সন্তানের ক্যারিয়ার, অভিভাবকের ভাবনা

সন্তানের ক্যারিয়ার, অভিভাবকের ভাবনা

  • ক্যারিয়ার ডেস্ক

সন্তানের পক্ষ থেকে আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, আমি এটা হতে চাইলেও আব্বু আম্মু চায় তাদের পছন্দে ক্যারিয়ার গড়ি। ফলে বিপত্তিটা শুরু হয় তখনই। দূরত্ব বাড়তে থাকে অভিভাবকের সঙ্গে সন্তানের। এমন সব বিপত্তির সমাধান খুঁজতে বাবা মো. জাহেদুর রহমান ও, মা নিলুফার ইয়াসমিন আর সন্তান ফাতিহা তাসনীম এবং বুশরা তাসনীমের সঙ্গে কথা বলে তৈরি করা হয়েছে এই প্রতিবেদন।


ক্যারিয়ার যাত্রায় সন্তান বনাম বাবামা

পড়ালেখা শেষ, এবার ক্যারিয়ার গড়তে নানা জায়গায় সিভি ড্রপ করা, পরীক্ষা দেয়া- আরও কত কি! কিন্তু সব সময় চাহিদা আর কাজের আগ্রহ জন্মালেও অনেকেরই হয়ে ওঠে না কাজ করা। কারণ ঘরের অভিভাবক বাবা চান না, তার ছেলে বা মেয়ে এমন জবে চাকরি করা তো দূরের কথা, অ্যাপ্লাই করুক। কতটা যৌক্তিক এমন আচরণ?- এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিলে বাবা মো. জাহেদুর রহমান জানান, না; বাবা-মায়ের কখনওই উচিত নয়; সন্তানের পছন্দের বাইরের কোনো ক্যারিয়ার চাপিয়ে দেয়া। তিনি আরও বলেন, আপনাকে মনে রাখতে হবে, চাকরি কিন্তু এসএসসি, এইচএসরি মতো দুই বছর বা চার বছরের কোর্স নয় যে, সন্তান বাবা-মায়ের ইচ্ছায় ভর্তি হল, আর কষ্ট করে দু’বছর পার হলেই বেঁচে গেল। ক্যারিয়ারের সঙ্গে যেহেতু আজীবন একই লাইনে জড়িত থাকার ব্যাপারটি রয়েছে, সে জন্য যিনি চাকরি করবেন, তার পছন্দকেই গুরুত্ব দেয়া উচিত।

অসুস্থ প্রতিযোগিতা ঝামেলার শুরু

মা নিলুফার ইয়াসমিন জোর দিয়ে বলছিলেন, বাবা-মা আর সন্তানের চাওয়া-পাওয়ার ঝামেলাটা শুরু হয় অনেক আগ থেকেই। যেমন শহুরে সংস্কৃতিতে বহুলাংশেই দেখা যায়, মা তার সন্তানকে স্কুল-কোচিংয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সে হিসেবে আমিও যেহেতু আমার দু’সন্তানকে বহু বছর এস্কুল থেকে ওস্কুল বা কোচিংয়ে আনা-নেয়ায় ব্যস্ত ছিলাম, তখন দেখতাম সন্তানদের চেয়েও বেশি প্রতিযোগিতা করে তার মা-বাবা। যেমন- কোনো পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হল- নাম্বার কম পেলেই জিজ্ঞাসা করা হয়, ও যদি এত পেতে পারে, তুমি কেন পাওনি? অথচ আমরা নিজের সন্তানকে যদি কেন তুমি কম পেয়েছ বা এটা করলে আরও ভালো হতো; এক কথায়- নিজের সন্তানকে যদি ওকে দিয়েই বিচার-বিশ্লেষণ করতাম, তাহলে ঝামেলাটা অনেকটাই কমে যেত, বৈকি! এমনিভাবে অভিভাবকরা সন্তানের চাকরিও ঠিক করে দেয় অন্যের সন্তানকে দেখে। ও এ লাইনে বড় চাকরি করে, তুমিও ওর লাইনে যাও- এমনটা করা ঠিক নয় বলেও জানান তিনি।

নিজের স্বপ্ন সন্তানের ওপর

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে- অভিভাবকরা নিজের যে স্বপ্ন অধরা বা অপূর্ণ রয়ে গেছে সেটা সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করাতে গিয়ে চাপ বা অতিমাত্রায় খবরদারি করছেন। অথচ চিন্তা করেন না, সন্তানও তো একটা মানুষ। তার নিজেরও একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে; গতি আছে; আছে একান্ত স্বপ্ন ও ভাবনার স্বাধীনতা। এ প্রসঙ্গে বাবা মো. জাহেদুর রহমান বলেন, অভিভাবকরা অবশ্যই সন্তানকে নজরে রাখবে, তবে সেটা যেন ওর স্বাভাবিকত্ব বা ওর কাছে চাপ মনে না হয়।

সময়কাল সমাজের পার্থক্য

বাবা-মায়ের সময় আর সন্তান বর্তমান যে সমাজে বসবাস করছে তার মধ্যে ব্যবধান কিন্তু অনেক। সময়ের দাবির প্রেক্ষিতেই দেখা যায় ‘উদ্যোক্তা’ বা ‘স্বাধীনভাবে নিজের প্রতিষ্ঠান ও নিজের ব্রান্ডভ্যালু প্রতিষ্ঠা’ করতেই উদগ্রীব বর্তমানের তরুণ সমাজ। আধুনিক ও তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে নিজেকে মেলে ধরা, প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করাই সত্যিকারের ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিচ্ছে আজকের সন্তানরা। এ ব্যাপারে সদ্য কলেজগামী শিক্ষার্থী বুশরা তাসনীম বলেন, প্রযুক্তির কল্যাণে এখন নতুন নতুন ক্যারিয়ার হচ্ছে; তাই বাবা-মায়ের উচিত এ সব কাজ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে, আগের ৯-৫টা চাকরির চিন্তা থেকে বের হয়ে, নতুন স্ট্যাইলের চাকরি যেমন ক্রিয়েটিভ অঙ্গন, মিডিয়া, আন্তর্জাতিক সংস্থা, মাল্টিন্যাশনাল চাকরিতে যেতে চাইলে সহায়তা করা।

ভিন্ন কাজে বাধা

সমাজে প্রতিনিয়ত যা হচ্ছে বা ঘটছে, তাতেই সহজে সায় দিতে দেখা যায় অভিভাবকদের। ভিন্ন টাইপের কোনো কাজে তাদের অনুমতি মেলা ভার। অথচ দিন বদলাচ্ছে। মোবাইল আর কম্পিউটারের অ্যাপস আর ডিজাইনের মতো চাকরির মনমানসিকতা, ধরনও পাল্টাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। সে ক্ষেত্রে সব সন্তানের একটাই অভিযোগ, একটু ভিন্ন বা চ্যালেঞ্জিং কিছু করতে চাইলে এখন খুব সহজে পরিবার থেকে অনুমতি মেলে না। এ ব্যাপারে মা নিলুফার ইয়াসমিন বলেন, সন্তানকে যদি নতুন কাজে সাহস ও সুযোগ না দেই, তাহলে সমাজে নতুনত্ব সৃষ্টির উদাহরণ আসবে কি করে!

পার্থক্য যখন ছেলেমেয়ে

বাবা-মা অনেক সময় বলেন, তুমি তো ছেলে সুতরাং এমন কাজ করো না। তুমি যেটা নিয়ে ভাবছ এটা দায়িত্ববান পুরুষের কাজ নয়। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে এ কথাতো চরম সত্য যে, পরিবার-সমাজ এবং আত্মীয়-স্বজনের কড়া নজর তুমি মেয়ে। কিভাবে এটা করবা! এতে অনেক ঝামেলা। অথচ ওকে ওর পথে হাঁটতে দিন, দেখবেন আপনার ধারণাই পাল্টে দেবে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, ছেলে বা মেয়ে নয়, ওদের মানুষ হিসেবে ট্রিট করুণ, দেখবেন আপনাদের সহযোগিতার প্রতি সম্মান দেখিয়ে নিজেকে আর পরিবারকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।

শাসক নয় সহযোগী হই

বাবা মো. জাহেদুর রহমান আবারো বলেন, চেপে ধরে নয়, বাবা-মায়ের উচিত সন্তানকে যথেষ্ট স্পেস দেয়া। নতুবা সময়ের পরিবর্তনে সন্তান ঠিকভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারবে না। মা নিলুফার ইয়াসমিন এ সময় যোগ করে বলেন, আমি সন্তানকে বেঁধে বা কড়া আইনের শাসন করে ওর থেকে ভালো কিছু বের করে আনতে পারব না; বরং ওকে যতটা ইজি পরিবেশ দিতে পারব, সন্তান ততটাই জীবন ও পরিবারের মূল্যবোধকে অনুভব করতে পারবে। যেটা স্বপ্নপূরণ ও ক্যারিয়ার গঠনে বেশ দরকারি।

পছন্দে পথ চলা

‘প্রত্যেকের নিজের একটা পছন্দ-অপছন্দ আছে। এমনকি যিনি কাজটি করবেন তার পছন্দ মতো যদি কাজটি করতে দেয়া যায়, আমার মনে হয় ওই কাজটিতে সবচেয়ে বেশি সফল হওয়া যায়’- এমনটিই বলছিলেন সন্তান ফাতিহা তাসনীম। তবে এটা সত্য যে, অনেক সময়ই আমি দেখি বন্ধুদের মধ্যে কেউ একটা কাজ করতে চায়, কিন্তু ফ্যামিলি থেকে অনুমতি পাচ্ছে না, সেটা কিন্তু খুব ভালো ফল দেয় না। তখনই সন্তান পরিবার থেকে দূরে চলে যায়, কখনও ঘটে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও। একই সঙ্গে পরিবারকে জানা উচিত- এখন কিন্তু মানুষ শুধু টাকার জন্য চাকরি করে না, ক্যারিয়ারকে এমনভাবে সবাই নিচ্ছে- যেখান থেকে জীবনে নতুন কিছু উপলব্ধি, আনন্দ, এক কথায় কোয়ালিটি টাইম পায়- পরিবারের এ সব দিক বিবেচনায় নেয়া দরকার।

অভিভাবক নয়, বন্ধু হই

এমনিতেই পরিবারের অভিভাবক হচ্ছেন বাবা-মা। তারপর যদি ঘরে থাকে বড় ভাই, ছোট ভাই বা বোন। এ ক্ষেত্রে পরিবারে নিজের থেকে বয়সে বড় সবাই দেখাতে থাকেন অভিভাবকত্ব নামের ঝলকানি। বড় বড় মত এবং পথের এ সব মানুষের চাপানো ক্যারিয়ার ভাবনায় হিমশিম খেতে হয় বয়সে ছোটদের। কোথাও কোথাও হিসেব হয় উল্টো- দেখা গেল পরিবারের সবচেয়ে বড় সন্তান, এ মানুষটির কাছে আবার সবার চাওয়া- একটা নিরিবিলি, টিপিক্যাল টাইপের চাকরি করুক, যাতে উত্থান-পতন কম থাকবে, চাকরিটা সরকারি ও স্থায়ী হবে, যাতে ফ্যামিলিতে স্বস্তির নিশ্বাস থাকে। সবার এমন দাবি রক্ষা করতে গিয়ে নিজের পছন্দই হারিয়ে যেতে দেখা যায় অনেকের। তাই চলুন অভিভাবকত্বের সঙ্গে বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়াই, বুঝতে চেষ্টা করি ও প্রত্যেককে পৌঁছে দেই সর্বোচ্চ চূড়ায়।

সমঝোতায় আসুক স্বপ্নসুধা

সন্তান চাকরি যে পেশাতেই করতে চায়, দেখা যায়- আম্মু রাজিতো আব্বু রাজি না। তাই চলুন বসি আলোচনায়। সবাই মিলে করেফেলি একটু হিসাবে-নিকাশ। এবং আলোচনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেই সন্তানের পছন্দ-অপছন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্যকে। আর ক্যারিয়ার গঠনে সন্তানের চাওয়াকে গুরুত্ব দিলে ওর ভেতরের খুশিই ওকে সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে যাবে। সবশেষে মা নিলুফার ইয়াসমিন যেমন বললেন, পরিবারের সবার বিশেষ করে বাবা-মায়ের সমঝোতা ও সহযোগিতাই পারে সন্তানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহায়ক মন্ত্র হতে।

সূত্র: যুগান্তরfavicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment