দেশে বসে বিদেশি কোর্স

দেশে বসে বিদেশি কোর্স

  • ক্যারিয়ার ডেস্ক

তখন ঢাকা কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম বর্ষে পড়ছেন অর্ণব। ইন্টারনেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে একদিন খোঁজ পেলেন কোর্সেরার (coursera.org) । এ ওয়েবসাইটে বিনা মূল্যে বিভিন্ন বিষয়ে কোর্স করা যায়। তখন চলছিল স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. কিথ ডেভলিনের ‘ইনট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল থিংকিং’ কোর্স। নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র, আর স্ট্যানফোর্ড অর্ণবের কাছে স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কোর্স পেয়ে দ্রুতই এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে ফেললেন। এরপর কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সঙ্গে চলতে লাগল অনলাইন কোর্সও। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তার কাছে স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনে আসছিলেন ছোটবেলা থেকেই। ক্যাম্পাসে পড়ার মতো অনলাইনেও হোমওয়ার্ক, অ্যাসাইমেন্ট, সাপ্তাহিক পরীক্ষা, ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে সনদ মিলল। সেই শুরু। এরপরের তিন বছরে অর্ণব শেষ করেছেন ৩৫টি অনলাইন কোর্স। এর মধ্যে আছে ইন্ট্রোডাকশন টু ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিকস, ইনকোয়ারি সায়েন্স লার্নিং : পারসপেক্টিভস অ্যান্ড প্র্যাকটিস-১, টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি আমেরিকান ফরেন পলিসি, ইউজফুল জেনেটিকস পার্ট-১, ক্লাইমেট চেঞ্জ, প্রিন্সিপাল অব রাইটিং এসেস ইত্যাদি। যে কোর্সগুলো প্রণয়ন ও তত্ত্বাবধান করেছে ম্যাসচুয়েটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

‘ভিডিও টিউটরিয়াল দেখে প্রস্তুতি নিয়েছি। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনলাইন কোর্স করা ছাত্রছাত্রীদের অনেক গ্রুপ আছে। সেখানে পরীক্ষার ধরন, প্রশ্ন ইত্যাদি নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়। এগুলোও আমাকে সাহায্য করেছে’-বললেন অর্ণব। ২০১২ সালে অনলাইন কোর্স শুরু করার পর একটি ঘটনা অর্ণবের ভালো করার খিদে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ‘সেবার পরিবারের সঙ্গে চট্টগ্রামে ঘুরতে গিয়েছিলাম। ওখানে ইন্টারনেট সংযোগ ভালো না হওয়ায় ঠিকমতো প্রস্তুতি নিতে পারিনি। ঢাকায় ফিরে পরীক্ষায় বসলেও ভালো করতে পারিনি। কোর্সটা ছিল গণিত বিষয়ে। ফল দেখে একজন বলেছিল, তুই কি অঙ্কে কাঁচা? এরপর থেকেই নিজেকে প্রমাণের জন্য উঠে-পড়ে লাগি’-বললেন অর্ণব। এ ঘটনার পর একসঙ্গে পাঁচটি কোর্সের রেজিস্ট্রেশন করেন তিনি। প্রতিটিতেই সাফল্যের সঙ্গে সনদ পান। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষার সঙ্গে অনলাইনে এত কোর্সের জন্য সময় বের করা সম্ভব? অর্ণব বললেন, ‘অনলাইনে কোর্সগুলো দুই কী তিন মাসের হয়। একটু পরিশ্রম করলেই নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব। প্রতিদিন একটু একটু করে সময় দিলেই বছরে ২০টি অনলাইন কোর্স শেষ করা যায়।’

শুধু সনদই নয়, অনলাইন কোর্সগুলো অর্ণবকে সাহায্য করেছে নিয়মিত পড়াশোনাতেও। জীববিজ্ঞান তাঁর প্রিয় বিষয়। কিন্তু বইতে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর পেতেন না। অনলাইনে ‘ইনট্রোডাকশন টু বায়োলজি’ কোর্স করার পর বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে যায়।

অনলাইনে কোর্স করতে গিয়ে অর্ণব সবচেয়ে অভাব বোধ করছেন একজন সঙ্গীর। ‘অনলাইন কোর্সে ভালো করার জন্য আলোচনার বিকল্প নেই। এ জন্য প্রচুর ডিসকাশন ফোরাম আছে। কিন্তু প্রথমদিকে আমি সেসব ফোরামে একজনও বাংলাদেশি পাইনি। ক্যাম্পাসেও তখন এসব কোর্স কেউ করত না’-অর্ণব বললেন।

এ সমস্যায় এগিয়ে আসে ওয়েবসাইট কোর্সেরাই। অর্ণবের তত দিনে ২০টি কোর্স শেষ হয়েছে। ‘ওরা আমার আগ্রহ দেখে স্কাইপেতে সাক্ষাৎকার নেয়। এরপর বাংলাদেশে ওদের হয়ে প্রচারণার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেয়’-জানালেন অর্ণব।

নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পর দেশের শিক্ষার্থীদের অনলাইনে কোর্স করতে আগ্রহী করতে বেশকিছু পদক্ষেপও নিয়েছেন তিনি। কোর্সেরায় সনদ পাওয়ার জন্য কিছু চার্জ দিতে হয়। এ জন্য অনেকেই প্রথমে আগ্রহী হচ্ছিল না। আমি ওদের সঙ্গে কথা বলে এ চার্জ তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। কোর্সেরার বাংলাদেশ প্রতিনিধি হয়ে ২০১৩ সালের ৬ অক্টোবর ধানমণ্ডি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রথম অনুষ্ঠান করেন অর্ণব। এরপর আরো বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচারণা চালিয়েছেন। এর ফলাফল সম্পর্কে বলছিলেন তিনি নিজেই, ‘নিজের পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হতে না পেরে অনেক ছাত্রছাত্রীই হতাশ থাকে। আমি ওদের বলেছি অনলাইনে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে নিজের পছন্দের বিষয়ে ইচ্ছামতো কোর্স করা যায়। এটা শুধু তাদের পছন্দের বিষয়ে পড়ার সুযোগই দেবে না, পেশাজীবনের জন্যও দক্ষ করে তুলবে।’

অনলাইন কোর্সের সুবাদেই অর্ণবের সুযোগ হয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দেওয়ার। জীববিজ্ঞানে কোর্স করার পর ২০১৩ সালের আগস্টে লক্ষ্নৌতে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল অব বায়োটেকনোলজিতে যোগ দিয়েছিলেন। সেটাই ছিল এ তরুণের প্রথম আন্তর্জাতিক সন্মেলনে যোগ দেওয়া। গত বছর মালয়েশিয়ায় লিডারশিপ ক্যাম্পেও যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে ফেব্রুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের ইপিএফএল আয়োজিত আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনে অর্ণব আমন্ত্রিত হয়েছিলেন স্পিকার হিসেবে। তিনি বক্তব্য দিয়েছেন অনলাইনে পড়াশোনার ভবিষ্যৎ নিয়ে। ‘সেটা ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্তগুলোর একটি। নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে এত দূর আসার গল্প সবাইকে বলেছি। সম্মেলন শেষে সবাইকে ইউরোপিয়ান পরমাণু গবেষণাকেন্দ্র সার্ন ঘুরিয়ে দেখানো হয়। সে অভিজ্ঞতা কখনো ভুলব না’-বললেন অর্ণব।

ভবিষ্যতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনলাইনে পড়াশোনার প্রসার ঘটানোর স্বপ্ন দেখেন এ তরুণ।

যেভাবে কোর্স করবেন

অনলাইন কোর্স করতে ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। কোর্সভেদে সময় লাগবে চার থেকে ১২ সপ্তাহ। প্রস্তুতি নিতে সবচেয়ে কার্যকর ভিডিও টিউটরিয়াল। ইউটিউব ছাড়াও বিভিন্ন ডিসকাশন গ্রুপে প্রচুর টিউটরিয়াল পাওয়া যাবে। প্রস্তুতি শেষে নির্ধারিত সময়ে অনলাইনে পরীক্ষা দিতে হয়। অনলাইনে কোর্সগুলো করতে কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। কোর্সগুলো বিভিন্ন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক স্বীকৃত। অনলাইন কোর্সের রেজিস্ট্রেশনের জন্য কোনো চার্জ নেই। কোর্স শেষে ফলাফল ও সনদপত্র ই-মেইলে পাঠানো হয়। ফেসবুকে Education for everyone in Bangladesh  এই ঠিকানায় অনলাইনে পড়াশোনা বিষয়ে নানা পরামর্শ পাওয়া যাবে।

অনলাইনে কোর্সের বিভিন্ন ওয়েবসাইট

www.coursera.org

www.edx.org

www.udacity.org

www.udemy.org

www.futurelearn.org

www.khanacademy.org

বাংলাদেশি দুটি ওয়েবসাইট

www.dimikcomputing.com

www.shikkhok.com

সূত্র: কালের কণ্ঠfavicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment