সুপার হিউম্যান বাংলার ইউরি

সুপার হিউম্যান বাংলার ইউরি

  • ক্যারিয়ার ডেস্ক 

শক্তিমত্তার ভিত্তিতে পৃথিবীর সেরা পাঁচ সুপার হিউম্যানকে খুঁজে বের করে ডিসকভারি চ্যানেল। সেই পাঁচজনের একজন বাংলাদেশের ইউরি বজ্রমুনি। তাঁর কথা জানালেন নাবীল অনুসূর্য ও চন্দন চৌধুরী

 

     ১৯৬৪ সাল। ওয়াপদার প্রধান প্রকৌশলী শামসুল আলম ও তাঁর স্ত্রী আমিনা আলমের ঘর আলো করে জন্ম নিল এক শিশু। পৃথিবীর প্রথম মহাকাশচারী ইউরি গ্যাগারিনের নাম থেকে তার নাম রাখা হলো ইউরি। এই ইউরিই যে একসময় পৃথিবীতে ‘সুপারহিউম্যান’ হিসেবে বিবেচিত হবেন, সেটা নিশ্চয়ই তাঁরা তখন আন্দাজ করতে পারেননি। পারলে পৃথিবীর প্রথম মহাকাশচারী নয়, নির্ঘাত পৃথিবীর প্রথম সুপারম্যানের নামেই তাঁরা নাম রাখতেন।

ইউরির সুপারহিউম্যান খেতাব পাওয়ার গল্পটা একদমই পুরনো নয়। ২০১২ সালে ডিসকভারি চ্যানেল একটি নতুন সিরিজ শুরু করল—‘সুপারহিউম্যান শোডাউন’। শক্তিমত্তার বিচারে পৃথিবীর শীর্ষ পাঁচ ‘সুপারহিউম্যান’ খুঁজে বের করবে তারা। এই পাঁচজনকে নিয়েই হবে এই সিরিজ। সেই পাঁচজনেরই একজন হলেন ইউরি। সিরিজটি সম্প্রচারিত হয় ২০১৩ সালে। সেই প্রোগ্রামে ইউরির বর্ণনা দেওয়া হয় এই বলে—‘(ইউরি) পৃথিবীর অন্যতম অনন্য মার্শাল আর্টিস্ট। চিত্ত নিয়ন্ত্রণ, ধ্যান, প্রেরণাদায়ী বক্তব্য এবং আত্মরক্ষার শিল্পে তিনি এক অনন্য ব্যক্তিত্ব।’

ইউরি যে ‘সুপারহিউম্যান’ হবেন, সেটা যে ছোটবেলায় একেবারেই বোঝা যায়নি তা অবশ্য বলা যায় না। আর সবার মতোই ইউরিও যথাসময়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। পড়ালেখায়ও মন্দ ছিলেন না। কিন্তু উৎসাহ বেশি ছিল শরীরচর্চায়ই। ৯ বছর বয়সে মার্শাল আর্টে যোগ দেন। ১১ বছর বয়সে শিখতে শুরু করেন বার্মিজ মার্শাল আর্ট—বান্দো আর বানশে।

ইউরি ছিলেন অনেকটা স্বাধীনচেতা। মা-বাবা যখন বুঝলেন ছেলেকে ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে রাখা কঠিন, তখন ক্যাডেট কলেজে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁকে ভর্তি করা হয় ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে। সেখানে ইউরি পড়াশোনার পাশাপাশি গড়ে তোলেন একটি সংগঠন ‘মার্শাল আর্ট সোসাইটি’। পরে তিনি আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি একাডেমি থেকে কমিশন্ড অফিসার্স কোর্স এবং ব্রিটিশ হোম অফিসের অধীনে এসআইএ-থ্রি করেন।

দিন দিন ধ্যান আর যোগ ব্যায়ামের প্রতি তাঁর আগ্রহ বাড়তে থাকে। উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী শারীরিক কসরত, মানে মার্শাল আর্টের প্রতি তিনি দিন দিন মনোযোগী হতে থাকলেন। মিয়ানমারের বান্দো-বানশের চর্চা তো তিনি করতেন সেই ছোটবেলা থেকেই। পরে হাতেখড়ি নিলেন তামিল ও চীনা মার্শাল আর্টেও। সে জন্য এমনকি ঘুরে বেড়ালেন দক্ষিণ ভারতের কাঞ্চিপুরম আর চীনের শাওলিন মন্দিরগুলোতেও। তামিল আর চীনা ভাষায় মার্শাল আর্টের ওপর লেখা বিভিন্ন প্রাচীন নথিপত্র নিজ হাতে নেড়েচেড়ে দেখেশুনে বুঝে এলেন। সাউথ এশিয়ান বান্দো অ্যাসোসিয়েশন থেকে ব্যুত্থানের দশম স্তর এবং বান্দোতে সপ্তম স্তর পার করেন তিনি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তিনিই একমাত্র মার্শাল আর্ট গ্র্যান্ডমাস্টার, যাকে নিয়ে ইংল্যান্ডের ‘কমব্যাট’ ও ‘মার্শাল আর্ট ইলাসট্রেটেড’ পত্রিকা প্রচ্ছদ রচনা করেছে।

দক্ষিণ এশিয়ার মার্শাল আর্টের ইতিহাস সমৃদ্ধ। এখানকার বিভিন্ন অঞ্চলে ধ্যান-যোগ ব্যায়ামের সমন্বয়ে বিভিন্ন মার্শাল আর্ট প্রচলিত ছিল। ইদানীং বিভিন্ন সিনেমায় সেসবের দেখা মিললেও, বাস্তবে এগুলো এখন বিলুপ্তপ্রায়। এ ব্যাপারটা ইউরিকে বেশ কষ্ট দিত। সে জন্যই তিনি ভাবতে শুরু করেছিলেন, এই মার্শাল আর্টের সুদিন আবার ফেরানো যায় কিভাবে। মার্শাল আর্টের দক্ষিণ এশিয়ার আদি ধারাকে আধুনিক যুগের উপযোগী একটা নতুন ধারা বানানো যায় কি না। সে চেষ্টারই ফসল ইউরির নিজস্ব ‘ব্যুত্থান’। ইউরির ভাষায়, ‘দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন মার্শাল আর্টের ঐতিহ্যের আলোকে সৃষ্টি করা আত্মরক্ষামূলক ক্রীড়া ও ব্যক্তিগত উন্নয়নের এক যুগান্তকারী পদ্ধতি।’

কেবল এই মার্শাল আর্টটি প্রবর্তন করেই বসে থাকেননি ইউরি। রীতিমতো এর প্রচার-প্রসারের বন্দোবস্তও করছেন। গঠন করেছেন ইন্টারন্যাশনাল ব্যুত্থান ফেডারেশন। সংগঠনটির মহাসচিব তিনি। ওয়ার্ল্ড কমব্যাট সেল্ফডিফেন্স ফেডারেশনেরও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর চেষ্টায় বাংলাদেশেও চালু হয়েছে  ব্যুত্থান। ২০১৩ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ একে খেলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। খেলাটির ফেডারেশনও গঠিত হয়। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করছেন ইউরি।

কেবল ব্যুত্থানই না, বজ্রপ্রাণ প্রবর্তকের সম্মান দেওয়া হয় তাঁকে। ‘স্কুল অব বার্মা কালাই অ্যান্ড সিদ্ধ মেডিসিন’ থেকে তাঁকে বজ্রমুনি উপাধি দেওয়া হয়। মানুষ এখন তাঁকে চেনে ইউরি বজ্রমুনি নামেই। ইউরির গল্প এখানেই শেষ নয়। তিনি ধ্যান বা মেডিটেশনের মাধ্যমে প্রায় পুরো শরীরের ওপরই নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে পারেন। বিজ্ঞানীরা তাঁকে রীতিমতো পরীক্ষাগারে নিয়ে বসিয়ে এই ক্ষমতার পরীক্ষা নিয়েছেন। তারপর ফলাফল দিয়েছেন, তিনি ধ্যানের মাধ্যমে শরীরের ৯৬ শতাংশ পেশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এটি একটি বিশ্বরেকর্ড। তাঁর এমন বিশ্বরেকর্ড আছে আরো তিনটি। সেগুলোর জন্য তাঁর নাম উঠেছে ‘রিপ্লিজ বিলিভ ইট অর নট!’-এ। তারই একটি হলো এক লাথিতে তিনটি বেসবল ব্যাট ভাঙা। এই লাথি, যার কেতাবি নাম ‘শিনকিক’, সেটা হাঁকাতে ইউরি এতটাই সিদ্ধহস্ত যে তার আরেক নামই হয়ে গেছে ‘দ্য থান্ডার শিনম্যান’।

 

ডিসকভারি থেকে কিভাবে ডাক পেলেন?

‘সুপারহিউম্যান শোডাউন’-এর জন্য ডিসকভারির বৈজ্ঞানিক দল একটি পদ্ধতি বের করেছিল। প্রাথমিকভাবে মানব শরীরকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে—হাতের শক্তি, কথার শক্তি, ফুসফুসের শক্তি, পেটের শক্তি ও পায়ের শক্তি। এই পাঁচ ক্যাটাগরিতে যাদের ওয়ার্ল্ড রেকর্ড রয়েছে তাদের ইমেইল করে। শুরুতে ৬০ জনকে ডাকা হয়। সেখান থেকে নির্বাচিত করা হয় ২০ জন। তারপর সেখান থেকে পাঁচ ক্যাটাগরির পাঁচজনকে নির্বাচিত করা হয়।

আপনি পায়ের শক্তি ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত হন। বাকি চারজন?

হাতের শক্তি ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত হন জার্মানির ফ্র্যাঞ্জ মুলার। তিনি হাত দিয়ে গাড়ি উল্টিয়ে ফেলতে পারেন, চলতি গাড়ি সাত সেকেন্ডের মতো আটকে রাখতে পারেন। গলার বা শব্দের শক্তিতে ছিলেন আমেরিকার জিমি ব্যান্ডেরা, ফুসফুসের শক্তিতে জর্জিয়ার ফিলাস কেভি; তিনি ফুঁ দিয়ে ওয়াটার ব্যাগ ছিঁড়ে ফেলতে পারেন আর পেটের শক্তিতে নির্বাচিত হন আফ্রিকার কোনার্ড।

 

আপনার ওয়ার্ল্ড রেকর্ডটা কেউ ভাঙতে পেরেছে?

এখনো কেউ ভাঙতে পারেনি। আমি তিনটা বেস ব্যাট এক লাথিতে ভেঙেছিলাম। এটার ওপর আমেরিকার ওয়েন ইউনিভার্সিটি ফিজিকস ডিপার্টমেন্ট একটা গবেষণা চালিয়েছে। দেখা গেছে, একটা ব্যাট ভাঙতে ৭৫০ পাউন্ড শক্তি দরকার। তাহলে তিনটা ভাঙতে এক টনের বেশি!

 

ডিসকভারির অভিজ্ঞতার কথা বলুন।

আমি বাংলাদেশের মানুষ। তার ওপর মার্শাল আর্ট করি, শুনে প্রথম দিকে অনেকে হেসেছে। বলেছে, বাংলাদেশের মানুষ আবার মার্শাল আর্ট পারে নাকি! যখন ফাইনালে এলাম, আমাদের যে প্রোডিউসার, আইয়ান, আমার দারুণ ভক্ত হয়ে যায়। বলত, ‘ইউরি, আমি তোমার বায়োগ্রাফি কম করে হলেও ৫০ বারের বেশি পড়েছি। তোমার যেকোনো বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারো, উত্তর দিতে পারব। নেটে তোমার যত কিছু আছে সব দেখেছি, পড়েছি। আমাকে খুব উৎসাহ দিত সব সময়। আমাদের ফাইনাল শুটিংটা হয় ইংল্যান্ডে। ডিসকভারির ক্যামেরাম্যানসহ অন্যরা আমেরিকা থেকে এসেছিল। সবাই তাকে বলত, আইয়ান, তোমার ফ্যানগিরিটা একটু কমাও। শুটিংয়ের সময় আমি যখন লাথি দিয়ে ব্যাট ভেঙে ফেললাম, আইয়ান তালি দিয়ে উঠল। এটা নিয়মের বাইরে ছিল। কারণ শুটিংয়ের সময় শব্দ করার নিয়ম নেই।আপনি পারলেন, কিন্তু আমাদের দেশে তো মার্শাল আর্টের তেমন চল নেই।

 

অথচ এই মার্শাল আর্টের শুরুটা আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায়, মানে ভারত উপমহাদেশে। পদ্ধতিগত মার্শাল আর্টের জনক ক্ষত্রিয় বংশের বোধী ধর্মা। তিনি দক্ষিণ ভারতের কাঞ্চিরমের। তিনি মনোদৈহিক চর্চায় দারুণ পারদর্শিতা লাভ করেন। এরপর গুরু প্রজ্ঞাতারার কথায়, ৫২০ খ্রিস্টাব্দে চীনের শাওলিন টেম্পলে যান। যাকে বলা হয় খালি হাতে যুদ্ধ করার লালনস্থল। অথচ এই বিদ্যাটা আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার। আর এখন বাংলাদেশের এই সময়ের কথা বলতে গেলে মা-বাবারা ভাবেন যে এটা একটা মারামারি। আসলে তো তা নয়। এটাও ঠিক যে এখানে যাঁরা মার্শাল আর্ট শিক্ষা দেন, এ সম্পর্কে তেমন জানেন না। মার্শাল আর্ট যাঁরা করেন, তাঁদের উচ্চপর্যায়ের মেডিটেশন দরকার। মার্শাল আর্টের মেডিটেশনটিই হচ্ছে অন্য খেলাধুলা থেকে এর ভিন্নতা। এখন তো অন্যান্য খেলায়ও কোচরা মানসিক ট্রেনিং করিয়ে থাকেন। তবে মার্শাল আর্টে এর ব্যাপক প্রভাব।

 

পড়াশোনাটা তাহলে এ ক্ষেত্রে বেশ প্রয়োজন।

অবশ্যই। সেই ছোটবেলা থেকে আমি এ বিষয়ে পড়াশোনা করে এসেছি। মা-বাবা বা আত্মীয়স্বজন টাকা দিলে আমি কিন্তু এই জাতীয় বই কিনেছি। ক্যাডেট কলেজে আমি এ ক্ষেত্রে দুই শিক্ষকের বেশ সহযোগিতা পেয়েছি। প্রিন্সিপাল ছিলেন কর্নেল নূরুল আনোয়ার, আর অ্যাডজুট্যান্ট মেজর তারেক। ক্লাসের সময় যদি মেজর তারেককে বলতাম, স্যার, আমি একটু লাইব্রেরি স্টাডি করতে চাই। উনি স্পেশাল পারমিশন দিতেন। ক্যাডেট কলেজে রোল ভেঙে তারা আমাকে কী ভেবে যে তখন এত প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, ভাবলে এখনো অবাক হই। কলেজ পাসের পর আমি প্রায় ৫০টি দেশ ভ্রমণ করেছি এবং মার্শাল আর্টের ৪০ ধরনের স্টাইল শিখেছি।

 

অনেক সম্মাননা পেয়েছেন, কোনটিকে বেশি গুরুত্ব দেবেন?

পৃথিবীসেরা অনেক সম্মাননাই পেয়েছি। ২০০৬ সালে ওয়ার্ল্ড লিডার ইন কমব্যাট মার্শাল আর্ট অ্যাওয়ার্ড, ২০০৮ সালে ওয়ার্ল্ড ব্ল্যাক বেল্ট মার্শাল আর্ট অ্যাওয়ার্ড, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গ্র্যান্ডমাস্টারদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড গ্র্যান্ডমাস্টার কাউন্সিল, আমেরিকার সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘গ্র্যান্ডমাস্টার পিনাকেল অ্যাওয়ার্ড ২০০৯’। এভাবে বলতে গেলে অনেক। তবে পুরস্কারের চেয়ে বেশি ভালো লেগেছে অন্যভাবে সম্মাননা পেয়ে। ১৯৯১ সালে আমার গ্র্যান্ডমাস্টার কিং মং জি বাংলাদেশে আসেন। তখন তিনি তাঁর পৃথিবীর সব ছাত্রের মধ্যে নেক্সট জেনারেশন সাকসেসর হিসেবে আমার নাম ঘোষণা করেন। আরেকটি হলো ২০০৫ সালে। মিয়ানমার মার্শাল আর্ট ফেডারেশন সে দেশের ৩২ জন গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়ে আমাকে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা দেয়। ওখানে আমাকে একটা উপাধি দেয়, ‘সাম থিং পা’। এটা হচ্ছে একটা ফুল, যা ১০০ বছরে একবার ফোটে। বান্দোর সভাপতি সেদিন বলেন, পৃথিবীতে বান্দোকে পরিচিত করার দায়িত্ব আমরা তোমার হাতে দিচ্ছি। এটা অনেক অনেক বড় একটা ভার।

সূত্র: কালের কন্ঠ

favicon59

 

Sharing is caring!

Leave a Comment