ১৮ বছরে আমরা মাত্র ৪০০ কোম্পানি সচিব তৈরি করতে পেরেছি। এ হারে এগুলে বিদ্যমান চাহিদা পূরণেই শত বছর লেগে যাবে। এ সময়ে নতুন নতুন কোম্পানি গঠিত হবে। সেগুলোতেও কোম্পানি সচিব লাগবে। এ বাস্তবতায় বলা যায়, আগামী ১০/২০ বছর পর্যন্ত চার্টার্ড সেক্রেটারিদের চাকরির কোনো অভাব হবে না।

অন্য কোনো পেশার সঙ্গে তুলনা করলে সিএস-এর সম্ভাবনার জায়গাটি আরও ভালোভাবে পরিস্কার হবে। আমাদের দেশে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে ডাক্তারি ও ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেও অনেক তরুণ-তরুণী বেকার আছেন। এদের অনেকে নামমাত্র বেতনে চাকরি করছেন। চলতি বছর বারকাউন্সিলের সদস্য হওয়ার জন্য ৩৬ হাজার তরুণ-তরুণী সাক্ষাতকার দিয়েছেন। অর্থাৎ দেশের প্রতিটি পেশা সংশ্লিষ্ট জায়গায় অনেক বেকার রয়ে গেছে। কিন্তু সিএস এর ক্ষেত্রে এর বিপরীত চিত্র দেখা যায়। দেশের অনেক কোম্পানিই চাহিদা অনুযায়ী সেক্রেটারি পায় না। তাই সহজেই তরুণ-তরুণীরা এ সুযোগটি কাজে লাগাতে পারেন।

icsb-logoআইসিএসবি থেকে পড়াশোনা শেষে চাকরির পাশাপাশি প্র্যাক্টিস করার সুযোগও আছে। তাই যারা একটু স্বাধীনভাবে কাজ করতে চান, তারা এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারেন। অনেক কোম্পানি আছে, যারা আকার ও সামর্থ্যে অনেক ছোট কিন্তু উদীয়মান। এরা পূর্ণকালীন সময়ের জন্য কোনো সেক্রেটারি রাখেন না, কনসালটেন্টদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে থাকেন।

: আইসিএসবির ডিগ্রি কি দেশের বাইরে গ্রহণযোগ্য? না হলে এই ধরনের কোনো উদ্যোগ আছে কি?

মোহাম্মদ আসাদ উল্লাহ: আন্তর্জাতিকভাবে একটা সংগঠন হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন দেশের চ্যার্টার্ড সেক্রেটারি প্রতিষ্ঠানগুলো মেম্বার হতে পারবে। বাংলাদেশ সেখানে সেমি মেম্বার হিসেবে রয়েছে। আইসিএসবির সদস্যরা অন্য দেশে গিয়ে সমান অধিকার পাবেন এবং মেম্বারশিপ নিতে পারবেন। চাকরিও করতে পারবেন, আবার অনুশীলনও করতে পারবেন। বিশেষ করে এই সংস্থার সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ উন্নত দেশগুলোতে কাজ করতে পারবেন। তবে তার আগে ওই দেশের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। তাদের মতো সিলেবাস তৈরি করতে হবে। এগুলো করার চেষ্টা চলছে।

: এতে কী আমাদের কিছু হারানোর সম্ভাবনা আছে?

মোহাম্মদ আসাদ উল্লাহ: নানা কারণে আমরা অন্য দেশের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করছি না। কারণ আমাদের দেশে চার্টার্ড সেক্রটারিদের অনেক ঘাটতি। এখানে অন্য দেশের চার্টার্ড সেক্রটারিদের কাজ করার সুযোগ তৈরি হলে বাইরে থেকে লোক আসবে। তখন আমাদের দেশের তরুণ-তরুণীরা কঠিন সমস্যায় পড়বে।

: দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বরত কোম্পানি সেক্রেটারির বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ বা ডিগ্রি নেই। তাদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রশিক্ষিত করার কোনো উদ্যোগ কি আপনাদের আছে?

মোহাম্মদ আসাদ উল্লাহ: আমাদের দেশে যারা এখন নন-চার্টার্ড কোম্পানি সচিব রয়েছেন, তারা চাইলে এখানে কোর্স করতে পারেন। তবে এর জন্য তাদের একটি ফাউন্ডেশন কোর্স করতে হবে। এরপর তারা মূল কোর্সে ভর্তি হতে পারবেন।

: ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে চার্টার্ড সেক্রেটারিদের অবদান রাখার সুযোগ কতটুকু?

মোহাম্মদ আসাদ উল্লাহ: ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে চার্টার্ড সেক্রেটারিদের ভূমিকা রাখার অনেক সুযোগ আছে। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে সিকিউরিটিজ আইনসহ অন্যান্য আইন সঠিকভাবে পরিপালিত হচ্ছে কি-না কোম্পানি সচিব সেগুলো দেখভাল করেন। তিনি এই বিষয়ে পরিচালনা পর্ষদকে বিভিন্ন তথ্য জানিয়ে থাকেন। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সংরক্ষণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কাজ করেন কোম্পানি সচিবরা।

সূত্র: অর্থসূচকfavicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment