কোন চাকরি করব, কেন করব
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
ক্যারিয়ার বেশ ভারি আর গাম্ভীর্যপূর্ণ একটি শব্দ। আমাদের প্রায় স্কুলজীবন থেকেই এ বিষয়টা মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। চতুর্থ শ্রেণি পড়ুয়া একজন শিশুও জানে লেখাপড়া শেষ করে তাকে চাকরি করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিই কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়াই। এ বিষয়ে সঠিক পথ দেখানোর জন্যও আমরা কাউকে পাই না। সবাই কিছু ধারণাকে পুঁজি করেই পরামর্শ দেয়, যেমন ‘এখন কম্পিউটার সব জায়গায়, কম্পিউটার নিয়ে পড়লে ভালো চাকরি পাবে’। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় এই সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য যে অনেক বিষয় বিবেচনা করা উচিত, তা কেউ বলেও না বা আমরা জানিও না।
আমাদের অনেকের মতেই স্মার্ট ক্যারিয়ার মানেই চাকরি। এর বাইরে যে সম্মানজনক আরও অনেক ক্যারিয়ার আছে, তা আমরা জানিই না। সবার কথা শুনে যখন একটা ক্যারিয়ার পথ বেছে নিই, দেখা যায় সে কাজ করতে গিয়ে তা আর ভালো লাগছে না, ক্যারিয়ার হয়ে পড়েছে বোঝা। গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকাতে একজন মানুষ গড়ে ৩ বার তার ক্যারিয়ার পথ পাল্টায়। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা চাইলেও সম্ভব হয় না, কারণ আমরা শুধু মাত্র একটা কাজের জন্যই তৈরি হই, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের এটাই শেখায়। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, নিম্ন আয়ের দেশ গুলোতে ৮৯% মানুষই তাদের চাকরি পছন্দ করে না, এবং তারা পরিবর্তন করতে চায়।
এ সমস্যাগুলোর সমাধান একভাবেই করা যায়–শুরুতেই নিজের ক্যারিয়ার নির্বাচনে সচেতন হওয়া, সে হিসেবে নিজেকে তৈরি করা।নিচের বিষয়গুলো খেয়াল রাখলে খুব সম্ভবত একটি ভালো ক্যারিয়ার নির্বাচন করতে পারবেন।
শুরুটা মাধ্যমিক থেকেই:
ক্যারিয়ার প্ল্যানিং শুরু করা উচিত মাধ্যমিক বা তারও আগে থেকে। তখন থেকে রিসার্চ করা উচিত কোন ক্ষেত্রের চাহিদা ৪-৫ বছর পর অনেক ভালো থাকবে। তারপর ভাবতে হবে সেসব কাজে আগ্রহ আছে কিনা, কাজগুলো পছন্দ কি না। তারপর ভাবতে হবে সে কাজ করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাতেও কিছু শেখানো হচ্ছে কি না। সে কাজ করতে হলে কী কী শেখা দরকার তা শিখতে হবে।
আয়টাও জরুরি:
ক্যারিয়ার বলতেই আমরা অর্থ উপার্জনের মাধ্যমকে বুঝি। লেখাপড়া শেষ করে একটা ভালো বেতনের চাকরি পেতে হবে, এটাই অনেকের একমাত্র ভিশন। যদিও ক্যারিয়ার নির্বাচনে সবচেয়ে জরুরি বিষয় এটি নয়, তবে দায়বদ্ধতার কারণে এটা আগে ভাবতে হয়। যে ফিল্ডগুলোর চাহিদা ৪-৫ বছর পরেও বাড়বে, সেগুলোর দিকে নজর দেয়া উচিত হবে। এটা জানার জন্য ইন্টারনেট ঘেঁটে বিভিন্ন খবর, প্রতিবেদন পড়তে হবে। বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণগুলো খুঁজে পড়তে হবে।
বিকল্প ক্যারিয়ার:
শিক্ষাজীবনে আমাদেরকে খুব কমই জানানো হয় যে ক্যারিয়ার মাত্রই চাকরি নয়। উদ্যোক্তা হওয়া, ফ্রিল্যান্সার, স্বাধীন-কন্সাল্টেন্ট হওয়া এরকম আরও অনেক ক্যারিয়ার পথ আছে। উদ্যোক্তা হলে নিজের কাজের স্বাধীনতা যেমন থাকে, তেমনি অনেক মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করা যায়। বাংলাদেশের মতো দেশ, যেখানে ৪৭% শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বেকার, সেখানে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করাটা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হবে। বাংলাদেশে তরুণদের প্রতিষ্ঠা করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শ থেকে হাজার খানেক শিক্ষিত ছেলেমেয়ে কাজ করার সুযোগ পায়।
অপ্রচলিত ক্যারিয়ার:
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার এসব ছাড়াও ইদানীং কিছু ক্যারিয়ার পথ তৈরি হয়েছে, যাতে অনেকেই সফল হচ্ছে। যেমন ফটোগ্রাফি, ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, মেক-আপ আর্টিস্ট, স্টাইলিস্ট, ক্যারিয়ার গ্রুমিং, কর্পোরেট ট্রেইনার, পাবলিক স্পিকার, ফ্যাশন ডিজাইনিং, হোটেল ম্যানেজমেন্ট, ফিল্ম মেকিং, ইউটিউবিং, ব্লগিং ইত্যাদি। এসব বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার খুব একটা সুযোগ বাংলাদেশে নেই, তবে এসব বিষয়ে তাত্ত্বিক শিক্ষার চেয়েও ব্যবহারিক বা প্র্যাকটিকালি শেখার প্রয়োজন খুব বেশি হয়। এগুলো বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয় পেশা হয়ে উঠছে দিন দিন।
কী ভালো লাগে:
ক্যারিয়ার শুরু হওয়ার পর ‘কাজ ভালো লাগে না’ রোগে ভুগতে না চাইলে প্রথমেই ভাবা উচিত কী ভালো লাগে। ভাবুন কী এমন কাজ যা করতে ভাল লাগে, যা করতে গিয়ে মনে হয় না কাজ করছেন। এবং দেখুন সে কাজটা আসলে সিরিয়াস ক্যারিয়ার হিসেবে করা যায় কিনা, বা এটা প্রচলিত কিনা। ধরুন আপনি আঁকতে পছন্দ করেন। খুব ভালো আঁকেন। তাহলে আপনার জন্য ফ্যাশন ডিজাইনিং বা অন্যান্য ডিজাইনিং এর ক্যারিয়ার ভালো হবে। আবার ধরুন আপনি লেখালেখি ভালবাসেন, তাহলে অবশ্যই আপনার জন্য লেখালেখি করতে হয় এমন কাজ যেমন সংবাদপত্রে চাকরি ভালো হবে। ভুলেও অপছন্দের কোনো কাজকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিবেন না, তাহলে ক্যারিয়ার বোঝা বনে যাবে।
চাকরির আগেই অভিজ্ঞতা:
চাকরির আগেই অভিজ্ঞতা অর্জন খুব জরুরি। এতে এক সাথে দুটো কাজ হয়, একে তো চাকরির জন্য রেজ্যুমে ভারি করার এক্সপেরিয়েন্স পেয়ে যাবেন, সাথে আপনার নির্বাচিত ক্যারিয়ার পথটি আসলেই আপনার জন্য কিনা তা বুঝতে পারবেন। ধরুন আপনি ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিজেকে গড়তে চান। তাহলে পড়াশোনা কালীন সময়ে কোনো ইলেক্ট্রনিক কোম্পানিতে ইন্টার্নশিপ করার চেষ্টা করুন। অথবা ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন কম্পিটিশন যেখানে ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে কাজ করতে হয় সেখানে অংশগ্রহণ করুন। আবার ধরুন আপনি ম্যানেজমেন্টে ক্যারিয়ার গড়বেন। তাহলে ইউনিভার্সিটি ক্লাব বা কোনো সংগঠনে ম্যানেজমেন্টের কাজ করতে হয় এমন পদে যুক্ত হন। কাজ করার মাধ্যমে বুঝে ফেলতে পারবেন আপনি এ কাজে আনন্দ পাচ্ছেন কিনা, নাকি পরিবর্তনের সময় এখনই!
দক্ষতাই চাবিকাঠি:
এখনকার সময়ে ক্যারিয়ারের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আর সার্টিফিকেট অনেকটা এন্ট্রি-টিকেট হিসেবে ব্যবহার হয়। বাকি পুরোটাই নির্ভর করে দক্ষতার উপর। দেশের একজন নামকরা সফটওয়্যার প্রোগ্রামার সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়েছিলেন, দেশের অনেক বড় বড় ব্যাংকের উচ্চপদস্থ ব্যাংকার ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াশোনা করা। তেমনি খোঁজ নিলে দেখা যাবে শুধু ডাক্তাররা ছাড়া অন্য সব একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ফিল্ডে ক্যারিয়ার গড়েছে। মনে করুন আপনার ফটোগ্রাফি নিয়ে বেশ আগ্রহ আছে। এটাকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চান। তাহলে দেরি করে একটা ক্যামেরা জোগাড় করুন, ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করুন কীভাবে অনেক সুন্দর ছবি তোলা যায়। ইউটিউবে হাজারো এক্সপার্টদের পরামর্শ মূলক টিউটোরিয়াল আছে, হাজার হাজার বই আছে যা পিডিএফ আকারে ডাউনলোড করা যায়। আর প্র্যাকটিস করুন। একাগ্রতা থাকলে আপনি সফল হবেনই। তেমনি যদি আপনি বিজনেস ব্যাকগ্রাউন্ডের হয়েও গেইম ডেভেলপমেন্টে ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাহলে ধৈর্য্য ধরে নেমে পড়ুন শেখার পেছনে। ইন্টারনেট ঘেঁটে বের করুন গেইম ডেভেলপমেন্ট শিখতে কি কি জানতে হয়, সেই চেকলিস্ট ধরে ইন্টারনেট থেকেই শুরু করুন শেখা।
মেন্টর বানান কাউকে:
মেন্টর এমন একজনকে বানান যিনি আপনার পছন্দের ফিল্ডগুলোতে সফল একজন মানুষ। এবং অবশ্যই অন্যান্য ফিল্ডগুলো সম্পর্কেও ধারণা রাখে। যদি এমন কাউকে মেন্টর বানান যে শুধু একটা ফিল্ডই চেনে, তাহলে তিনি শুধু ওই ফিল্ডের গুণগান করে যাবেন। মেন্টরের সাথে কথা বলেই আপনার ক্যারিয়ার প্ল্যান তৈরি করুন।
একটা দেশে ৪৭% স্নাতক বেকার, ৮৯% নিজের চাকরিতে অসন্তুষ্ট, এটা বেশ ভয়ংকর তথ্য। নিজেকে এর থেকে বাইরে রাখার জন্য প্ল্যানিং করা শুরু করুন, আর প্ল্যান অনুযায়ী নিজেকে তৈরি করুন।